খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শহীদুর রহমান খান অনিয়ম-স্বজনপ্রীতি করে নতুন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে নিজের ছেলে, মেয়ে, শ্যালক-শ্যালিকার ছেলে ও ভাতিজাকে নিয়োগ দিয়েছেন। সব মিলিয়ে উপাচার্য নিজের পরিবারের সদস্য-আত্মীয়দের মধ্যে নয়জনকে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি তাঁর স্ত্রীকেও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নিয়োগে অনিয়মের এসব চিত্র বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে।
অনিয়মের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়াটি দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর অবশেষে উপাচার্যের এই ৯ আত্মীয়স্বজনের নিয়োগ বাতিল করতে বলেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। উপাচার্য শহীদুর রহমানের মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রাক্কালে এমন কঠোর অবস্থানে গেল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আগামী ১১ সেপ্টেম্বর উপাচার্য হিসেবে শহীদুর রহমানের মেয়াদ শেষ হবে।
সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব মো. মাহমুদুল আলমের সই করা এক চিঠিতে উপাচার্যকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ‘বিষয় বিশেষজ্ঞ’ ছাড়া একই ব্যক্তিদের দিয়ে বাছাই বোর্ড গঠন করে ২০টি বিষয়ে নিয়োগ দেওয়া ৭৩ জন শিক্ষকের নিয়োগ বাতিল করতে বলেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এসব বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন আছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ চিঠি পাওয়ার কথা প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার খন্দকার মাজহারুল আনোয়ার।
২০১৫ সালে জাতীয় সংসদে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে উপাচার্য হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহীদুর রহমানকে নিয়োগের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু অভিযোগ ওঠে, নতুন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে।
উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে ২০২০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটের পাঁচ সদস্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিলেন। পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তদন্ত কমিটি গঠন করে ইউজিসি। কমিটি গঠনের এক বছরের বেশি সময় পর চলতি বছরের জানুয়ারিতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়।
তদন্তে উঠে আসে, উপাচার্য নিজের ছেলে শফিউর রহমান খান ও শ্যালক জসীম উদ্দীনকে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শাখা কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দিয়েছেন।
উপাচার্যের চার ভাতিজাও নিয়োগ পান। তাঁরা হলেন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা পদে মুরাদ বিল্লাহ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে সুলতান মাহমুদ, ল্যাব টেকনিশিয়ান পদে ইমরান হোসেন ও অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে মিজানুর রহমান।
উপাচার্যের শ্যালিকার ছেলে সায়ফুল্লাহ হককে নিয়োগ দেওয়া হয় সহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) হিসেবে। ডেটা এন্ট্রি অপারেটর পদে নিয়োগ পাওয়া নিজামউদ্দিন উপাচার্যের আত্মীয়।
উপাচার্যের মেয়ে ইসরাত খানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যে প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, সেটি ত্রুটিযুক্ত বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, উপাচার্যের মেয়ে ২০২০ সালের ১৩ এপ্রিল প্রভাষক পদে আবেদন করেন। এ পদে ৩০ জন প্রার্থী আবেদন করেছিলেন। যাঁদের মধ্যে স্নাতক পর্যায়ের ফলাফলে পিছিয়ে ছিলেন উপাচার্য-কন্যা। তাঁর সিজিপিএ ৩ দশমিক ৩০।
তদন্ত কমিটি বলেছে, উপাচার্যের মেয়েকে নিয়োগের প্রক্রিয়ায় স্বজনপ্রীতি ও ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়েছে।
উপাচার্য নিজের স্ত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সরাসরি অধ্যাপক পদে নিয়োগের চেষ্টা করেছিলেন। উপাচার্যের স্ত্রী ফেরদৌসী বেগম উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা। তিনি ২০২০ সালের ১৩ এপ্রিল খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের অধ্যাপক পদে আবেদন করেন। তবে এ নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত করে দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তদন্ত কমিটি বলেছে, উপাচার্যের স্ত্রী নিয়োগের শর্তই পূরণ করেন না।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উপাচার্য শহীদুর রহমানকে তাঁর পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের নিয়োগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি কমিটিকে বলেছেন, ‘এটা আসলে খুব একটা ভালো কাজ নয়। বিশ্ববিদ্যালয় শুরু করতে গিয়ে এ রকম করতে হয়েছে। আমি এ অন্যায় কাজটি করেছি।’
তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া-সংক্রান্ত চিঠিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, তদন্ত কমিটির কাছে উপাচার্য নিজেই অনিয়মের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তাই তাঁর পরিবারের সদস্য ও আত্মীয় নয়জনের নিয়োগ বাতিল করার ব্যবস্থা করতে হবে।
আর সরাসরি অধ্যাপক নিয়োগের যে বিজ্ঞপ্তিতে উপাচার্যের স্ত্রী আবেদন করেছেন, সেটি বাতিলের ব্যবস্থা করতে হবে।
‘বিষয় বিশেষজ্ঞ’ ছাড়া একই ব্যক্তিদের দিয়ে বাছাই বোর্ড গঠন করে ২০টি বিষয়ে নিয়োগ দেওয়া ৭৩ জন শিক্ষকের নিয়োগ বাতিলের ব্যবস্থা নিতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়টির এক শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনানুযায়ী, অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক নিয়োগের বাছাই বোর্ডে বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ সদস্য থাকার নিয়ম। সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক পদে ‘বিশেষজ্ঞ’ থাকার নিয়ম। যে ৭৩ জন শিক্ষকের নিয়োগ বাতিল করতে বলা হয়েছে, তাঁরা সবাই প্রভাষক বা সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। এর মধ্যে মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের এক শিক্ষকের নিয়োগে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ আছে। কিন্তু এখানে সব শিক্ষককে এক করে ফেলার ভিন্ন কোনো কারণ আছে কি না, তা তাঁরা বুঝতে পারছেন না। এ জন্য শিক্ষকদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে আরও কয়েকটি বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালাটি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা অনুসরণ করে যুগোপযোগী করা, ভবিষ্যতে স্বজনপ্রীতি মাধ্যমে নিয়োগ, ‘বিষয় বিশেষজ্ঞ’ ছাড়া বাছাই বোর্ড গঠন না করাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়—এমন কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকা।