জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল।
সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ভোট হবে আগামী ৭ জানুয়ারি। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। সংঘাত ও সহিংসতা পরিহার করে রাজনৈতিক দলগুলোকে সমাধানের পথ খুঁজে বের করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেছেন, সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধান অসাধ্য নয়।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো এই তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে। তফসিল প্রত্যাখ্যান করে রাজধানীতে তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ করে বাম গণতান্ত্রিক জোট, গণতন্ত্র মঞ্চ, গণ অধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন দল। তফসিলের প্রতিবাদে আজ বৃহস্পতিবার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। এ দিন আধা বেলা হরতাল ডেকেছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। অন্যদিকে এই তফসিলকে স্বাগত জানিয়ে গতকাল সারা দেশে মিছিল করেছে আওয়ামী লীগ।
সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে দলীয় সরকারের অধীনে। এর আগে গত দুটি সংসদ নির্বাচনও দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে। যদিও ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচন এবং ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক আছে।
দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেও একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি। এবার তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে হরতাল–অবরোধের মতো কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো। এমন পরিস্থিতিতে ভোটের তফসিল এবং ২০১৪ সালের মতো আরেকটি একতরফা নির্বাচন রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও সংঘাতময় করে তুলতে পারে।
গতকাল সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের ভাষণেও বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি উঠে এসেছে। অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর নির্বাচনের জন্য কাঙ্ক্ষিত অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে উল্লেখ করে সিইসি বলেন, নির্বাচন প্রশ্নে, বিশেষত নির্বাচনের প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতির প্রশ্নে, দীর্ঘ সময় ধরে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক নেতৃত্বে মতভেদ পরিলক্ষিত হচ্ছে। বহুদলীয় রাজনীতিতে মতাদর্শগত বিভাজন থাকতেই পারে। কিন্তু মতভেদ থেকে সংঘাত ও সহিংসতা হলে তা থেকে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় বিরূপ প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
নির্বাচনে সব দলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে নির্বাচন কমিশন স্বাগত জানাবে উল্লেখ করে সিইসি বলেন, পারস্পরিক প্রতিহিংসা, অবিশ্বাস ও অনাস্থা পরিহার করে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধান অসাধ্য নয়। পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক আস্থা, সহনশীলতা ও সহমর্মিতা টেকসই ও স্থিতিশীল গণতন্ত্রের জন্য আবশ্যকীয় নিয়ামক।
তফসিল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে গতকাল সকাল থেকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের আশপাশে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়। আশপাশের কয়েকটি সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয় পুলিশ। নির্বাচন ভবনের সামনে ও পাশের রাস্তায় পুলিশের পাশাপাশি র্যাব ও বিজিবির সদস্য মোতায়েন করা হয়। দুপুরের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য আরও বাড়ানো হয়। দুপুরে সিইসির সঙ্গে দেখা করতে যান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান।
* তফসিলকে স্বাগত জানিয়ে সারা দেশে আ.লীগের মিছিল। * তফসিল প্রত্যাখ্যান বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর। * তফসিলের প্রতিবাদে আজ সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। আধা বেলা হরতাল ডেকেছে বাম গণতান্ত্রিক জোট।
তফসিল ঘোষণার আগে গতকাল বিকেল পাঁচটায় বৈঠক করে নির্বাচন কমিশন। সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে বৈঠকে নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান, রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীর ও মো. আনিছুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে ভোটের তফসিল চূড়ান্ত করা হয়। পরে সন্ধ্যা সাতটায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সিইসি তফসিল ঘোষণা করেন। প্রায় ১৫ মিনিটের এ ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করে বাংলাদেশ টেলিভিশন।
নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আহ্বান
ভাষণে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও অস্বস্তি পরাভূত করে নির্ভয়ে আনন্দমুখর পরিবেশে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান কাজী হাবিবুল আউয়াল। ভোটারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘নির্বিঘ্নে স্বাধীনভাবে মূল্যবান ভোটাধিকার প্রয়োগ করে পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করে সংসদ ও সরকার গঠনে নাগরিক দায়িত্ব পালন করবেন। ভোট আপনার। ভোট প্রদানে কারও হস্তক্ষেপ বা প্ররোচনায় প্রভাবিত হবেন না।’
