আজ বুধবার মহান মে দিবসে সকাল থেকেই শ্রমজীবী জনতা তাঁদের ন্যায্য দাবিদাওয়া আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রাম অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার নিয়ে লাল পতাকা মিছিল করেছেন রাজধানীতে।
সকাল থেকেই বিভিন্ন সংগঠন রাজধানীর বিজয়নগর, নয়া ও পুরানা পল্টন, গুলিস্তান, ফকিরাপুল ও সেগুনবাগিচা এলাকা থেকে লাল পতাকা, জাতীয় পতাকা, ব্যানার ও ফেস্টুন নিয়ে মিছিল করে। তারা সচিবালয়ের সামনে দিয়ে তোপখানা রোড হয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আসে। রোদের খরতাপ ও প্রচণ্ড গরম উপেক্ষা করে অগণিত শ্রমজীবী নারী-পুরুষ ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’, ‘ন্যায্য মজুরি দিতে হবে’ এমন স্লোগানে স্লোগানে এলাকা মুখর করে তোলেন। এর সঙ্গে অনেক সংগঠন ট্রাকে মঞ্চ করে গণসংগীত পরিবেশন করে। মিছিলে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ নর-নারীর পরনে ছিল লাল পাঞ্জাবি, টি–শার্ট বা লাল শাড়ি। ফলে পুরে এলাকাটি রক্তিম হয়ে ওঠে। সকাল নয়টা থেকে বেলা প্রায় একটা পর্যন্ত মিছিল–সমাবেশ অব্যাহত থাকে।
মিছিলগুলো প্রেসক্লাবের সামনে এসে বিরতি দিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে। এতে নেতারা মে দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে দেশের বর্তমান আর্থসামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন বেগবান করে তোলার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে বক্তারা বর্তমান সরকারের তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, এই সরকার যেমন মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে, তেমনি শ্রমিকদের ও ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করে কেবল তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে। তাই শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ কারণেই তাঁরা এক বৃহত্তর ঐক্যের আন্দোলনের জন্য ডাক দিয়েছেন।
সকালে রাজধানীর পুরানা পল্টন মোড়ে শ্রমিক সমাবেশ করে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র (টিইউসি)। সেখানে বক্তব্যে নেতারা বলেন, শ্রমজীবী মানুষ এখনো সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত। তাঁদের চাকরির নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতিতে শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষ অসহায় ও মানবেতর জীবন-যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন।
সমাবেশে নেতারা বেশ কিছু দাবি জানান। এর মধ্যে রয়েছে স্থায়ী মজুরি কমিশন গঠন করে উপযোগী মজুরি ঘোষণাসহ মজুরি বোর্ড গঠন, রেশন প্রথা চালু, আইএলও কনভেনশন ও জাতীয় শ্রমনীতি অনুসারে অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত করা, শ্রম আইন সংশোধন, শ্রমিক হত্যার বিচার এবং শ্রমিকদের দমন-নির্যাতন বন্ধ করা।
আউটসোর্সিংয়ের নামে শ্রমিক-কর্মচারীদের মৌলিক অধিকার হরণ ও শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধের দাবি জানিয়ে টিইউসির নেতারা আরও বলেন, নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করে সমমজুরি, সামাজিক মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
টিইউসির সহসভাপতি মাহবুব আলমের সভাপতিত্বে সমাবেশে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন সংগঠনের দপ্তর সম্পাদক সাহিদা পারভীন শিখা। সমাবেশে বক্তব্য দেন টিইউসির অর্থ সম্পাদক কাজী রুহুল আমীন, প্রচার সম্পাদক মোবারক হোসেন, কেন্দ্রীয় নেতা ইদ্রীস আলী প্রমুখ। সমাবেশের শুরুতে উদীচীর শিল্পীরা গণসংগীত পরিবেশন করেন। সমাবেশ শেষে লাল পতাকা মিছিল হয়।
গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি শ্রমিকনেতা মন্টু ঘোষের সভাপতিত্বে সকালে পুরানা পল্টনের কমরেড মণি সিংহ সড়কে সমাবেশ হয়। সেখানে গার্মেন্ট, পাটকল, পরিবহন, রিকশা ও হকারসহ দেশের বিভিন্ন শিল্প ও অসংগঠিত খাতের শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা অংশ নেন।
সমাবেশে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ক্ষমতাসীনেরা দেশের শ্রমিক ও মেহনতি জনগণকে একদিকে সীমাহীন চরম শোষণ-বঞ্চনার নিষ্ঠুর শিকারে পরিণত করেছে। অন্যদিকে প্রতিবাদের অধিকার, মতপ্রকাশের অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকারও কেড়ে নিয়েছে। মুজাহিদুল ইসলাম আরও বলেন, দেশের ‘পনেরো আনা’ মানুষকে রাজনৈতিকভাবে জিম্মি করেছে ‘এক আনা’ লুটেরা গোষ্ঠী। এই জিম্মিদশা থেকে জনগণকে মুক্ত করতে হলে রাজনীতির নেতৃত্ব শ্রমিকশ্রেণি ও মেহনতি মানুষকে নিতে হবে। তিনি বলেন, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই শ্রমিকশ্রেণিকে রাজনীতির হাল ধরতে হবে।
সমাবেশ থেকে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজার টাকা নির্ধারণসহ ১১ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। পরিবহন শ্রমিকনেতা হযরত আলীর সঞ্চালনায় সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন রাকসুর সাবেক ভিপি কৃষকনেতা রাগীব আহসান, শ্রমিকনেতা জলি তালুকদার, গার্মেন্ট টিইউসির সাধারণ সম্পাদক সাদেকুর রহমান, বাংলাদেশ হকার্স ইউনিয়নের সভাপতি আবদুল হাশিম কবির, রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম, বাংলাদেশ বস্তিবাসী ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক নূর মোহাম্মদ, প্রাইভেট কার ড্রাইভার্স ইউনিয়নের যুগ্ম আহ্বায়ক হোসেন আলী। সমাবেশে বর্ষীয়ান শ্রমিকনেতা মনজুরুল আহসান খান, সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অনিরুদ্ধ দাস অঞ্জন, প্রকৌশলী নিমাই গাঙ্গুলী, গার্মেন্ট টিইউসির সহসভাপতি জিয়াউল কবির উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে আজ আশুলিয়া, সাভার, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জসহ সব শ্রমিক এলাকায় লাল পতাকা মিছিল, সমাবেশ ও আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আশুলিয়ায় ফ্যান্টাসি কিংডমের সামনে লাল মিছিল ও সমাবেশ উদ্বোধন করেন সংগঠনের সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার। সমাবেশ বক্তব্য দেন সাংগঠনিক সম্পাদক প্রবীর সাহা, আশুলিয়ার সভাপ্রধান জিয়াদুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক বিল্লাল হোসেনসহ অনেকে। বক্তারা বলেন, এত দিনে বাংলাদেশের শ্রমিকেরা কাগজে-কলমে ৮ ঘণ্টার স্বীকৃতি পেলেও ৮ ঘণ্টায় যে মজুরি পান, তাতে তাঁদের জীবন চলে না। শ্রমিকেরা বাধ্য হন অতিরিক্ত কাজ করতে। কখনো কখনো শ্রমিকদের নানা অজুহাতে বিনা মজুরিতে খাটানো হয়। এই পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টায় মর্যাদাপূর্ণ মজুরি ও জীবন বাঁচানোর লড়াইয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট: সংগঠনের পক্ষ থেকে লাল পতাকা মিছিল নিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এসে সমাবেশ করা হয়। সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন, খালেকুজ্জামান রিপন, খালেকুজ্জামানসহ সংগঠনের নেতারা বক্তব্য দেন। তারা বলেন, স্বাধীনতার পরে ৫৩ বছর পার হলেও দেশে শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। পোশাকশ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে ১২ হাজার টাকা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে এই টাকায় সংসার চালানো প্রায় অসম্ভব। পোশাকশ্রমিকেরা তাঁদের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে আন্দোলন করলে সেই আন্দোলন দমানোর জন্য তাঁদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে।
ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ: জাতীয় প্রেসক্লাবের প্রধান প্রবেশপথের সামনে ট্রাকে সমাবেশের আয়োজন করে ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ। সভাপতি আজিজুল আলম, সহসভাপতি খলিলুর রহমান খান, যুগ্ম সম্পাদক প্রকাশ দত্তসহ অনেক নেতা বক্তব্য দেন। তাঁরা বলেন, পোশাকশিল্পসহ দেশের শিল্পকলকারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের কোনো নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না। মালিকপক্ষ যখন-তখন তাঁদের ছাঁটাই করতে পারে। সরকার এসবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। মহান মে দিবসে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধভাবে অধিকার আদায়ের আন্দোলন–সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান নেতারা।
স্কপ: শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) সভায় বক্তব্য দেন নাইমুল হাসান, শামিম আরা, শাহ আলম কামরুল হাসানসহ অনেকে। তাঁরা বলেন, বাংলাদেশের মতো সস্তা শ্রমবাজার আর কোথাও নেই। এখানে কার্যত কোনো কর্মঘণ্টা বা কর্মপরিবেশের আইন মানা হয় না। রানা প্লাজা বা তাজরীন গার্মেন্টসে শত শত শ্রমিকের মৃত্যু ঘটলেও তার কোনো সুবিচার হয় না। বরং ন্যায্য দাবি নিয়ে শ্রমিকেরা পথে নামলে তাঁদের ওপর পুলিশ ও সরকারের গুন্ডা বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে।
সভায় বক্তারা স্কপের ৭ দফা দাবি মানার আহ্বান জানান। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে—আট ঘণ্টা কর্মদিবস বাস্তবায়ন, আইন করে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা, ইপিজেডসহ সব খাতে শ্রমিকদের অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার দেওয়া, অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা বিল প্রত্যাহারসহ কর্মক্ষেত্রে নিহত-আহতদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
শ্রমিক অধিকার পরিষদ: দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে শ্রমিক অধিকার পরিষদ শ্রমিক সমাবেশ করে। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি আবদুর রহমান। সভায় গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক বলেন, শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ত্যাগ করে সব শ্রমিক সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধভাবে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সমাবেশে গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খানসহ কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য দেন।
অন্যান্য: এ ছাড়া সকাল থেকেই লাল পতাকা মিছিল নিয়ে বহু শ্রমিক ও পেশাজীবী সংগঠন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আসে। এসব সংগঠনের পক্ষ থেকে নেতারা মহান শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মে দিবসের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক জোট, সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস), গ্রিন বাংলা গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশন, জাতীয় জনতা পার্টি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, জাতীয় গার্হস্থ্য নারী শ্রমিক ইউনিয়ন, পুস্তক বাঁধাই শ্রমিক জোট, জাতীয় শ্রমিক জোট (জে এস জে), বাংলাদেশ পরিবহন হকার্স জোট, ডেকোরেটর কারিগর-শ্রমিক কল্যাণ সমিতি, জাতীয় পরিবহন শ্রমিক লীগ, ইসলামিক শ্রমিক আন্দোলন, পিপলস ইউনিটি সেন্টারসহ বিভিন্ন সংগঠন মে দিবস উপলক্ষে কর্মসূচি পালন করে।