ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় গুলি করে হত্যা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও ১৪টি মামলা দায়েরের তথ্য পাওয়া গেছে। সম্প্রতি ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত ও রাজধানীর বিভিন্ন থানায় এসব মামলা হয়েছে।
এসব মামলাসহ এ পর্যন্ত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ২৫৩টি মামলা দায়েরের তথ্য পাওয়া গেল। এর মধ্যে হত্যা মামলার সংখ্যা ২১৩টি। বাকি মামলাগুলোর অধিকাংশই হত্যাচেষ্টা ও অপহরণ মামলা।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেন। তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে প্রথম মামলা হয় ১৫ আগস্ট। এর পর থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন আদালত ও থানায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যাচেষ্টা ও অপহরণের অভিযোগে মামলা হচ্ছে। শেখ হাসিনা ছাড়াও তাঁর সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য, দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হত্যা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা হচ্ছে।
ইতিমধ্যে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, সাবেক সংসদ সদস্য, সরকারি আমলাসহ বিভিন্ন পেশার অন্তত ৯০ জন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।
৫ নভেম্বর থেকে গত শনিবার পর্যন্ত তথ্য পাওয়া ১৪টি মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো।
মো. রুমন নামের এক তরুণকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ৫৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গত শনিবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় এ মামলা রেকর্ড হয়। মামলার বাদী রুমনের বোন রুমিয়া আক্তার।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে গত ১৯ জুলাই বিকেল ৫টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেন রুমন। এ সময় হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে রুমনকে হত্যা করা হয়। গুলিটি লাগে তাঁর বুকের বাঁ পাশে। মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ সেলিম, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকেও আসামি করা হয়েছে।
রাজধানীর গুলশান এলাকায় আবুজর শেখকে (২৪) গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ২৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গত শনিবার রাজধানীর গুলশান থানায় এ মামলা রেকর্ড হয়েছে। মামলার বাদী আবুজর শেখের মা ছবি খাতুন। মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, গত ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় প্রগতি সরণির বারিধারা জেনারেল হাসপাতালের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার মিছিল চলছিল। তখন মিছিলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগের নেতারা গুলি করেন। এ সময় আবুজর শেখ গুলিবিদ্ধ হন। এর ৯ দিনের মাথায় মারা যান তিনি।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়ায় কিশোর সুলাইমানকে (১৬) গুলি করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ১১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গত শনিবার কদমতলী থানায় এ মামলা করেন সুলাইমানের মা রেখা বেগম। মামলায় বলা হয়েছে, শনির আখড়ায় গত ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার মিছিলে অস্ত্রধারী আওয়ামী লীগের লোকজন গুলি চালান। এতে সুলাইমান গুলিবিদ্ধ হয়।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে গাড়িচালক ইনছান আলীকে (২৬) গুলি করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ২৬৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ১৩ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় করা মামলায় বলা হয়েছে, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার মিছিলে অংশ নেন ইনছান। তখন স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগসহ আসামিরা মিছিলে গুলি ছোড়েন। এতে ইনছান গুলিবিদ্ধ হন।
রাজধানীর চানখাঁরপুলে ব্যবসায়ী সামছুল ইসলামকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১৩ নভেম্বর। শাহবাগ থানায় মামলাটি করেন সামছুলের খালাতো ভাই লিটন মিয়া। মামলায় বলা হয়, গত ৫ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে চানখাঁরপুলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি করেন আসামিরা। তখন গুলিবিদ্ধ হন সামছুল। পরদিন তিনি মারা যান।
রাজধানীর শাহবাগে পিকআপ ভ্যানচালক আবদুল্লাহ আল আবীরকে গুলি করে হত্যায় শেখ হাসিনাসহ ৮১ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। শাহবাগ থানায় ১৩ নভেম্বর করা মামলার বাদী আবদুল্লাহর মামাতো ভাই ফিরোজ হোসেন। মামলার এজাহারের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৯ জুলাই রাত ৮টার দিকে শাহবাগের ছাত্র-জনতার মিছিল চলছিল। এ সময় যানজটে আটকা পড়েন আবদুল্লাহ। তখন আওয়ামী লীগ, যুবলীগসহ অন্য আসামিরা গুলি ছুড়লে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। পরদিন তিনি মারা যান।
রাজধানীর রামপুরায় নাজমুল হাসান নামের এক যুবককে গুলি করে হত্যায় শেখ হাসিনাসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। ১২ নভেম্বর রাজধানীর রামপুরা থানায় মামলাটি করেন নাজমুলের বন্ধু মো. মজিবুল্লাহ।
রাজধানীর রায়েরবাগে মাহাদী হাসান (১৯) নামের এক যুবককে গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ৮ নভেম্বর মামলাটি কদমতলী থানায় রেকর্ড হয়।
রাজধানীর বাড্ডায় হাফেজ মাসুদুর রহমানকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ১৫৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ৯ নভেম্বর বাড্ডা থানায় করা ওই মামলায় সাবেক মন্ত্রী দীপু মনি, আনিসুল হককেও আসামি করা হয়।
রাজধানীর ভাটারা এলাকায় মনির হোসেন নামের এক যুবককে গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ২১৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ৪ নভেম্বর ভাটারা থানায় করা মামলায় হাসানুল হক ইনুকেও আসামি করা হয়।
রাজধানীর মিরপুরে পারভেজ হোসেন (২১) নামের এক তরুণকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ৫২ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় মামলাটি রেকর্ড হয়েছে ৪ নভেম্বর।
রাজধানীর মগবাজারে সোহেল (১৮) নামের এক যুবককে গুলি করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ১৩৮ জনের বিরুদ্ধে ৬ নভেম্বর রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মামলা হয়েছে।
যাত্রাবাড়ীতে সাংবাদিক মেহেদী হাসানকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ৭ নভেম্বর মামলাটি যাত্রাবাড়ী থানায় রেকর্ড হয়েছে। মামলার কাগজপত্রের তথ্য অনুযায়ী, যাত্রাবাড়ীতে খবর সংগ্রহের সময় গত ১৮ জুলাই সন্ধ্যার দিকে ঢাকা টাইমসের সাংবাদিক মেহেদী হাসানকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
রাজধানীর হাতিরঝিলে মো. বাবু নামের এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ৭৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ৪ নভেম্বর মামলাটি হাতিরঝিল থানায় রেকর্ড হয়েছে।
এ ছাড়া ঢাকার সিএমএম আদালতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তিনটি পৃথক হত্যা মামলা নেওয়ার আবেদন করেছেন স্বজনেরা। এসব বিষয়ে কোনো মামলা হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখে প্রতিবেদন দিতে সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।