জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ২০২৩ বর্ষবরণের সময় অভিযোগ এসেছিল ৩৬৫টি। এবার এসেছে ৯৭১টি।
খ্রিষ্টীয় বর্ষবরণে উচ্চ শব্দে গানবাজনা, আতশবাজি ও পটকা ফোটানোর নিষেধাজ্ঞা এবারও মানা হয়নি। বরং গত বর্ষবরণের তুলনায় এবার ‘জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯’ নম্বরে এ–সংক্রান্ত অভিযোগ এসেছে আড়াই গুণের বেশি। এর আগের বছরের তুলনায় এটি সাড়ে আট গুণ ছাড়িয়ে গেছে।
জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এর তথ্য অনুসারে, ৩১ ডিসেম্বর রোববার রাত ১০টা থেকে পরদিন গতকাল সোমবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত উচ্চ শব্দে গানবাজনা ও শব্দদূষণ–সংক্রান্ত ৯৭১টি অভিযোগ এসেছে। বাসায় অসুস্থ ব্যক্তি আছেন, কম বয়সী শিশু উচ্চ শব্দে ভয় পেয়ে ঘুমাতে পারছে না বা নিজেরা ঘুমাতে পারছেন না বলে অভিযোগ করা হয়।
মোট অভিযোগের ২৪ শতাংশের বেশি অভিযোগ এসেছে শুধু ঢাকা মহানগর থেকে। উদ্যাপনের সময়ে বায়ুদূষণের একটি হার নির্ণয় করে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) গবেষকেরা জানিয়েছেন, ওই সময় বায়ুদূষণ বেড়েছিল ৩৫ শতাংশ।
৯৯৯–এর গণমাধ্যম ও জনসংযোগ কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, শব্দদূষণের মধ্যে আতশবাজি ও পটকা ফোটানো রয়েছে। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ এসেছে গতকাল রাত ১০টা থেকে পরদিন ভোর ৪-৫টা পর্যন্ত।
এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, অবহিত করার পর সংশ্লিষ্ট থানা থেকে ঘটনাস্থলে গিয়ে গানবাজনা থামানো হয়েছে বা আতশবাজি ও পটকা ফোটানো বন্ধ করা হয়েছে। আর গতকাল দুপুর পর্যন্ত অভিযোগগুলো ছিল উচ্চ শব্দে গান বাজানোর।
বর্ষবরণের আগে এবারও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে অনুরোধ জানাতে থাকেন সীমিত আকারে আনন্দ-উৎসব করার জন্য। ২০২২ বর্ষবরণের সময় তানজিম উমায়ের নামে চার মাস বয়সী এক শিশুর মৃত্যুর ঘটনাটিকেও উদাহরণ হিসেবে টানেন অনেকে।
ওই সময় উমায়েরের বাবা ইউসুফ রায়হান জানিয়েছিলেন, জন্মগতভাবে তাঁর ছেলের হৃদ্যন্ত্রে ছিদ্র ছিল। ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর আতশবাজি ও পটকা ফোটানোর শব্দে বারবার তাঁর সন্তান কেঁপে ওঠে। সারা রাত ঘুমাতে পারেনি।
ইউসুফ বলেন, পরদিন সকালে শ্বাসকষ্ট শুরু হলে রাজধানীর মিরপুরের ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে নিয়ে যাওয়ার তিন ঘণ্টা পর উমায়ের মারা যায়। চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, পটকা-আতশবাজির সঙ্গে শিশুটির অসুস্থতার সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও যেকোনো শব্দ বা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি অসুস্থ কাউকে আরও বেশি অসুস্থ করে ফেলতে পারে।
এবার বর্ষবরণ উপলক্ষে আতশবাজি, পটকা ফোটানো ও ফানুস ওড়ানোর মতো বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞাসহ ১৪ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। তবে সেসব নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই নববর্ষের রাতে রাজধানীতে আতশবাজি, পটকা ফোটানো ও ফানুস ওড়ানো হয়েছে।
৯৯৯ নম্বরের তথ্য অনুসারে, এবার ৯৭১টির মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ২৩৭টি অভিযোগ এসেছে ঢাকা মহানগর থেকে। এ ছাড়া ফানুস থেকে একটি আগুন লাগার অভিযোগ আসে। যদিও তথ্য দেওয়া ধানমন্ডি এলাকার ওই ব্যক্তি আবারও ফোন করে জানান, তাঁরা নিজেরা আগুন নিভিয়ে ফেলেছেন।
২০২৩ বর্ষবরণের সময় ৩৬৫টি অভিযোগ আসে ৯৯৯ নম্বরে। এর মধ্যে শুধু ঢাকা মহানগর এলাকা থেকে ১৬০টি অভিযোগ আসে। ওই বছরও একটি আগুন লাগার অভিযোগ আসে মোহাম্মদপুর থেকে।
২০২২ বর্ষবরণের সময় অভিযোগ আসে ১১২টি। এর মধ্যে রাজধানী থেকে আসে ৫৪টি। ওই রাতে আতশবাজি ও ফানুস থেকে রাজধানীর ছয় জায়গায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। যাত্রাবাড়ী ও ধোলাইখাল এলাকায় ফায়ার সার্ভিসকে গিয়ে আগুন নেভাতে হয়েছিল।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহসভাপতি ইকবাল হাবিবের মতে, অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও আতিশয্য থেকে ঢাকায় ঘটনা বেশি ঘটছে। ঢাকার মানুষ তুলনামূলক সচেতন বলে অভিযোগও বেশি এসেছে। ইকবাল হাবিব বলেন, বিস্ফোরক আইন অনুসারে লাইসেন্সধারী ছাড়া কেউ পটকা ফোটাতে পারেন না। উন্নত দেশে নির্দিষ্ট জায়গায় সীমিত পরিসরে উদ্যাপন করা হয় জানিয়ে ইকবাল হাবিব বলেন, শুধু নিষেধাজ্ঞা জারি করে বা নির্দেশনা দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বসে থাকলে হবে না। ঘটনা প্রতিরোধে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি অনুসরণ করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে।
রাজধানীর স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) একটি গবেষক দল রোববার রাত ৯টা থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত নববর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে বায়ু ও শব্দদূষণের তীব্রতা পর্যবেক্ষণ করে। ওই গবেষণায় নববর্ষ উদ্যাপনের কয়েক ঘণ্টা আগে ও পরে বায়ু ও শব্দদূষণের মাত্রা পরিমাপ করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালের নববর্ষে রাত ১১টা থেকে ১২টার তুলনায় পরবর্তী ১ ঘণ্টা অর্থাৎ ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত বায়ুদূষণের পরিমাণ ৩৫ শতাংশ বেড়েছিল। ২০২৪ সালের প্রথম ঘণ্টায় শব্দদূষণের হার এর আগের দিনের (৩০ ডিসেম্বর) তুলনায় প্রায় ৪২ শতাংশ বাড়ে এবং বেশির ভাগ সময় শব্দের মাত্রা ৮০ থেকে ৯০ ডেসিবলের মধ্যে ছিল।
ক্যাপসের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, নববর্ষ উদ্যাপনের অডিও–ভিডিও রেকর্ড করেছিল গবেষণা দল। প্রথম আধা ঘণ্টার অডিও শুনে মনে হয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্র। বিভীষিকাময় ছিল পরিস্থিতি। এভাবে উদ্যাপন প্রতিহত করতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। আতশবাজি ও পটকা বিক্রি বন্ধে এক মাস আগে থেকে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।