সাফ চ্যাম্পিয়ন নারী ফুটবল দলে আছেন রাঙামাটির একটা বিদ্যালয়ের পাঁচ খেলোয়াড়। তাঁরা হলেন মনিকা চাকমা, রুপনা চাকমা, ঋতুপর্ণা চাকমা, আনুচিং মগিনি ও আনাই মগিনি। এর মধ্যে রুপনা চাকমা এখনো এই ঘাগড়া (বহুমুখী) উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রী, এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবে।
প্রথম আলোর ২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গড়ে তোলা নারী ফুটবল তহবিল থেকে গতকাল রোববার ঘাগড়া উচ্চবিদ্যালয়কে দুই লাখ টাকার চেক দেওয়া হয়। প্রধান শিক্ষক চন্দ্রা দেওয়ানের হাতে গতকাল দুপুরে এ চেক তুলে দেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক।
এর আগে কয়েকজন হৃদয়বান ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় এ তহবিল গড়ে তোলা হয়। এ তহবিল থেকে নারী ফুটবলের উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকে দেওয়া হয়েছিল ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। আর সাফ চ্যাম্পিয়ন দলের ৩০ সদস্যের প্রত্যেককে দেওয়া হয়েছিল এক লাখ টাকা করে। গত ১০ নভেম্বর প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সুধী সমাবেশে ওই চেক হস্তান্তর করা হয়েছিল।
‘নারী ফুটবল দলের জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা অনুদানের কথা শুনে আমি খুবই আনন্দিত হয়েছি। আমি আশা রাখব, সেই টাকা নারী ফুটবলের পেছনে খরচ করলে তারা আরও এগিয়ে যাবে।’শান্তিমণি চাকমা, ঘাগড়া উচ্চবিদ্যালয়ের নারী ফুটবল দলের প্রশিক্ষক
বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার দুর্গম বলিপাড়া গ্রাম থেকে বড় ফুটবলার হওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে তিন বছর আগে ঘাগড়া উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে দিপা চাকমা। ছোটবেলা থেকে ফুটবল খেলা ছিল তার বেশ প্রিয়। সে জন্য লেখাপড়ার পাশাপাশি গ্রামে সুযোগ পেলে ফুটবল খেলত। তার মতো কিশোরী ফুটবলারদের প্রত্যাশা পূরণে আরও উৎসাহ বাড়িয়ে দিয়েছেন সাফজয়ী বাংলাদেশ দলে খেলা ঘাগড়া উচ্চবিদ্যালয়ের পাঁচ তারকা খেলোয়াড়।
শুধু দিপা চাকমা নয়, একই গ্রামের কনকচাপা চাকমা, রাঙামাটি জেলার কাউখালী উপজেলার দুর্গম বটতলী গ্রামের মেক্রাউ মারমা, বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের বাঘাইহাট গ্রামের রিতা চাকমাসহ অন্তত ৩০ পাহাড়ি শিশু-কিশোরী দুর্গম গ্রাম থেকে বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন পূরণের পেছনে ছুটছে। তারা সবাই ঘাগড়া উচ্চবিদ্যালয়ের জয়িতা ছাত্রীনিবাসে থাকে, লেখাপড়ার পাশাপাশি করে ফুটবলের অনুশীলন।
গতকাল সকাল সাড়ে নয়টা থেকে ঘাগড়া উচ্চবিদ্যালয় ফটকে ফুল হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন নারী ফুটবলার ও শিক্ষকেরা। আনিসুল হক এসে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। পরে সুমা চাকমার গানের সঙ্গে সবাই সুর মিলিয়ে একটি চাকমা গান পরিবেশন করেন। নারী ফুটবলাররা মাঠে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ আয়োজন করেন। প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক নারী ফুটবল উন্নয়ন তহবিল থেকে দেওয়া দুই লাখ টাকা শুধু নারী ফুটবলের উন্নয়নের জন্য ব্যয় করার আহ্বান জানান।
বিদ্যালয়ের নারী ফুটবলারদের নানা সমস্যা রয়েছে। তারপরও তাদের খাওয়া-থাকা ও অনুশীলনে যেন অসুবিধা না হয়, সে জন্য বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সব সময় সতর্ক। ঘাগড়া উচ্চবিদ্যালয় জাতীয়ভাবে অবদান রাখছে। তাই তাঁদের একটাই দাবি, বিদ্যালয়টি যেন জাতীয়করণ করা হয়।চন্দ্রা দেওয়ান, প্রধান শিক্ষক
২০১১ সালে বঙ্গমাতা ফুটবল খেলার সময় মনিকা চাকমা, আনাই মগিনি, আনুচিং মগিনিসহ ১০ থেকে ১৫ জনকে বাছাই করা হয়েছিল। সে বছর জাতীয়ভাবে চ্যাম্পিয়ন হয় মনিকা চাকমাদের দলটি। ২০১৪ সালে ঋতুর্পণা চাকমা, রুপনা চাকমাসহ আরও বেশ কয়েকজন যোগ দেন। তাঁদের খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটি জেলার বিভিন্ন দুর্গম এলাকা থেকে নিয়ে আসা হয়। সবাইকে ঘাগড়া ইউনিয়নের মগাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেওয়া হয়। তাঁদের প্রশিক্ষণের জন্য কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় শান্তিমণি চাকমাকে।
তৎকালীন মগাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বীরসেন চাকমার আর্থিক সহায়তা ও তত্ত্বাবধানে প্রতিদিন তাঁদের অনুশীলন চলত। ২০১৫ সালে তাঁদের দলকে ঘাগড়া বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে স্কুল-মাদ্রাসা গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয় মনিকাদের দলটি।
ঘাগড়া উচ্চবিদ্যালয়ের নারী ফুটবল দলের প্রশিক্ষক শান্তিমণি চাকমা বলেন, ‘নারী ফুটবল দলের জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা অনুদানের কথা শুনে আমি খুবই আনন্দিত হয়েছি। আমি আশা রাখব, সেই টাকা নারী ফুটবলের পেছনে খরচ করলে তারা আরও এগিয়ে যাবে।’
প্রধান শিক্ষক চন্দ্রা দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যালয়ের নারী ফুটবলারদের নানা সমস্যা রয়েছে। তারপরও তাদের খাওয়া-থাকা ও অনুশীলনে যেন অসুবিধা না হয়, সে জন্য বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সব সময় সতর্ক। ঘাগড়া উচ্চবিদ্যালয় জাতীয়ভাবে অবদান রাখছে। তাই তাঁদের একটাই দাবি, বিদ্যালয়টি যেন জাতীয়করণ করা হয়।
মনিকা চাকমাসহ সাফ চ্যাম্পিয়ন দলের পাঁচ খেলোয়াড়ও ঘাগড়া উচ্চবিদ্যালয়কে জাতীয়করণের দাবির কথা একাধিকবার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তুলে ধরেছেন। আনিসুল হকও তাঁদের এ দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন।