ভারতে ফেসবুকের মাধ্যমে বিদ্বেষমূলক বার্তা ছড়ানো হয়। আবার হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি চরমপন্থীদের সহিংসতায় উসকানি দেওয়া হয়। এসব রুখতে এ দুই মাধ্যমের মূল প্রতিষ্ঠান মেটার পদক্ষেপ যথাযথ ছিল না। এভাবে আরও কিছু দেশে মেটা মানবাধিকারের ক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে ব্যবসাকে প্রাধান্য দিয়েছে।
শুধু মেটা নয়, বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের শীর্ষ কোম্পানিগুলোর কোনোটিই স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, মানবাধিকার ও জনস্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে ভালো করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক র্যাঙ্কিং ডিজিটাল রাইটসের (আরডিআর) সূচকে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত মে মাসে আরডিআর ‘দ্য ২০২২ বিগ টেক স্কোরকার্ড’ নামের সূচকটি প্রকাশ করে।
তিনটি বিষয়ের আলোকে ১৪টি তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিকে মূল্যায়ন করেছে আরডিআর। বিষয় তিনটি হলো পরিচালনপ্রক্রিয়া, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গোপনীয়তা। আরডিআর বলছে, এ ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর কোনোটি ষষ্ঠবারের মতো কৃতকার্য হওয়ার নম্বর (পাসিং গ্রেড) অর্জন করতে পারেনি। তবে কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটু ভালো অবস্থানে আছে টুইটার।
সূচকে ৫৬ শতাংশ স্কোর নিয়ে শীর্ষস্থানে আছে টুইটার। এরপর আছে ইয়াহু ৫৪, মাইক্রোসফট ৫০, গুগল ৪৭, মেটা ৪৬, অ্যাপল ৪৪, কাকাও ৪৪, ইয়ানডেক্স ৩৫, বাইদু ২৮, ভিকে ২৮, আলিবাবা ২৬, স্যামসাং ২৬, অ্যামাজন ২৫ ও টেনসেন্ট ২৫ শতাংশ।
সূচকে পরিচালনপ্রক্রিয়ার দিক থেকে শীর্ষে মেটা। তারপর মাইক্রোসফট, ইয়াহু, গুগল ও টুইটার। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দিক থেকে শীর্ষে টুইটার। তারপর গুগল, মাইক্রোসফট, কাকাও ও মেটা। গোপনীয়তা রক্ষায় শীর্ষে ইয়াহু। তারপর অ্যাপল, টুইটার, মাইক্রোসফট, গুগল ও মেটা।
চিন্তানপ্রতিষ্ঠান নিউ আমেরিকার স্বাধীন ও অলাভজনক গবেষণা প্রোগ্রাম আরডিআর। তারা ইন্টারনেটে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গোপনীয়তা রক্ষা নিয়ে কাজ করে। এবার তারা ষষ্ঠবারের মতো সূচক প্রকাশ করল।
আরডিআর বলছে, বিগ টেক স্কোরকার্ডে প্রতিটি কোম্পানি সন্তোষজনক স্কোর অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। কোম্পানিগুলো কীভাবে মানবাধিকারের চর্চা করে, অনলাইন বিষয়বস্তু পরিমিত করে, যাচাই-বাছাই করে, অ্যালগরিদম পদ্ধতি কীভাবে কাজ করে, মানুষের ব্যক্তিগত উপাত্ত ব্যবহার করে, সে সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
আরডিআর বলছে, বিশ্বের অনেক প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী শাসন, ইউক্রেনে রুশ হামলার মধ্যেও বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো যথারীতি ব্যবসা করে যাচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বের বাইরে বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো প্রকৃত মানবাধিকার, নজরদারিভিত্তিক বিজ্ঞাপনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে অবহেলা করছে। কোম্পানিগুলোকে মানবাধিকারের বাধ্যবাধকতা পূরণে এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ডিজিটাল মাধ্যম নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। আরোপ করছে বিধিনিষেধ। একই পথে হাঁটছে বাংলাদেশও। সরকার উপাত্ত সুরক্ষা আইন ২০২২; রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ২০২১; ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্টভিত্তিক সেবা প্রদান ও পরিচালনা নীতিমালা ২০২১’ করতে যাচ্ছে। তিনটিই এখন খসড়া পর্যায়ে আছে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ এগুলো চূড়ান্ত হতে পারে।
সূচকে টুইটার পরিচালনপ্রক্রিয়ায় ৫৬, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় ৬৪ ও গোপনীয়তায় ৫১ শতাংশ স্কোর করেছে। টুইটার সম্পর্কে আরডিআর বলেছে, ব্যবহারকারীর উপাত্ত বেহাত হলে তা জানানো, তার প্রভাব সম্পর্কে ব্যবহারকারীকে অবহিত করার বিষয়ে তারা কোনো তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে। টুইটারে বিজ্ঞাপননীতি আরও স্বচ্ছ করা প্রয়োজন। তাদের মানবাধিকারের প্রভাব মূল্যায়ন করা উচিত।
ইয়াহু পরিচালনপ্রক্রিয়ায় ৫৯, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় ৩১ ও গোপনীয়তায় ৫৯ শতাংশ স্কোর করেছে। ইয়াহু সম্পর্কে বলা হয়েছে, আগের তুলনায় মানবাধিকারের প্রতি ইয়াহুর প্রতিশ্রুতি দুর্বল দেখা গেছে। ইয়াহুকে মানবাধিকারের বিষয়গুলো আরও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখার সুপারিশ করা হয়েছে।
