প্রাণীর চিকিৎসার কাজে কেনা গাড়ি। ২০ জুলাই মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার একটি ব্যক্তিগত গ্যারেজে পাওয়া যায় গাড়িটি। এটি থাকার কথা ছিল উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরে
প্রাণীর চিকিৎসার কাজে কেনা গাড়ি। ২০ জুলাই মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার একটি ব্যক্তিগত গ্যারেজে পাওয়া যায় গাড়িটি। এটি থাকার কথা ছিল উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরে

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর

গরুর চিকিৎসার কাজে কেনা গাড়ি ব্যবহার করেন কর্মকর্তারা

প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) আওতায় ৩৬০টি গাড়ি দেওয়া হয়েছে উপজেলা পর্যায়ে। এসব গাড়ি কেনার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

অসুস্থ গরু-ছাগলকে জরুরি চিকিৎসা দিতে গত বছরের শুরুর দিকে একসঙ্গে ৩৬০টি গাড়ি কেনে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। এতে ব্যয় হয় ১৮৫ কোটি টাকা। কিন্তু অসুস্থ প্রাণীর চিকিৎসার জন্য গ্রামের পথে খুব একটা ছুটছে না গাড়ি। বরং কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত কাজেই এসব গাড়ির ব্যবহার বেশি হচ্ছে।

গাড়ি নিয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কেউ যাচ্ছেন মন্ত্রীর অনুষ্ঠানে। কেউ বাসা–অফিস যাতায়াতে, কেউবা ঘুরতে গেলে এই গাড়ি ব্যবহার করছেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে প্রাণীর চিকিৎসার কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে কেনা গাড়ির অপব্যবহার ঠেকাতে জিপিএস ট্র্যাকার (গাড়ির অবস্থান শনাক্তের প্রযুক্তি) বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।

ক্লিনিকগুলো (গাড়ি) নিয়ে দেশের খামারিদের পাশে দাঁড়ান। আর যেন কোনো গবাদিপশু–পাখি বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম

মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিক বা এমভিসি (ভ্রাম্যমাণ প্রাণিচিকিৎসা ক্লিনিক) নামে পরিচিত এসব গাড়ি কেনা হয়েছে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায়। প্রথম পর্যায়ে দেশের ৩৬০টি উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে গাড়ি দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি গাড়ি কিনতে গড়ে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৫২ লাখ টাকা। গাড়ি কেনার এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা যাতে গাড়ি নিয়ে ঘুরে ঘুরে খামারিদের বাড়িতে বা খামারে গিয়ে অসুস্থ গরু-ছাগলকে চিকিৎসাসেবা দিতে পারেন।

গত বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি ৩৬০টি গাড়ি হস্তান্তর উপলক্ষে ঢাকায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের বলেছিলেন, ‘ক্লিনিকগুলো (গাড়ি) নিয়ে দেশের খামারিদের পাশে দাঁড়ান। আর যেন কোনো গবাদিপশু–পাখি বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়।’ গাড়ির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতেও সেদিন প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন মন্ত্রী।

গাড়ির সঠিক ব্যবহার কতটা হচ্ছে, তা দেখতে গত ২০ জুলাই দুপুরে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক যান মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালে। বেলা আড়াইটায় দপ্তরে ঢুকে জানা গেল, গাড়ি উপজেলায় নেই। উপস্থিত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম গাড়ি নিয়ে ঢাকায় গেছেন। এই তথ্য জানার পরই এই প্রতিবেদক তাঁর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু রিং হলেও ফোন ধরেননি তিনি। পরে আরও দুবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা চলে। কিন্তু তিনি ফোন আর ধরেননি। পরে এই প্রতিবেদক উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার গাড়িচালক ইকবাল হোসেনকে ফোন করেন। তিনি বলেন, ‘স্যারকে নিয়ে ঢাকায় এসেছি।’

