জাহাঙ্গীরের মা জায়েদা খাতুনই গাজীপুরের মেয়র

আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ১৬ হাজার ১৯৭ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে গাজীপুরের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন জায়েদা খাতুন।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হলেন জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

ভোটের লড়াইয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশন গাজীপুরের নতুন মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন জায়েদা খাতুন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা জায়েদা খাতুনের ছেলে জাহাঙ্গীর আলম গাজীপুর সিটি করপোরেশনেরই সাবেক মেয়র।

সাধারণ গৃহিণী থেকে বিশেষ পরিস্থিতিতে নির্বাচনে প্রার্থী হয়েই আলোচনায় আসেন ৬১ বছর বয়সী জায়েদা খাতুন। ভোটের প্রচারে নিজেকে জাহাঙ্গীরের মা হিসেবেই পরিচয় দিয়েছেন তিনি।

গতকাল বৃহস্পতিবার দিনে ভোট গ্রহণ শেষে গভীর রাতে গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়। তাতে দেখা যায়, জায়েদা খাতুন ১৬ হাজার ১৯৭ ভোটের ব্যবধানে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে পরাজিত করেছেন। মোট ৪৮০টি কেন্দ্রের মধ্যে টেবিল ঘড়ি প্রতীকের প্রার্থী জায়েদা খাতুন পেয়েছেন ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট। নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজমত উল্লা পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট। ভোটের ফলাফলে তৃতীয় হওয়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান পেয়েছেন ৪৫ হাজার ৩৫২ ভোট।

গাজীপুর শহরের বঙ্গতাজ মিলনায়তনে রিটার্নিং কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম যখন বেসরকারি ফলাফল ঘোষণা করছিলেন, তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন জায়েদা খাতুনের ছেলে ও তাঁর নির্বাচনী কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়কারী জাহাঙ্গীর আলম। বিজয়ের পর তিনি সাংবাদিকদের কাছে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, মায়েদের জয় হয়েছে গাজীপুরের নির্বাচনে। এ সময় তিনি আরও বলেন, গাজীপুরে নৌকা জিতছে আর ব্যক্তি হেরেছে। আওয়ামী লীগ এবং নৌকার বিরুদ্ধেও কখনো যাননি এবং যাবেনও না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

মা জায়েদা খাতুন গাজীপুরের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর সমর্থকদের নিয়ে বিজয় চিহ্ন দেখাচ্ছেন জাহাঙ্গীর আলম

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়েই মূলত জাহাঙ্গীর তাঁর মা জায়েদা খাতুনকে প্রার্থী করেন। অবশ্য তিনি নিজেও মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু ঋণখেলাপির জামিনদার হওয়ায় তাঁর প্রার্থিতা শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়ে যায়। পরে আওয়ামী লীগ থেকেও বহিষ্কৃত হন তিনি। কিন্তু ভোটের লড়াইয়ে কার্যত আজমত উল্লার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জাহাঙ্গীর। মায়ের পক্ষে দিনরাত প্রচার চালিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে আজমত উল্লাও নির্বাচনী প্রচারে যা বলেছেন, এর প্রায় সবই ছিল জাহাঙ্গীরকেন্দ্রিক। ভোটে আজমত উল্লার হেরে যাওয়াকে জাহাঙ্গীরের জয় বলেই উল্লেখ করছেন তাঁর অনুসারীরা।

নৌকার প্রার্থী হেরে যাওয়ার কারণ নিয়ে গত রাতেই আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় ১০ জন নেতা–কর্মীর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাৎক্ষণিকভাবে তাঁরা যেসব বিষয় সামনে এনেছেন, মেয়র থাকা অবস্থায় বিভিন্নজনকে দান-অনুদান এবং নানাভাবে আর্থিক সুবিধা দিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর। এসব কারণে স্থানীয় তরুণদের একটি অংশ সব সময় তাঁর সঙ্গে ছিল। ফলে তাঁর নিজস্ব ভোটব্যাংক গড়ে উঠেছে। আবার আওয়ামী লীগ তাঁকে বহিষ্কার করলেও স্থানীয়ভাবে দলের একটির অংশের সমর্থন ভেতরে–ভেতরে তিনি পেয়ে আসছিলেন। তিনিও নিজেকে আওয়ামী লীগের একজন হিসেবেই সব সময় পরিচয় দিয়েছেন। পাশাপাশি কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের বড় একটি অংশ তাঁকে সমর্থন দিয়ে গেছে।

গাজীপুর সিটি নির্বাচনে বেশির ভাগ কেন্দ্রেই ভোটারদের লম্বা লাইন দেখা যায়। কোথাও কোথাও নারী ভোটারদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। গতকাল কোনাবাড়ীর ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের আমবাগ প্রভাতি প্রিক্যাডেট অ্যান্ড হাইস্কুলে

গতকালের ভোটে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী ভোটার কেন্দ্রে গেছেন। তাঁদের বড় অংশের ভোট জায়েদা খাতুন পেয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি স্থানীয় নেতা–কর্মীদের মধ্যে এমন আলোচনাও রয়েছে, আওয়ামী লীগবিরোধী বেশির ভাগ ভোটও তিনি পেয়েছেন। এর কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, বিএনপি নির্বাচনে না থাকলেও স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী সরকার শাহনূর ইসলামের (হাতি প্রতীক) পরিবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তিনি মাত্র ২৩ হাজার ২৬৫ ভোট পেয়েছেন। এতে বোঝা যায়, বিএনপির কর্মী–সমর্থকদের মধ্যে যাঁরা কেন্দ্রে গেছেন, তাঁদের ভোট জায়েদা খাতুনের পক্ষে গেছে।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনে মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৬৩ জন। নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৫ লাখ ৭৫ হাজার ৫০। ভোট পড়ার হার ৪৮ দশমিক ৭৫। মোট ৪৮০টি কেন্দ্রের সব কটিতেই ইভিএমে ভোট গ্রহণ করা হয়।

নির্বাচনে অন্য মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে লাঙ্গল প্রতীকের জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন পেয়েছেন ১৬ হাজার ৩৬২ ভোট, গোলাপ ফুল প্রতীকের জাকের পার্টির মো. রাজু আহাম্মেদ ৭ হাজার ২০৬ ভোট, মাছ প্রতীকের গণফ্রন্টের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ১৬ হাজার ৯৭৪ ভোট এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ঘোড়া প্রতীকের মো. হারুন-অর-রশীদ ২ হাজার ৪২৬ ভোট পেয়েছেন।

শান্তিপূর্ণ ভোট

সাম্প্রতিক সময়ে সংসদীয় বিভিন্ন আসনের উপনির্বাচনে এবং স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে ভোটারের খরা দেখা গেছে। তবে গতকাল গাজীপুর সিটির নির্বাচনে ব্যতিক্রমী চিত্রই দেখা যায়। সকাল থেকে প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রে ভোটারের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। বেশির ভাগ কেন্দ্রে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বী সব প্রার্থীর এজেন্ট না থাকলেও অনিয়মের তেমন কোনো অভিযোগ ছিল না।

কেন্দ্রের বাইরে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন। জাঝর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জাঝর, গাজীপুর

স্থানীয় সরকার কিংবা জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনগুলোতে ভোটের গোপন কক্ষে ‘ডাকাতের’ উপস্থিতি দেখা গেছে। কিন্তু গাজীপুরের এই নির্বাচনে গোপন কক্ষে ভোটারের সহায়তার নামে কাউকে ঢোকার চেষ্টা করতে দেখা যায়নি। ভোটার, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও বলেছেন, গাজীপুরের ভোট ছিল অনেকটাই উৎসবমুখর। কেউ কেউ এর সঙ্গে গত বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনেরও তুলনা টানেন।

গাজীপুরের স্থানীয় ভোটার, রাজনীতিক ও নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের মতে, প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে সিসি (ক্লোজড সার্কিট) ক্যামেরা স্থাপন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারও পক্ষ না নেওয়া, আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর লোকজনের জবরদস্তির চেষ্টা না থাকার কারণেই ভোটের পরিবেশ অনেকটাই শান্তিপূর্ণ ছিল। ভোটাররাও অনেকটা নির্ভয়ে ভোট দিয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে যা কিছুটা ব্যতিক্রম।

ভোট দিতে এসে ভোটারদের উদ্দেশে হাত তোলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আজমত উল্লা খান। দারুস সালাম মাদ্রাসা, গাজীপুর

নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খান গতকাল সকাল নয়টার দিকে নিজ এলাকা টঙ্গীর দারুস সালাম মাদ্রাসা কেন্দ্রে ভোট দেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনে যে ফলাফলই আসুক না কেন, তিনি সেটা মেনে নেবেন। জনরায়ই তাঁর কাছে মূল বিষয়। এ সময় তিনি আরও বলেন, যাঁরা অপপ্রচার চালিয়েছিলেন যে ভোটাররা কেন্দ্রে আসবেন না বা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না, তাঁরা জবাব পেয়ে গেছেন।

অবশ্য শান্তিপূর্ণ ভোটেও ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) কিছু অসুবিধা ও ত্রুটির বিষয়টি সামনে এনেছেন অনেক ভোটার। অনেকে বলেছেন, আঙুলের ছাপ না মেলার কারণে ভোট দিতে দেরি ও ভোগান্তি হয়েছে। কারও কারও অনভ্যস্ততা ধীরগতির কারণ বলে ভোট গ্রহণে যুক্ত নির্বাচন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

ভোটকেন্দ্রে ভোট দেওয়ার গোপন কক্ষে (বুথ) অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিদের উপস্থিতিকে ‘ডাকাত’ বলে অভিহিত করেছিলেন নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান। এরপর গত বছরের ১২ অক্টোবর গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের উপনির্বাচনে গোপন কক্ষে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিদের প্রবেশ ও অনিয়মের কারণে পুরো নির্বাচন বাতিল করা হয়েছিল।

আঙুলের ছাপ পরীক্ষা করা হচ্ছে এক ভোটারের। চান্দনা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ, গাজীপুর চৌরাস্তা

গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ৪৮০টি কেন্দ্রের সব কটিতেই ইভিএমে ভোট হয়েছে। প্রথম আলোর ৯ জন প্রতিবেদক এবং ৪ জন আলোকচিত্রী মোট ৬৬টি ভোটকেন্দ্র ঘুরেছেন। এসব কেন্দ্রের সব কটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খানের পোলিং এজেন্ট দেখা গেছে। ৫৬টি কেন্দ্রে স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের এজেন্ট পাওয়া যায়নি। আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার শাহনূর ইসলামের এজেন্ট খুব একটা দেখা যায়নি। তবে কিছু ভোটকেন্দ্রে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী গাজী আতাউর রহমানের এজেন্ট ছিল।

রিটার্নিং কর্মকর্তার বরাবর এজেন্ট বের করে দেওয়া ও ঢুকতে না দেওয়ার অভিযোগ লিখিতভাবে জমা দিয়েছেন মেয়র প্রার্থী সরকার শাহনূর ইসলাম। তিনি বিএনপি নেতা হাসান উদ্দিন সরকারের ভাতিজা। শাহনূরের দলে কোনো পদ নেই। বিএনপি এই নির্বাচন বর্জন করলেও দলটির ২৯ জন নেতা কাউন্সিলর পদে ভোট করেন। তাঁদের সবাইকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

গতকাল সকালে ভোট দিয়ে প্রায় সব মেয়র প্রার্থী শান্তিপূর্ণ ভোট হচ্ছে জানিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন ও তাঁর ছেলে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম ভোট দেন সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কানাইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। গতকাল সকাল ১০টার দিকে ভোট দেওয়ার পর জায়েদা খাতুন সাংবাদিকদের বলেন, তিনি জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।

চোখে পড়ার মতো ভোটারের উপস্থিতি

সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে ভোটারের জন্য ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। বিএনপির ছেড়ে দেওয়া ছয়টি আসনের উপনির্বাচনেও মাইকিং করে ভোটারদের ডেকে আনার ঘটনা ঘটেছে। এরপরও ৩০-৪০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি এসব নির্বাচনে। গাজীপুরের নির্বাচনে ৫০ শতাংশের মতো ভোট গ্রহণের কথা গতকাল বিকেলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

ভোটকেন্দ্রের বাইরে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন। কানাইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

সকাল থেকেই বেশির ভাগ কেন্দ্রে ভোটারদের লম্বা সারি দেখা গেছে। কোথাও কোথাও ভরদুপুরেও রোদের মধ্যে দীর্ঘ সারিতে অপেক্ষা করেন ভোটাররা। এর মধ্যে নারী, পুরুষ, বয়স্ক, তরুণ—সব শ্রেণির ভোটার ছিলেন। এমনকি বিকেল চারটায় ভোট গ্রহণের নির্ধারিত সময়ের পরও বেশ কিছু কেন্দ্রে ৬০-৭০ জন ভোটারকে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় থাকতে দেখা গেছে। পরে তাঁরা ভোট দেওয়ার সুযোগ পান।

গতকাল সকালে চান্দনায় কথা হয় ৯০ বছর বয়সী আতরজান বিবির সঙ্গে। দুই ছেলের বউয়ের হাতে ভর দিয়ে তিনি ভোটকেন্দ্রে আসেন। তাঁর কথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। ভোট দিয়ে বের হওয়ার সময় তিনি প্রথম আলোকে যা বললেন, তার অর্থ হচ্ছে—কখন মরে যাবেন ঠিক নেই। আবার ভোট দেওয়ার সুযোগ না-ও হতে পারে। তাই কষ্ট হলেও ভোট দিতে এসেছেন।

