‘জনশুমারি ও গৃহগণনা’ প্রকল্প

৪ লাখ ট্যাবের ভবিষ্যৎ কী

জনশুমারির জন্য ৪৪৭ কোটি টাকায় কেনা হয়েছিল ট্যাবগুলো। এখন এর ব্যবহারের উপায় খুঁজছে সরকার।

প্রতীকী ছবি

দেশজুড়ে ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষের তথ্য সংগ্রহ করতে কেনা প্রায় চার লাখ ট্যাবলেট পিসি (ট্যাব) নিয়ে বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা’ প্রকল্পের আওতায় ছয় মাস আগে এসব ট্যাব কেনা হয়েছিল। মানুষ গণনার কাজ বিদায়ী বছরের ১৫ জুন শুরু হয়ে ২১ জুন শেষ হয়েছে। এখন এই ট্যাবগুলোর ব্যবহার নেই। ঢাকার আগারগাঁওয়ে অবস্থিত পরিসংখ্যান ভবনে পড়ে আছে ট্যাবগুলো।

এখন বিপুল অঙ্কের টাকায় কেনা এসব ট্যাব কোথায় ব্যবহার করা যায়, সে উপায় খুঁজছে বিবিএস। তবে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছে না সরকারি এই সংস্থা। দীর্ঘদিন ব্যবহৃত না হওয়ায় ট্যাবগুলো নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে।

প্রায় ৪ লাখ ট্যাব কিনতে খরচ হয় ৪৪৭ কোটি টাকা। বিবিএসের কর্মকর্তারা চাইছেন, যত দ্রুত সম্ভব ট্যাবগুলো কোথাও ব্যবহারের ব্যবস্থা করা হোক।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্যাব কেনার পরিকল্পনার সময়ই ঠিক করা উচিত ছিল, জনশুমারির পর এগুলো কোথায় ব্যবহার করা হবে। এখানে পরিকল্পনায় গলদের বিষয়টি স্পষ্ট।

বিপুল অঙ্কের টাকায় কেনা এসব ট্যাব কেনার আগেই উচিত ছিল, পরে কী কাজে ব্যবহৃত হবে, তার উপায় বের করা। এখানে সরকারি কর্মকর্তাদের দক্ষতার ঘাটতি স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়।
ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি

ট্যাবগুলো কোন প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া যায়, তার ওপর মতামত দিতে গত ডিসেম্বরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতে চিঠি পাঠিয়েছে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ। ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানে ট্যাব বিতরণ করলে এর আইনগত ও পদ্ধতিগত দিক কী হতে পারে, তা খতিয়ে দেখতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত সব মন্ত্রণালয়ের মতামত পাওয়া যায়নি।

পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব শাহনাজ আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, ট্যাব বিতরণের আগে কিছু বিষয় দেখা হচ্ছে। এর আইনগত, বিধি ও পদ্ধতিগত দিকগুলো বিবেচনা করা হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে কোনো জটিলতা তৈরি না হয়। শিগগিরই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে।

স্বাধীনতার পর থেকে পাঁচবার জনশুমারির তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল কাগজে বা ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে। গত বছরের ১৫ থেকে ২১ জুন দেশজুড়ে পরিচালিত ষষ্ঠ জনশুমারিতে প্রথমবারের মতো ডিজিটাল পদ্ধতিতে ট্যাবের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ট্যাব ব্যবহার নিয়ে খোদ বিবিএসের মধ্যেই আলোচনা ছিল।

প্রাপ্ত নথি ঘেঁটে জানা যায়, বিবিএসের হাতে এখন মোট ট্যাব আছে ৪ লাখ ১০ হাজার, যার মধ্যে জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্পের আওতায় কেনা হয় ৩ লাখ ৯৫ হাজার। দেশীয় প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন ট্যাব সরবরাহ করেছে, যার ওয়ারেন্টি পিরিয়ড দুই বছর। বাকি ১৫ হাজার কেনা হয় অন্য প্রকল্পের আওতায়।

ভবিষ্যতে কোনো জরিপ ও শুমারির কাজে ট্যাব ব্যবহারের চাহিদা চেয়ে গত অক্টোবরে বিবিএসের মাঠপর্যায়ের অফিস ও ঢাকা কার্যালয়ের বিভিন্ন শাখায় চিঠি দেন সংস্থাটির মহাপরিচালক মতিয়ার রহমান।

ওই চিঠি পাওয়ার পর ‘অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৩’ পরিচালনার জন্য ১ লাখ ৪০ হাজার ট্যাবের চাহিদা পাওয়া যায়। তবে বিবিএসের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, এ বছরের মধ্যে অর্থনৈতিক শুমারি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ফলে এ প্রকল্পে এ বছর ট্যাব ব্যবহারেরও সম্ভাবনা নেই।

এ ছাড়া বিবিএসের বিভিন্ন শাখা থেকে ১৭ হাজার ৮১৮টি ট্যাবের চাহিদা আসে। বিবিএসের মাঠপর্যায় থেকে চাহিদা আসে ৩ হাজার ৫১৭টি ট্যাবের। অন্যদিকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন বিভাগের দ্বিতীয় ও তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের দাপ্তরিক কাজে ব্যবহারের জন্য আরও ২৫০টি চাহিদাপত্র পায় বিবিএস। সব মিলিয়ে ১ লাখ ৬১ হাজার ৫৮৫টি ট্যাবের জন্য আবেদন পাওয়া গেছে। এসব চাহিদা পাওয়া গেছে শুধু বিবিএস ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে।

যেসব মতামত এল

আরও ২ লাখ ৩৯ হাজার ৪১৫টি ট্যাব কাকে দেওয়া যায়, সে উপায় খুঁজছেন বিবিএসের কর্মকর্তারা। বিষয়টি সুরাহা করতে দফায় দফায় সভাও হয়েছে। সেসব সভায় বেশ কিছু মতামত এসেছে।

বিভিন্ন সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, মাধ্যমিক পর্যায়ে নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ট্যাব বিতরণের মতামত দিয়েছেন কেউ কেউ। আবার কেউ কেউ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মধ্যে বিতরণের প্রস্তাব দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের আওতায় স্থাপিত বিভিন্ন আইসিটি ল্যাব, ইউনিয়ন পর্যায়ে স্থাপিত শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবের কাজে ব্যবহারের মতামত দিয়েছেন।

বিবিএস সূত্র জানায়, এ বছর যারা এসএসসিতে জিপিএ–৫ পেয়েছে, তাদের মধ্যে বিতরণের আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু তাদের সংখ্যা এত বেশি, পরে সে পথে এগোয়নি বিবিএস।

জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্পের পরিচালক দিলদার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ট্যাবগুলো রাষ্ট্রীয় সম্পদ। এগুলো নষ্ট হোক, তা আমরা চাই না। এগুলোর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করছি। ট্যাব বিতরণে একটি গাইডলাইন তৈরি করা হচ্ছে।’

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বিপুল অঙ্কের টাকায় কেনা এসব ট্যাব কেনার আগেই উচিত ছিল, পরে কী কাজে ব্যবহৃত হবে, তার উপায় বের করা। এখানে সরকারি কর্মকর্তাদের দক্ষতার ঘাটতি স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়। এখন তো জনগণের টাকা অপচয় হচ্ছে। যেহেতু ট্যাব কেনা হয়ে গেছে, এখন উচিত হবে যত দ্রুত সম্ভব এগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে বিতরণের ব্যবস্থা করা।