মুক্তিবাহিনী নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের ভাবনা

দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম: নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড আ ফরগটেন জেনোসাইড মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির পলিটিকস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের অধ্যাপক এবং পুলিৎজার বিজয়ী গবেষক গ্যারি জে ব্যাসের বই। বইটি মুক্তিবাহিনীবিষয়ক অধ্যায়ের এটি আংশিক অনুবাদ। অনুবাদ করেছেন মো. আবু হুরাইরাহ্।

গ্যারি জে ব্যাস

১৯৭১ সালের জুলাই মাসের মধ্যে মুক্তিবাহিনী দাবি করে, তারা ১৫ হাজারের মতো পাকিস্তানি সেনাকে মেরে ফেলেছে। সেই সঙ্গে সেনাদের মনোবল এমনভাবে ভেঙে দিয়েছে যে সন্ধ্যার পর নিজেদের শিবির থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছিলেন তাঁরা। ইসলামাবাদে ভারতীয় মিশন এ বিষয়ে সন্তুষ্টির সঙ্গে উল্লেখ করে, জোরালো আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাদের ব্যাপক ক্ষতি, পরিবহন ও জ্বালানি সরবরাহব্যবস্থা বিপর্যস্ত এবং ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারের মনোবল নষ্ট হয়েছে।

পূর্ব পাকিস্তানে সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে, প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া জুলাইয়ের শেষ দিকে ঢাকা সফরের আশা করেছিলেন। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর হুমকিতে তা বাতিল করতে বাধ্য হন। গান্ধী প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, ‘ইতিহাস এটাই দেখায় যে স্বাধীনতার জন্য এমন লড়াইয়ে বাধা আসতে পারে, কিন্তু সব সময়ই তা জয়ী হয়।’

কিন্তু প্রকৃত অবস্থা ছিল সমস্যাপূর্ণ। প্রভাবশালী ভারতীয় কর্মকর্তা পি এন হাকসার আশা করেছিলেন, আওয়ামী লীগাররা আরও দূরদৃষ্টি, খোলাখুলি মনোভাব ও সাংগঠনিক বিচক্ষণতা দেখাবেন। বিদ্রোহের পরিকল্পনাগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে হাকসার বলেন, তাঁদের আরও ভালো এবং আরও ব্যাপকভিত্তিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রয়োজন।

মুক্তিযুদ্ধ ছিল সর্বাত্মক জনযুদ্ধ। যুদ্ধের অবকাশে ঢাকার দোহারে মুক্তিযোদ্ধারা, ১৯৭১

ভারতীয় ও বাঙালি সেনা এবং রাজনৈতিক নেতারা প্রকাশ্যে তুমুল বিতর্কে জড়াতেন। একজন ভারতীয় মন্ত্রী সতর্ক করে বলেন, ‘আমাদের বন্ধুদের মনমানসিকতা আমাদের থেকে এরই মধ্যে আলাদা হতে শুরু করেছে।’ ভারতীয় কর্মী জয়প্রকাশ নারায়ণ ‘বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার সদস্য ও মুক্তিফৌজদের সঙ্গে আমাদের বড় ভাইসুলভ আচরণের বিপদ’ সম্পর্কে ইন্দিরা গান্ধীকে সতর্ক করেন।

তিনি বলেন, ‘আমাদের কর্মকর্তাদের শ্রেষ্ঠত্বের ভান করাটা কোনো সামান্যতম গুণও না।’ তিনি আরও বলেন, ‘দক্ষিণ ভিয়েতনামে আমেরিকানরা যে আচরণ করেছে, আমাদের তা থেকে শিক্ষা নেওয়া দরকার। ওই খারাপ আমেরিকানদের কথা আপনার মনে আছে?’

ভারতীয় ও বাঙালি উভয় নেতারা জানতেন, দক্ষ স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহীরা সামরিক দিক থেকে গুরুতর সমস্যায় রয়েছেন। এর অনিবার্য ফল হলো, এই যুদ্ধে ভারতীয় সেনাদের আরও প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত হতে হবে। হোঁচট খেয়ে চলা বিদ্রোহ ইন্দিরা গান্ধীর ওপর এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীকে অগ্রসর হওয়ার ব্যাপারে চাপ বাড়িয়ে তোলে।