কোনোরকম হস্তক্ষেপ বা বাধার সম্মুখীন হলে একক বা সামষ্টিকভাবে তা প্রতিহত করার জন্য ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানান সিইসি। তিনি বলেন, প্রয়োজনে অবিলম্বে কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে অবহিত করবেন। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা যেকোনো মূল্যে যেকোনো অপচেষ্টা প্রতিহত করে ভোটারের ভোটাধিকার প্রয়োগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে আইনত দায়িত্বপ্রাপ্ত ও বাধ্য।
সরকার বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে
নিজের ভাষণে নির্ধারিত সময়ে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতার কথা তুলে ধরেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, আসন্ন সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক এবং শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যে সরকার বারবার সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। কমিশনও তার আয়ত্তে থাকা সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে এবং সরকার থেকে আবশ্যক সব সহায়তা নিয়ে নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ করার বিষয়ে সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবে।
সাহসী এজেন্ট ও গণমাধ্যম প্রসঙ্গ
প্রার্থীদের উদ্দেশে সিইসি বলেন, ‘নির্বাচনের অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে কার্যকর প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কেন্দ্রে কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সাহসী, সৎ, দক্ষ ও অনুগত পোলিং এজেন্ট নিয়োগ করে প্রার্থী হিসেবে আপনাদের নিজ নিজ অধিকার ও স্বার্থ সুরক্ষার প্রাণান্ত চেষ্টা কার্যত আপনাদেরই করতে হবে।’
সিইসি আরও বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হতে পারে কেবল সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বিত সহযোগিতা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে। রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে কার্যকরভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে, কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়, নির্বাচন অধিক পরিশুদ্ধ ও অর্থবহ হয়। তাতে জনমতেরও শুদ্ধতর প্রতিফলন ঘটে।
নির্বাচনের স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম ও নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের ভূমিকার কথা তুলে ধরে সিইসি বলেন, তাঁরা দেশি ও বিদেশি গণমাধ্যম ও পর্যবেক্ষকদের সহযোগিতা কামনা করছেন।
সিইসি বলেন, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় কমিশনের আন্তরিক সমর্থন ও সহযোগিতা থাকবে। অসত্য, মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য সম্প্রচার করে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া ও নির্বাচনকে প্রভাবিত করার যেকোনো অপপ্রয়াস প্রতিহতের সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে।
জনগণের প্রতি আহ্বান
ভোট কারচুপি ঠেকাতেও জনগণের প্রতি আহ্বান জানান সিইসি। তিনি বলেন, জাল ভোট, ভোট কারচুপি, ব্যালট ছিনতাই, অর্থের লেনদেন ও পেশিশক্তির সম্ভাব্য ব্যবহার নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যেকোনো মূল্যে সম্মিলিতভাবে তা প্রতিহত করতে হবে।
সিইসি তাঁর ভাষণে বলেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব প্রার্থী ও দলকে আচরণ বিধিমালা প্রতিপালন করতে হবে। নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদেরও আইন ও বিধিবিধান যথাযথভাবে অনুধাবন, প্রতিপালন ও প্রয়োগ করে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে আরোপিত দায়িত্ব পালন করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ভোটকেন্দ্রগুলোর পারিপার্শ্বিক শৃঙ্খলাসহ প্রার্থী, ভোটার, নির্বাচনী কর্মকর্তাসহ সর্বসাধারণের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া যাবে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। মনোনয়নপত্র বাছাই হবে ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর। রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের ও নিষ্পত্তি হবে ৬-১৫ ডিসেম্বর। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৭ ডিসেম্বর। প্রতীক বরাদ্দ করা হবে ১৮ ডিসেম্বর। ওই দিন থেকে ৫ জানুয়ারি সকাল আটটা পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচার চালানো যাবে। ভোট গ্রহণ ৭ জানুয়ারি, সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত। ভোট হবে ব্যালট পেপারে।
এই সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে ৩০০টি সংসদীয় আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচন করবেন ভোটাররা। এবার সারা দেশে মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার এবং ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসকেরা।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নেয় কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। শুরুতেই তাদের প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত বছর রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে ডেকেছিল ইসি। বিএনপিসহ নয়টি দল সে সংলাপ বর্জন করে। এরপর তাদের আবারও আলোচনার আমন্ত্রণ জানায় ইসি। তবে তাতে বিএনপি সাড়া দেয়নি। বিএনপির নাম উল্লেখ না করলেও বিষয়টি নিজের ভাষণে তুলে ধরেন সিইসি। তিনি নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় সব রাজনৈতিক দল ও জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা কামনা করেন। তিনি বলেন, নিজ নিজ অবস্থান থেকে সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্বশীল আচরণ ও আবশ্যক ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ হবে। গণতন্ত্র সুসংহত হবে।