পাঠকের লেখা–৩৭

‘ভূত এফএম’ ও অতঃপর

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: readers@prothomalo.com

এফএম রেডিওর ভক্ত আমি। অষ্টম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রচুর এফএম রেডিও শুনতাম। বর্তমানে পড়াশোনার ব্যস্ততার কারণে তেমন শোনা হয় না।

রেডিও এবিসি, রেডিও টুডে, ঢাকা এফএম, ক্যাপিটাল এফএম, রেডিও স্বাধীন, রেডিও ফুর্তি—এগুলোর প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানের সাপ্তাহিক সময়সূচি মুখস্থ ছিল। বিশেষ করে ভৌতিক ঘরানার অনুষ্ঠানের দারুণ ভক্ত আমি। যেমন রেডিও এবিসির ‘ডর’, ক্যাপিটাল এফএমের ‘তাবিজ’, রেডিও ফুর্তির ‘ভূত এফএম’।

তখন নবম শ্রেণিতে পড়ি। সেদিন শুক্রবার, রাত ১২টায় রেডিও ফুর্তি থেকে ভূত এফএম প্রচারিত হবে। এলাকার এক বন্ধু মুরসালীনকে সেদিন বললাম, ‘আজ রাতে যথাসময়ে আমার বাসায় চলে আসিস, আজ দুজন একসঙ্গে ভূত এফএম শুনব।’ মুরসালীন নিজেও এফএমের ভক্ত। আমরা প্রতিটি অনুষ্ঠান শুনে সেটা নিয়ে আলাপ করতাম। তো সেদিন রাত ১১টার দিকেই ও চলে এল।

আমরা রুমের মধ্যে একটা আবহ তৈরি করে নিলাম, যাতে শুনতে শুনতে ভয়ের স্বাদটা ভালোভাবে নেওয়া যায়। জানালা খুলে রাখলাম, ঘর অন্ধকার করে নিলাম। এ ছাড়া আরও অন্য ছোটখাটো আয়োজন সম্পন্ন করে ১২টা বাজার অপেক্ষায় বসে রইলাম। তারপর এল সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত—রাত ১২টা। আমাদের ভূত এফএম শোনা শুরু হলো। বেশ রোমাঞ্চকর একটা অনুভূতি নিয়ে শুনতে লাগলাম। মাঝেমধ্যে অদ্ভুত শব্দ করে আমরা একে অপরকে ভয় আরও বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। অনুষ্ঠানের সময় ছিল দুই ঘণ্টা। সে অনুযায়ী রাত দুইটায় অনুষ্ঠানটি শেষ হলো।

কিছুক্ষণ পর মাথায় বেশ মজার একটা আইডিয়া এসে গেল। বন্ধুকে বললাম, চল, ঘরের বাইরে যাই। গিয়ে ভূতের অভিনয় করি। ও খুব এক্সাইটেড হয়ে রাজি হয়ে গেল।

চলে গেলাম বাইরে। সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে আমাদের ঘরের সামনে তিনটা বড় বেলগাছ আর নারকেলগাছ রয়েছে। তারপর বড় একখণ্ড আবাদি জমি। জমির পাশে লম্বা একটা রাস্তা। রাস্তার শেষ মাথায় বাড়ির প্রধান ফটক।

ওকে বললাম, ‘অভিনয় দুইটা পর্বে হবে। প্রথম পর্বে আমি ভূত হব, তুই হবি একজন পথচারী। ধর, তুই এই গ্রামের বাসিন্দা, গভীর রাতে গ্রামের হাট থেকে বাড়ি ফিরছিস। হাট পেরিয়ে ফেরার সময় এই বেলগাছের পাশ দিয়ে যখন যেতে থাকবি, ঠিক তখনই আমি “এইইই...!” বলে গম্ভীরভাবে আওয়াজ করব। তারপর তুই ভ্যাবাচেকা খেয়ে দাঁড়িয়ে যাবি। ভয়ে শুকনো গলায় বলবি, “কে?” তখন আমি মুখটাকে ভয়ংকর বানিয়ে অট্টহাসি দিয়ে তোর সামনে দাঁড়িয়ে যাব। তারপর সামান্য কিছু কথোপকথন হবে আমাদের। সেই সংলাপগুলো তাৎক্ষণিকভাবে মাথায় এসে যাবে। যাহোক, তারপর তুই যখন দেখবি যে আমি তোকে মেরে ফেলার জন্য ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসছি, তখন তুই ঝেড়ে উল্টো দিকে দৌড় দিবি।’

এই ছিল আমাদের স্ক্রিপ্ট। তারপর আমাদের অভিনয় শুরু হলো। আমি যথারীতি বেলগাছটার আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম। একপর্যায়ে মুরসালীন আমার ভয়ংকর উপস্থিতি ও আগ্রাসী মনোভাব দেখে সামনের রাস্তা বরাবর দিল এক ভোঁ দৌড়। ওকে ধাওয়া করতে করতে একদম রাস্তার শেষ প্রান্তে গিয়ে প্রধান ফটকের সামনে থামলাম। ওকে আক্রমণ করলাম। ও সুন্দরভাবে মরে যাওয়ার অভিনয়টা সেরে ফেলল।

ওই সময় জমিতে পাট বোনা হয়েছিল। আশপাশের ছোট ছোট জমিতেও জঙ্গল গজিয়েছিল। ওখানে কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর হুট করে ওকে প্রধান ফটকের ওখানে ফেলে রেখে আমি একা একাই দৌড়ে চলে আসতে লাগলাম বাসার দিকে। পেছন ফিরে দেখি, সে-ও আমার পেছন পেছন দৌড়ে আসছে।

তারপর দ্বিতীয় পর্ব শুরু হলো। এবার ও হলো ভূত আর আমি হলাম গ্রামের সাধারণ পথচারী। তারপর একই কাহিনি ঘটল। মুরসালীন বেশ ভালোভাবেই ভূতের চরিত্রটা ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিল। ওর অদ্ভুত, চিকন হাসি শুনে আর আগ্রাসী আচরণ দেখে আমি সত্যি সত্যিই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। দৌড় দেওয়ার মাঝপথে আমি হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার অভিনয় করেছিলাম। সে দৃশ্যটাও বেশ শোভা বাড়িয়েছিল! এরপর ওর হাতে আমার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যবনিকাপাত হলো দ্বিতীয় পর্বের।

এরপর আমরা দুই বন্ধু বাইরে কিছুক্ষণ বসে শ্রাবণের রাতের ঝিরিঝিরি বাতাসে হাওয়া খেতে খেতে আড্ডা দিলাম। নামকরা কয়েকটা হরর মুভি নিয়ে আলাপ করলাম। রাত প্রায় চারটায় আমরা রুমে ফিরে ঘুমিয়ে পড়লাম।

এখন পড়াশোনার চাপে এফএম শোনার সময় পাই না। আবার ভূত এফএমও বন্ধ হয়ে গেছে বেশ আগে। তবু শ্রাবণ-ভাদ্র মাসের রাতের আবহাওয়া সেই দিনগুলো যেন ফিরিয়ে আনে।

  • হাসিবুল ইসলাম, প্রথম বর্ষ, ইংরেজি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়