স্বাধীনতাকামীরা সংখ্যায় অনেক ছাড়িয়ে যায়; তাঁদের অনেকের কাছে ছিল শুধু ছুরি ও হ্যান্ড গ্রেনেড; তাঁরা পাকিস্তানি সেনা ইউনিটের ওপর আক্রমণ চালাতে আগ্রহী ছিলেন না। এমনকি তুলনামূলকভাবে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বিদ্রোহীরাও পাকিস্তানের কামানবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সঙ্গে ছিলেন বেমানান। নিজেদের ভারী বা ট্যাংকবিধ্বংসী কামান না থাকায় এই স্বাধীনতাকামীদের পাকিস্তানি সেনাদের উত্কৃষ্টতর অস্ত্র শক্তির কাছে পিছু হটতে হয়। তাঁরা ভারতীয় সেনাদের সমর্থন চাইছিলেন, কিন্তু যথেষ্ট পাচ্ছিলেন না।

নারায়ণ যুক্তি দেন, সুপ্রশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে বিশৃঙ্খল গেরিলাদের সাফল্য পাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না, ‘তাঁদের সহায়তা করতে কাউকে এগিয়ে আসতে হয়েছে।’
পাকিস্তানের সঙ্গে সশস্ত্র লড়াই করতে গিয়ে অনেক সময় ধরা পড়ছিলেন বিদ্রোহীরা। তাঁরা মরিয়াভাবে ভারত থেকে আরও অস্ত্র ও গোলাবারুদ চান। বিদ্রোহী কর্মকর্তারা ভারী কামান, বিমান–বিধ্বংসী গোলা ও ট্যাংক–বিধ্বংসী গ্রেনেডের অনুরোধ জানান।

তাঁদের সবকিছুরই দরকার ছিল: বন্দুক, মর্টার, ওয়াকিটকি, যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের উপযোগী টেলিফোন সেট, মানচিত্র, হাতখরচ (দুর্নীতি-অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া এড়াতে), চিকিত্সাসামগ্রী, বাইনোকুলার। কিন্তু যুদ্ধকালে ভারতীয় অস্ত্রশস্ত্র ধরা পড়লে তাতে অনিবার্যভাবে যে বিরূপ অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে, তা নিয়ে ভারতকে দৃশ্যত চিন্তিত মনে হয়েছে।

এদিকে বাঙালি স্বাধীনতাকামীদের ভারতের তত্ত্বাবধানে থাকার বিষয়ে বিরক্তি ছিল। যুদ্ধ নিয়ে উদ্বেগজনক এক পর্যালোচনায় আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী ভারতের সেনাবাহিনীর কার্যকলাপে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে লেখেন, ‘মুক্তিফৌজ যেভাবে অবহেলিত হয়েছে, ওই রকম অবহেলার শিকার কোনো সাহসী বাহিনীকে কখনো হতে হয়নি।’

বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আরও প্রশিক্ষণশিবির ও অস্ত্রশস্ত্র চাইত। পাকিস্তানি সাঁজোয়া বহরের বিরুদ্ধে লড়াই করতে যাওয়া স্বাধীনতাকামীরা দিনে পেতেন ১০টি করে গুলি, যা ‘জঙ্গলে যাওয়া কোনো অপেশাদার শিকারির’ জন্যও যথেষ্ট নয়। অভিযানে যাওয়ার জন্য গোলাবারুদ পেতে কয়েক দিন ধরে অপেক্ষা করতেন কর্মকর্তারা।

জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ছিল না যথেষ্ট অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রত্যেকেরই ছিল অভাব—রেশন, পোশাক, পাকিস্তানি মুদ্রা (পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অভিযান পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয়), তাঁবু, সাবান, সিগারেট ও জুতার অভাব। মিজানুর রহমান চৌধুরী লেখেন, ‘নিজেদের অসুস্থ সহকর্মীদের জন্য ওষুধ জোগাড় করতে আমি সেক্টর কমান্ডারদের ভিক্ষুকের মতো বিভিন্ন মানুষের কাছে ধরনা দিতে দেখেছি।’

ভারতের সামরিক লক্ষ্য

এর মূলে ছিল ভারতীয় ও বাংলাদেশিদের লক্ষ্যের পার্থক্য। যেখানে নভেম্বর পর্যন্ত ভারত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না এবং স্বাধীনতাকামীদের সহায়তা করা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল; সেখানে বাঙালিরা দেশের স্বাধীনতার জন্য পুরোদমে যুদ্ধ চাইছিল। যুক্তিসংগত কারণে অনেক বাঙালি ভেবেছিলেন, হয়তো ভারত সারা পূর্ব পাকিস্তানে আক্রমণের ঝুঁকি নেওয়ার বদলে পূর্ব পাকিস্তানের একটা অংশকে শুধু বিচ্ছিন্ন করতে এবং সেখানে একটা বাংলাদেশি সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। মুক্তিফৌজ ভারতকে ধাপে ধাপে তাদের যুদ্ধের আরও গভীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।