শান্তিপূর্ণ ভোটের মধ্যেই গাজীপুরের সালনা এলাকায় নাগা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের বাইরে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে একজন আহত হন। গাজীপুর শহরের পাশের কাজী আজিম উদ্দিন কলেজ কেন্দ্রে এক কাউন্সিলর প্রার্থীর ভাইয়ের সঙ্গে পুলিশের বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। যার জের ধরে পুলিশের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনাও ঘটে। শহরের রানি বিলাসমণি বালক উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকের মধ্যে বাগ্‌বিতণ্ডা শুরু হলে পুলিশ দুই পক্ষকেই সরিয়ে দেয়।

সিসি ক্যামেরাই ‘এজেন্ট’

আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য দল বা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এজেন্ট না থাকা বা বের করে দেওয়ার ঘটনা গত কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন নির্বাচনে দেখা গেছে, যা ভোটকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে।

ঢাকায় নির্বাচন কমিশনে বসে সিসিটিভি ক্যামেরাতে নির্বাচন কমিশনাররা ভোট পর্যবেক্ষণ করছেন

গাজীপুরের নির্বাচনে ভোট কক্ষে সিসি ক্যামেরা থাকা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিদের উপস্থিতি বন্ধে নির্বাচন কর্মকর্তারা তৎপর ছিলেন। যে কারণে সব কেন্দ্রে এজেন্ট না থাকাকে বড় করে দেখেননি প্রার্থীরা। একজন স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত থাকা গুরুত্বপূর্ণ একজন নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এজেন্ট বের করে দেওয়া হয়েছে, ঢুকতে দেওয়া হয়নি—ভোটের সময় এসব অভিযোগ করতে হয়, এ জন্য তাঁরা করেছেন। আসলে এবার গাজীপুরের ভোটে সিসি ক্যামেরাই ‘এজেন্টের’ ভূমিকা পালন করেছে। ২০১৮ সালের গাজীপুর সিটির নির্বাচনেও বিএনপির প্রার্থীর এজেন্টদের ভোটের আগেই তুলে নেওয়া হয়। এরপর একচেটিয়া কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণে নেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সমর্থকেরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তখন কোথাও নীরব ছিলেন, কোথাও ছিলেন সহায়কের ভূমিকায়, এবার এমনটা হয়নি।

গাজীপুরের ভোট নিয়ে গতকাল রাতে বিভিন্ন দলের স্থানীয় রাজনীতিকদের মূল্যায়ন হচ্ছে, ভোট নিয়ে জবরদস্তি হয়নি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করার বিষয়ে সরকারের ওপর দেশি-বিদেশি চাপ আছে। বিশেষ করে গাজীপুরের ভোটের আগের রাতে (বুধবার, ২৪ মে) যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে। বাংলাদেশে নির্বাচনপ্রক্রিয়া সুষ্ঠু করতে যারা বাধা দেবে, তাদের ভিসা না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এটাও গাজীপুরের ভোট সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে প্রশাসনের তৎপরতার একটা কারণ হতে পারে।

এ ছাড়া সিসি ক্যামেরা থাকায় ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচন কমিশন এবং গাজীপুরে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে বড় বড় মনিটরে ভোটকেন্দ্র ও বুথের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হয়। কোনো অসংগতি দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশনা দেওয়া হয়। যেমন গাজীপুরের বাসন এলাকায় সোনারবান মেমোরিয়াল হাইস্কুল ভোটকেন্দ্রের একটি গোপন বুথে প্রবেশের দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করেন ঢাকার নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তারা। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত একজনকে তিন দিনের কারাদণ্ড এবং আরেকজনকে দিনভর আটকে রেখে সন্ধ্যায় ছেড়ে দেন।

গাজীপুর শহরের শহীদ স্মৃতি বিদ্যালয় কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা পুলিশের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, কেউ যাতে ভোটারদের বাধা না দেয় এবং গন্ডগোল করতে না পারে, সে জন্য তাঁদের ওপর নির্দেশনা ছিল। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর লোকেরাও কোনো ঝামেলা করেননি। ফলে তাঁদের পক্ষে দায়িত্ব পালন করা সহজ হয়েছে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন কাদির কল্লোল, আনোয়ার হোসেন, সামছুর রহমান, আহমদুল হাসান, ড্রিঞ্জা চাম্বুগং, প্রদীপ সরকার, মাসুদ রানা, সাদিক মৃধা ও আল-আমিন]