টঙ্গিবাড়ী যাওয়ার আগে গত ২০ জুলাই সকালে প্রথমে এই প্রতিবেদক যান মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে জানা যায়, অসুস্থ গরু-ছাগলকে জরুরি চিকিৎসার জন্য দেওয়া গাড়িটি কার্যালয়ে নেই। অসুস্থ কোনো প্রাণীকে চিকিৎসা দিতেও কেউ গাড়ি নিয়ে কোথাও যাননি। পরে জানা যায়, গাড়ি আছে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় থেকে দুই কিলোমিটার দূরে একটি ব্যক্তিগত গ্যারেজে।

পরে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা শবনম সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামের রাস্তা সরু থাকার কারণে চিকিৎসার কাজে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় না। নিরাপত্তার কারণে অফিসের ভেতরে গাড়ি রাখার অবস্থাও নেই। তাই মাসে দুই হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে গ্যারেজে রাখা হয়েছে।

উপজেলা পর্যায়ে এ ধরনের বড় গাড়ি দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপজেলা পর্যায়ের পাঁচজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলেন, এসব গাড়ি কেনার আগে তাঁদের মতামত নেওয়া হয়নি। গাড়িগুলো আকারে এত বড় যে গ্রামের রাস্তায় চালানো কঠিন।

অবশ্য ভিন্ন চিত্র দেখা গেল ঢাকার কেরানীগঞ্জে। ২৭ জুলাই সকাল সাড়ে নয়টায় এই প্রতিবেদক উপস্থিত হন উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালের সামনে। সকাল ১০টায় দেখা গেল উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মনছুর আহমেদ সেই গাড়ি থেকে নেমে তাঁর দপ্তরে প্রবেশ করছেন। এই দপ্তরের অন্য একজন কর্মী জানান, ‘স্যার, বাসা থেকে এসেছেন।’

উপজেলা পর্যায়ে এ ধরনের বড় গাড়ি দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপজেলা পর্যায়ের পাঁচজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলেন, এসব গাড়ি কেনার আগে তাঁদের মতামত নেওয়া হয়নি। গাড়িগুলো আকারে এত বড় যে গ্রামের রাস্তায় চালানো কঠিন। আকারে ছোট হলে গাড়ি নিয়ে সহজেই গ্রামের রাস্তায় যাওয়া যেত। আবার অনেক উপজেলায় প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে গাড়ি রাখার ভালো ব্যবস্থা নেই।

মন্ত্রীর অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ওই গাড়ি ব্যবহার ঠিক হয়নি। এ নিয়ে তদন্ত কমিটি হয়েছে। আর বরাদ্দের অভাবে নষ্ট হওয়া গাড়ি ঠিক করা যায়নি।
পিরোজপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা তরুণ কুমার সিকদার

দুর্ঘটনায় নষ্ট তিনটি গাড়ি

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের নির্বাচনী এলাকা পিরোজপুর–১ (পিরোজপুর সদর, নেছারাবাদ ও নাজিরপুর উপজেলা)। মন্ত্রী প্রায়ই তাঁর নির্বাচনী এলাকায় যান। এ বছরের শুরুর দিকে সেখানে একটি অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পথে দুর্ঘটনায় আহত হন পিরোজপুর সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাসহ চারজন। যদিও প্রাণীর চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত গাড়ি নিয়ে মন্ত্রীর অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি।

পিরোজপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা তরুণ কুমার সিকদারের সঙ্গে কথা হয় গত আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রীর অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ওই গাড়ি ব্যবহার ঠিক হয়নি। এ নিয়ে তদন্ত কমিটি হয়েছে। আর বরাদ্দের অভাবে নষ্ট হওয়া গাড়ি ঠিক করা যায়নি।

একইভাবে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের গাড়িও দুর্ঘটনায় পড়েছিল। সেখানেও ব্যক্তিগত কাজে গাড়ি ব্যবহৃত হচ্ছিল বলে জানান জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের এক কর্মকর্তা।

যত দূর গাড়ি নেওয়া সম্ভব, কর্মকর্তারা তত দূর নেবেন। পরে মোটরসাইকেল চালিয়ে খামারির বাড়িতে যাবেন। তা ছাড়া সব উপজেলায় সরু রাস্তা নেই। অনেক উপজেলায় রাস্তা চওড়া হয়ে গেছে।
প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) পরিচালক আবদুর রহিম