মে মাসের শেষ দিকে মেজর জেনারেল জ্যাকব-ফার্জ-রাফায়েল জ্যাকব পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ভারতের একটি যুদ্ধ পরিকল্পনা তৈরি করেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল কে কে সিংও সাহসিকতার সঙ্গে সামরিক নকশার খসড়া তৈরি করে ফেলেন। কখন নির্দেশ আসে, সেই অপেক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে সেনাবাহিনী জুলাই নাগাদ অস্ত্রশস্ত্র, রসদ, গোলাবারুদ ও অন্যান্য সরঞ্জাম ধীরে ধীরে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো শুরু করে। আগস্টের শুরুতে, জেনারেল স্যাম মানেকশ ও তাঁর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা তাঁদের আক্রমণের বিভিন্ন বিকল্প নিয়ে গোপনে বিতর্ক শুরু করেন এবং বিস্তারিত যুদ্ধকৌশল তৈরি করতে থাকেন। স্পেশাল সার্ভিস ব্যুরো বড় রকমের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়, সীমান্তজুড়ে ফাঁড়ি স্থাপন করতে থাকে এবং ‘পাল্টা নাশকতা ও পাল্টা গুপ্তচরবৃত্তিমূলক পদক্ষেপ’নেওয়া শুরু করে।

জুলাইয়ের মাঝামাঝি ভারত সরকার এই সিদ্ধান্তে আসে যে শরণার্থীদের দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে পাকিস্তান যদি একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমঝোতায় আসতে না পারে, তবে ভারতকে ক্রমশ যুদ্ধের পথে এগোতে হবে। সরকারের শীর্ষস্থানীয় ও তীক্ষ্ণ� দৃষ্টিসম্পন্ন কূটনীতিক ডি পি ধর স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, যদি বাঙালি বিদ্রোহীরা ‘আমাদের দেশের ভেতর তাঁদের সীমান্তবর্তী এলাকায় আশ্রয় লাভের নিশ্চয়তা পেয়ে আরও দক্ষতার সঙ্গে লড়াই শুরু করে, তবে পরিস্থিতি পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর দিকে ঠেলে দেবে, সেই সম্ভাবনা খুবই থাকবে। এ রকম সম্ভাবনা দেখা দিলে আমাদের অকারণে ভয় পাওয়ার দরকার নেই। এ পরিস্থিতিতে যুদ্ধ যদি বেধেই যায়, তবে আপত্তি নেই। যুদ্ধ বাধুক, আমাদের তা এড়ানো উচিত হবে না।’

প্রবাসী সরকারের ভাবনা

প্রবাসী বাংলাদেশি সরকার পুরোনো ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মূল শক্তিকে ঘিরে একটা নিয়মিত সেনা ডিভিশন গঠন করার চেষ্টা করে। জুলাইয়ে এই অনিয়মিত ও প্রারম্ভিক পর্যায়ের সেনাদের ওপর ভরসা করে প্রতিষ্ঠা করা হয় একটি একক কমান্ড সদর দপ্তর; যাদের এখন বাংলাদেশ ফোর্সেস নামে ডাকা হয়। এই বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ হন এম এ জি ওসমানী। বাংলাদেশ ফোর্সেসের অধীন পরিচালিত হয়ে স্বাধীনতাকামীরা একটা যুদ্ধপরিকল্পনা হাতে পান। কীভাবে বিদ্রোহ চালিয়ে যেতে হবে, তা এই পরিকল্পনায় উঠে আসে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, ওসমানীর কর্মকর্তারা সব গেরিলাকে তাঁদের কমান্ডের অধীনে নিয়ে আসেন। সাতজন স্বাধীনতাকামী ও একজন অফিসারের সমন্বয়ে এক-একটি সেলে সংগঠিত করা হয় এই যোদ্ধাদের, যার তদারকিতে ছিলেন একজন করে রাজনৈতিক উপদেষ্টা। তাঁরা আশা করেছিলেন, তাঁদের পিস্তল, রাইফেল, ছোট সাব-মেশিনগান বা হালকা মেশিনগান এবং সঙ্গে গানবোট উড়িয়ে দিতে কিছু রকেট লঞ্চার, বাংকার ও গোলাবারুদের ভান্ডারে সজ্জিত করা হবে। বেসামরিক লোকজনের পোশাক লুঙ্গি ও কুর্তা পরে তাঁরা স্থানীয় মানুষের মধ্যে মিশে যান। পরিকল্পনায় ছিল, যেখানে সম্ভব হবে, সেখানে গেরিলারা তাঁদের বাড়ির কাছাকাছি লড়াই করবেন।