মাইক্রোসফট পরিচালনপ্রক্রিয়ায় ৬৫, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় ৪২ ও গোপনীয়তায় ৪৯ শতাংশ স্কোর করেছে। মাইক্রোসফটকে ব্যবহারকারীদের আরও নিয়ন্ত্রণ দেওয়ার সুপারিশ করেছে আরডিআর। ব্যবহারকারীদের উপাত্ত কীভাবে সংগ্রহ ও ব্যবহার করা হয়, সে সম্পর্কে মাইক্রোসফটের আরও তথ্য প্রকাশ করা উচিত বলে মত আরডিআরের।
গুগল পরিচালনপ্রক্রিয়া ৫৬, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় ৪৪ ও গোপনীয়তায় ৪৬ শতাংশ স্কোর করেছে। কোম্পানিটি সম্পর্কে বলা হয়েছে, গুগল তার নিজস্ব নীতির প্রয়োগ, অ্যালগরিদমের পদ্ধতি, বিজ্ঞাপননীতি ও মানবাধিকারসংক্রান্ত প্রভাব মূল্যায়ন করেছে—এমন কোনো প্রমাণ দেয়নি। সরকারি সেন্সরশিপের চাহিদার বিষয়ে গুগল বেশ কঠোর নীতি অনুসরণ করলেও গোপনে কোনো কিছু দাবি করলে সেখানে তারা কীভাবে সাড়া দেয়, সে বিষয়ে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। কোনো উপাত্ত বেহাত হলে তা মোকাবিলার জন্য গুগল কোনো নীতি প্রকাশ করেনি। অ্যালগরিদম তৈরি ও তা ব্যবহারে মানবাধিকার সমুন্নত রাখার প্রতিশ্রুতি প্রকাশের জন্য গুগলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আরডিআর।
মেটা পরিচালনপ্রক্রিয়ায় ৬৫, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় ৩৬ ও গোপনীয়তায় ৪৬ শতাংশ স্কোর করেছে। কোম্পানিটির বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ, তারা প্রায়ই যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে নিজস্ব নীতি মেনে চলে না। আরডিআর বলেছে, মেটাকে গত এক বছর নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। মূল কোম্পানি ফেসবুক থেকে মেটা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির সাবেক কর্মী গুরুত্বপূর্ণ নথি ফাঁস করেছেন। বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রসমর্থিত প্রচারণা, ঘৃণ্য বক্তব্য ও সহিংসতার জন্য উসকানিমূলক বার্তা প্রচারের জন্য মেটাকে সমালোচিত হতে হয়েছে। মেটা পরিষেবা প্রয়োগের শর্তাবলি, ব্যবহারকারীকে লক্ষ্য করে বিজ্ঞাপননীতি, অ্যালগরিদমের পদ্ধতি, শূন্য রেটিং প্রোগ্রামসহ মানবাধিকার প্রভাব মূল্যায়নের প্রমাণ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা শুধু ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের স্বচ্ছতার প্রতিবেদন করে। মেটা কীভাবে ব্যবহারকারীর উপাত্ত ব্যবহার করে, সে সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায় না। ব্যবহারকারীর উপাত্ত কেনা, শেয়ারিং চুক্তি ও তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে অন্যান্য চুক্তির মাধ্যমে ব্যবহারকারীর উপাত্ত তারা কীভাবে অর্জন করে, তা প্রক্রিয়া করে বর্ণনা করতে প্রতিষ্ঠানটি ব্যর্থ হয়েছে। কিছু দেশে মেটা মানবাধিকার ও গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে নিজেদের ব্যবসাকে প্রাধান্য দিয়েছে। মেটার ক্ষেত্রে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিভিন্ন দেশের সরকারের সেন্সরশিপের চাহিদার বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে আরও স্বচ্ছ হতে হবে। ব্যবহারকারীর উপাত্ত ব্যবহারেও স্বচ্ছতা প্রয়োজন।
ডিজিটাল জগতে মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক মো. সাইমুম রেজা তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের প্রস্তাব অনুযায়ী, অফলাইনে প্রযোজ্য মানবাধিকারের সব মূলনীতি অনলাইনেও নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু আরডিআরের সূচক অনুযায়ী, বিশ্বের ১৪টি প্রভাবশালী তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানির একটিও কৃতকার্য হওয়ার মতো নম্বর পায়নি। যার অর্থ, তারা মানবাধিকারের সব মূলনীতি এখনো নিজেদের প্ল্যাটফর্মে নিশ্চিত করে না।
বিভিন্ন দেশে ভিন্নমত দমন ও বিদ্বেষমূলক বার্তা ছড়ানোর জন্য টেক জায়ান্টদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন সাইমুম রেজা তালুকদার। তিনি বলেন, টেক জায়ান্টগুলোর এই অস্বচ্ছতা, মানবাধিকারের ওপর ব্যবসায়িক লাভকে প্রাধান্য দেওয়ার মনোভাবের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন দেশে অগণতান্ত্রিক-স্বৈরতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠী জনগণের মৌলিক মানবাধিকার খর্ব করছে। মানবাধিকার রক্ষায় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন।
সাইমুম রেজা তালুকদার বলেন, ‘বাক্স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সূচকে বাংলাদেশের দিকে তাকালে বলা যায়, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো যে এখানকার জনগণের মৌলিক অধিকার খর্ব করার জন্য ব্যবহৃত হবে না—এমন নিশ্চয়তা কে দেবে?’