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জেও একই চিত্র। দুর্ঘটনার পর সেখানকার গাড়িটি নষ্ট অবস্থায় পড়ে আছে বলে জানান প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) পরিচালক আবদুর রহিম। তিনি বলেন, তিনটি গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার পড়েছিল, মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

গরু-ছাগলের চিকিৎসার কাজে কেনা গাড়ি কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক আবদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি তাঁদেরও নজরে এসেছে। অপব্যবহার বন্ধে গাড়িতে জিপিএস ট্র্যাকার লাগানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে করে ব্যক্তিগত কাজে গাড়ির ব্যবহার কমে আসবে বলে আশাবাদী তিনি।

প্রকল্প পরিচালক আবদুর রহিমের সঙ্গে গত ২২ আগস্ট ঢাকার ফার্মগেটে তাঁর দপ্তরে যখন কথা হচ্ছিল, তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন একই প্রকল্পের চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর (প্রধান কারিগরি সমন্বয়ক) গোলাম রব্বানীও।

গ্রামীণ রাস্তায় চলাচলের জন্য এ ধরনের গাড়ি বাছাইয়ের কারণ কী, এমন প্রশ্নে গোলাম রব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, ‘যত দূর গাড়ি নেওয়া সম্ভব, কর্মকর্তারা তত দূর নেবেন। পরে মোটরসাইকেল চালিয়ে খামারির বাড়িতে যাবেন। তা ছাড়া সব উপজেলায় সরু রাস্তা নেই। অনেক উপজেলায় রাস্তা চওড়া হয়ে গেছে।’

দেশে গরুর দুধের উৎপাদন বাড়াতে ২০১৮ সালে এই প্রকল্প (এলডিডিপি) অনুমোদন হয়। তখন প্রকল্পের ব্যয় ছিল ৪ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক ঋণ হিসেবে দিচ্ছে ৩ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা।

এ ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। তাই এসব পড়ে আছে।
উপজেলা ভেটেরিনারি সার্জন কালীশংকর পাল

বাকি ৩৯৫ কোটি টাকা সরকার দিচ্ছে। চলতি বছর ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। তবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) গত জুলাই মাসের তথ্য বলছে, চার বছরে প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি ৪৮ শতাংশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।

নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পেরে প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়াতে গত আগস্ট মাসে পরিকল্পনা কমিশনে চিঠি দিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। একই সঙ্গে প্রকল্পের ব্যয় ৪ হাজার ২৮০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করেছে তারা। ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতনের কারণে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক আবদুর রহিম।

কোনো যন্ত্র পড়ে আছে, কোনোটির বাক্সই খোলা হয়নি

এলডিডিপি প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে আলট্রাসাউন্ড মেশিন (গরুর গর্ভধারণ পরীক্ষার যন্ত্র) ও ক্রিম সেপারেটর (দুধ থেকে ছানা আলাদা করার যন্ত্র) পাঠানো হয়। যন্ত্রগুলো দেওয়া হয়েছে খামারিরা যাতে ব্যবহার করতে পারেন, সে জন্য। কিন্তু কীভাবে এসব যন্ত্র ব্যবহার করতে হয়, সে প্রশিক্ষণ কাউকে দেওয়া হয়নি। তাই অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে যন্ত্রগুলো।

এ ছাড়া প্রকল্পের আওতায় গরু-ছাগলের টিকা (ভ্যাকসিন) সংরক্ষণের জন্য প্রতিটি উপজেলায় ডিপ ফ্রিজ, রেফ্রিজারেটরসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতিও দেওয়া হয়। এর মধ্যে ডিপ ফ্রিজ থাকবে কার্যালয়ে। আর রেফ্রিজারেটর স্থাপন করার কথা গাড়িতে।

গত ২৭ জুলাই ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, রেফ্রিজারেটরের প্যাকেট খোলা হয়নি। ডিপ ফ্রিজও খালি। আলট্রাসাউন্ড মেশিনও ব্যবহৃত হচ্ছে না। ক্রিম সেপারেটর যন্ত্রও পড়ে আছে। এসব যন্ত্রের কোনোটি এই উপজেলায় এসেছে এক মাস আগে, কোনোটি পৌঁছেছে দুই মাস আগে।

আলট্রাসাউন্ড মেশিন ও ক্রিম সেপারেটর যন্ত্র এখনো ব্যবহৃত না হওয়ায় এসব ঠিক আছে কি না, সেটিও বলতে পারছেন না কেরানীগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মনছুর আহমেদ।

একই উপজেলার প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা জান্নাতুন নাহার প্রথম আলোকে বলেন, আলট্রাসাউন্ড কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, তার ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। আর গাড়িতে রেফ্রিজারেটর কীভাবে সংযোজন করা হবে এবং এর ব্যবহার সম্পর্কেও কোনো কিছু জানানো হয়নি তাঁদের।

কেরানীগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে তারানগর ইউনিয়নের দূরত্ব সড়কপথে আট কিলোমিটার। সেখানকার খামারিদের একজন হাবিবুর রহমান। তাঁর বাড়ির খামারে এখন দুটি গরু ও একটি ছাগল আছে। এই খামারি প্রথম আলোকে বলেন, বাড়িতে গাড়ি নিয়ে এসে প্রাণীর চিকিৎসা দেওয়া হয়, এমন খবরই তাঁর জানা নেই।

২৭ জুলাই সকালে তাঁর সঙ্গে কথা হয় উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের সামনে। অসুস্থ ছাগলের চিকিৎসা করাতে তিনি সেখানে এসেছিলেন। তিনি বলেন, তাঁর এলাকায় গত এক বছরে প্রাণীর চিকিৎসা করাতে গাড়ি নিয়ে কেউ এসেছেন, এমনটি কখনো শোনেননি।

একই চিত্র মুন্সিগঞ্জেও

গত ২০ জুলাই মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, প্রকল্পের আওতায় পাঠানো বিভিন্ন যন্ত্র একটি কক্ষে বাক্সবন্দী অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। উপজেলা ভেটেরিনারি সার্জন কালীশংকর পাল প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। তাই এসব পড়ে আছে।

 একই অবস্থা জেলার সিরাজদিখান উপজেলার প্রাণিসম্পদ ও ভেটেরিনারি হাসপাতালেরও। আলট্রাসাউন্ডসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা শবনম সুলতানা বলেন, এসব যন্ত্রপাতি সরবরাহ করার আগে ব্যবহারের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার ছিল।

যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকার বিষয়ে এই প্রকল্পের চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর গোলাম রব্বানী বলেন, ‘প্রশিক্ষণ ছাড়া এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যাবে না। এটা অস্বীকার করছি না। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এসব যন্ত্রপাতি মাঠপর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হয়ে আসবে।’

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এলডিডিপি প্রকল্পের আওতায় কেনা যন্ত্রগুলোর ব্যবহার মাঠপর্যায়ে হচ্ছে না। গত জুন মাসে প্রতিবেদনটি তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।

এতে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ ক্রিম সেপারেটর যন্ত্র প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। প্রশিক্ষণের অভাবে যন্ত্রপাতিগুলো প্যাকেটজাত অবস্থায় পড়ে আছে। মূল্যবান এসব যন্ত্রপাতি দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকলে তা নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।

প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত প্রকল্পের লক্ষ্য অত্যন্ত সুন্দর করে সাজানো হয়।কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, প্রকল্প থেকে সুবিধা নেন কর্মকর্তারাই। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে কী ধরনের অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অর্থের অপচয় হয়, এলডিডিপি প্রকল্প তার একটি উদাহরণ মাত্র। এ ধরনের ঘটনা অন্যান্য প্রকল্পেও হচ্ছে। সব ক্ষেত্রে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে না পারলে দুর্নীতি কমবে না।

আপত্তি পরিকল্পনা কমিশনের

এই প্রকল্প নিয়ে মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা গত ১৫ মে পরিকল্পনা কমিশনে অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ফজলুল হক। ওই সভায় প্রকল্পের বেশ কিছু খাতের ব্যয় নিয়ে আপত্তি জানায় পরিকল্পনা কমিশন।

সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, করোনাকালে এ প্রকল্প থেকে দেশব্যাপী খামারিদের নগদ অর্থসহায়তা বাবদ ৭৫২ কোটি টাকা ব্যয় দেখিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, যা প্রকল্পের অনুমোদিত মোট ব্যয়ের ১৭ ভাগ। এ খরচ নিয়ে আপত্তি আছে পরিকল্পনা কমিশনের।

করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ২০২০ সালে সারা দেশে প্রায় ছয় লাখ ক্ষতিগ্রস্ত খামারিকে ১২ হাজার থেকে ২২ হাজার টাকা পর্যন্ত নগদ সহায়তা দেওয়া হয় এই প্রকল্প থেকে। ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের তালিকা করা হয় প্রতিটি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটির মাধ্যমে। কিন্তু তালিকায় নাম থেকেও অনেক খামারি নগদ সহায়তা পাননি বলে অভিযোগ উঠেছে। আবার এমন অনেকে নগদ সহায়তা পেয়েছেন, যাঁদের পাওয়ার কথা ছিল না।

ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার খামারি নাসিমা বেগমের নাম তালিকায় ছিল। তাঁর খামারে পাঁচটি গরু আছে এখন। কিন্তু তিনি সহায়তার টাকা পাননি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার নাম নিছে অফিস (প্রাণিসম্পদ কার্যালয়) থেকে। টাকা কেন দেয় নাই, জানি না।’

ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের মধ্যে কারা নগদ সহায়তা পেলেন, সে বিষয়ে জরিপ করেছিল আইএমইডি, যা তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে। এই জরিপের জন্য ১ হাজার ২০ জন খামারির সঙ্গে কথা বলেছিল সরকারি এই সংস্থা। তাদের হিসাবে, জরিপে অংশ নেওয়া ৩০ শতাংশ খামারি নগদ সহায়তার টাকা পেয়েছেন, বাকিরা পাননি।

নগদ সহায়তার টাকায় অনিয়মের বিষয়ে এলডিডিপি প্রকল্পের চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর গোলাম রব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, তালিকায় নাম থেকেও অনেক খামারি টাকা পাননি, বিষয়টি তাঁরাও জানেন। তবে খামারিদের জাতীয় পরিচয়পত্র এবং নগদ (মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদানকারীর প্রতিষ্ঠান) ও রকেট নম্বরে ত্রুটির কারণে তাঁরা বাদ পড়েছেন। তাঁর দাবি, নগদ সহায়তার ক্ষেত্রে অনিয়মের সুযোগ নেই। কারণ, সরাসরি খামারির দেওয়া নম্বরেই টাকা পাঠানো হয়েছে।

গ্রহণযোগ্য হতে পারে না

এই প্রকল্পের মন্থরগতি নিয়ে পরিকল্পনা কমিশন অসন্তোষ জানালেও প্রচার-প্রচারণায় টাকা খরচে কার্পণ্য করেননি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। দুধের উৎপাদন বাড়াতে নেওয়া এ প্রকল্পে শুধু বিজ্ঞাপন বাবদ এখন পর্যন্ত খরচ দেখানো হয়েছে ২৫ কোটি টাকা। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র বলছে, সাধারণত এ ধরনের সরকারি প্রকল্পের প্রচারে এত বিপুল টাকা খরচ হওয়ার কথা নয়।

চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নীতিশ চন্দ্র দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, প্রাণীর চিকিৎসাসেবা দিতে কেনা গাড়িগুলো কর্মকর্তারা ব্যবহার করলে তা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এসব গাড়ির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ ইতিবাচক।

আর প্রকল্পের আওতায় কেনা যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই একটি রূপরেখা থাকা উচিত। যন্ত্রের সংযোজন, প্রশিক্ষণ ও সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বোঝাই যাচ্ছে, এ বিষয়ে কোনো রূপরেখা এখনো নেই। দামি দামি যন্ত্রপাতি কিনে ফেলে রাখা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।