কমান্ডাররা চাইছিলেন, তাঁরা যেন ‘ধারাবাহিকভাবে বড় এলাকায় সুপরিকল্পিত ও জোরালো, প্রতিদিনই বেগবান হওয়া, গেরিলা আক্রমণ’ চালিয়ে যান, যার মধ্যে শত্রুপক্ষের এজেন্ট, তথ্যদাতা ও সহযোগীদের মেরে ফেলার বিষয়ও থাকবে। এটি ছিল এমন এক নিষ্ঠুর কাজ, যা খুব খারাপ কিছু ও নিপীড়নকেই ডেকে আনে। এ অবস্থায় বিদ্রোহীরা শুধু সেতু ও রেললাইন ধ্বংস করা নয়; বরং নদীবন্দর, শোধনাগার, বিদ্যুৎকেন্দ্র, পেট্রোলিয়াম ও তেলের গুদাম এবং বিমানঘাঁটিগুলোকে হামলার লক্ষ্যবস্তু বানান। কমান্ডাররা ধারণা করেছিলেন, এ পরিকল্পনা তাঁদের প্রত্যাশা অনুযায়ী পাকিস্তানিদের ‘রক্তপাত ঘটাবে ও অক্ষম’ করে তুলবে। তাতে বিদ্রোহীরা ‘শত্রুদের শেষ নিশ্বাসটুকু কেড়ে নিতে’ পারবেন। এরপর এই বিজয়ী অনিয়মিত বাহিনী ‘একটা গেরিলা বাহিনী থেকে জনগণের সেনাবাহিনীতে’ রূপান্তরিত হবে।

এই জোরালো পরিকল্পনার বিপরীতে বাস্তবতা ছিল বিশৃঙ্খলার। আর্চার ব্লাডের বন্ধু শহুদুল হক ত্রিপুরার একটি প্রশিক্ষণশিবিরে এক প্লাটুনের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গর্ব করলেও তিনি বলেন, ‘সর্বক্ষেত্রে আধাখেঁচড়া অবস্থা দেখে আমি খুবই হতাশ হই।’ তিনি বলেন, ‘নেই কোনো টাকাপয়সা, গোলাবারুদ, সাজসরঞ্জাম। আমাদের শেখানোর জন্য আছেন শুধু কিছু ত্যাগী সেনা।’ সেখানে কাঁঠাল ছাড়া অন্য কোনো খাবার ছিল না, যা আজও তিনি অপছন্দ করেন। বাঁশের তৈরি মঞ্চে ঘুমানোর সময় মৌসুমি ঝড়বৃষ্টিতে একরকম ভেসে যেতেন গেরিলারা।

বাংলাদেশি কমান্ডাররা, যাঁরা বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের দায়িত্বে থাকা ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন, তাঁরা তাঁদের দুঃখ-দুর্দশার কথা ভারতের সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে (বিএসএফ) জানান। ‘র’-এর প্রধান আর এন কাওয়ের কাছেও তাঁরা অভিযোগ করেন, গান্ধী সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত আসার পরও ইতিপূর্বে স্বাধীনতাকামীদের দেওয়া ভারতের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অরোরার সেনারা সহায়তা করছেন না। জবাবে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সতর্ক করে কাও বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের পাঠানো স্বেচ্ছাসেবকদের গেরিলা প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছুই করা হয়নি।’ তিনি সতর্ক করেন, ওসমানী ও অরোরার মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে এবং ‘বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে ভীষণ অতৃপ্তি, অসন্তোষ ও অবিশ্বাসের জন্ম নিয়েছে’।

কাও গান্ধীর সরকারকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী বাহিনীর মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। বাংলাদেশি দুই কর্মকর্তা কঠোরভাবে সতর্ক করেন, গুরুত্বপূর্ণ বর্ষা মৌসুমে ভারতের সমর্থন না বাড়লে এই গৃহযুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হবে এবং তা মানুষের দুর্দশা ডেকে আনবে। এটি আওয়ামী লীগকে উত্খাত করতে বিপ্লবীদের সহায়তা করবে, ‘সে ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট চীন বামপন্থী বিপ্লবীদের স্বার্থ হাসিলের বিষয় সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করতে পারে’।

দিল্লিতে এই প্রতিবেদনগুলো পড়ে হাকসার ও অন্যান্য নেতার কাছে এটা পরিষ্কার যে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রক্তপাত ঘটাতে এবং আড়াল থেকে ভারতের সমর্থন পেলে ভয়াবহ রকমের ক্ষতি করতে সক্ষম। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের বাংলাদেশ থেকে হটাতে হলে ভারতের আরও সরাসরি হস্তক্ষেপ দরকার।

সূত্র: দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম: নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড আ ফরগটেন জেনোসাইড, গ্যারি জে ব্যাস, ২০১৩

গ্যারি জে ব্যাস: অধ্যাপক, পলিটিকস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি; পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী।