দুটি জৈবপদ্ধতি উলবাকিয়া ও এসআইটি নিয়ে দেশে গবেষণা হয়েছে। ফলাফলও ভালো।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সমন্বিত মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থার কথা বলেন কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা। এই সমন্বিত ব্যবস্থার অংশ হিসেবে শুধু মেরে না ফেলে এডিসকে ‘ভালো’ মশায় রূপান্তরিত করার চেষ্টার কথা বলছেন গবেষকেরা। এর মধ্যে অন্তত দুটি পদ্ধতি নিয়ে দেশে গবেষণা হয়েছে, ফলও ভালো। এর একটি হলো উলবাকিয়া, অন্যটি এসআইটি পদ্ধতি।
মশা নিয়ন্ত্রণে এই ইতিবাচক প্রচেষ্টার মধ্যে আজ ২০ আগস্ট পালিত হচ্ছে বিশ্ব মশা দিবস।
এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে লার্ভা ধ্বংস করাকেই যথার্থ মানছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। সেভাবে অন্য সিটিগুলোও কাজ করছে। তবে মশা মারতে সমন্বিত উদ্যোগের একটি কাজ হলো, মশাকে ‘ভালো’ করে ফেলা।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় মশার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন প্রাণিবিদেরা। মশা বাস্তুতন্ত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। মশার শূককীট মাছের খাদ্য হিসেবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক মশা পাখি, বাদুড়, গিরগিটি ও ব্যাঙের খাদ্য হিসেবে কাজ করে। আবার কিছু প্রজাতির মশা গুরুত্বপূর্ণ পরাগায়নকারী।
দেশে ২৬ প্রজাতির এডিস মশা আছে। এর মধ্যে এডিস ইজিপ্টাই ও এডিস অ্যালবোপিকটাস প্রধান। তবে ডেঙ্গু সৃষ্টিকারী হিসেবে মূলত দায়ী ইজিপ্টাই। এই প্রজাতির মশাকে ‘ভালো’ করার প্রচেষ্টা হলো উলবাকিয়া। এটি একধরনের ব্যাকটেরিয়া। দেখা গেছে, এডিস অ্যালবোপিকটাসের মধ্যে উলবাকিয়া আছে কিছুটা। তাই এটি ইজিপ্টাইয়ের মতো মারাত্মক ক্ষতিকর নয়।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) সংক্রামক রোগ বিভাগের বিজ্ঞানী মোহাম্মদ শফিউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমরা উলবাকিয়া নিয়ে কিছু গবেষণা করছি। গবেষণাগারে বাংলাদেশি এডিস মশার মধ্যে উলবাকিয়া প্রবেশ করিয়ে আশানুরূপ ফল পেয়েছি। তবে এ ধরনের পদ্ধতি প্রয়োগের আগে সম্ভাব্যতা ও সম্ভাব্য প্রভাব মূল্যায়নে ট্রায়ালের প্রয়োজন আছে।
মাঠপর্যায়ে উলবাকিয়া দুইভাবে প্রয়োগ করা যায়। এক. শুধু পুরুষ মশা ছেড়ে। এতে উলবাকিয়াযুক্ত পুরুষ মশা প্রকৃতিতে স্ত্রী মশার সঙ্গে মিলিত হলে যে ডিম উৎপাদিত হবে, সেগুলো থেকে লার্ভা হবে না। এতে প্রকৃতিতে এডিস ইজিপ্টাই মশার সংখ্যা কমে যাবে। পদ্ধতিটি প্রয়োগ করা হয়েছে সিঙ্গাপুর, ব্রাজিল, মেক্সিকোসহ কয়েকটি দেশে। একে বলা হচ্ছে পপুলেশন সাপ্রেশন।
দ্বিতীয় পদ্ধতিতে স্ত্রী ও পুরুষ উভয় ধরনের মশা, যেগুলোর মধ্যে উলবাকিয়া আছে, সেগুলো প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়া হয়। প্রকৃতিতে উলবাকিয়াযুক্ত স্ত্রী মশা যদি কোনো পুরুষ মশার সঙ্গে মিলিত হয়, তবে যে বাচ্চা হবে, সেগুলো হবে উলবাকিয়াযুক্ত। আর উলবাকিয়াযুক্ত পুরুষ ও স্ত্রী মশা যদি মিলিত হয়, তাহলেও সব বাচ্চা হবে উলবাকিয়াযুক্ত। ফলে কিছু সময় পর প্রকৃতির সব এডিস মশা উলবাকিয়া দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে; অর্থাৎ তাদের আর ডেঙ্গু ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বন্ধ হয়ে যাবে বা একদমই কমে যাবে।
মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, ‘এই পদ্ধতিকে বলা হচ্ছে পপুলেশন রিপ্লেসমেন্ট। পদ্ধতিটি বেশি প্রয়োগ করা হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ফিজিতে এটি প্রয়োগ করা হয়েছে। আমরা এই পদ্ধতি নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। প্রাথমিকভাবে এই পদ্ধতিতে কিছুটা ব্যয় হলেও দীর্ঘ মেয়াদে এটি বেশ সাশ্রয়ী হবে।’
ওয়ার্ল্ড মসকিউটো প্রোগ্রাম উলবাকিয়া মশার প্রসারে কাজ করে। সংস্থাটির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের অন্তত এক কোটি মানুষকে উলবাকিয়া ব্যবহার করে সুরক্ষা দেওয়া গেছে।
মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, বিদেশ থেকে মশা আনার প্রয়োজন নেই। আবার উলবাকিয়া প্রয়োগের সময় মশকনিধন কার্যক্রম বন্ধেরও দরকার নেই। এ-সংক্রান্ত গবেষণায় সাফল্যও আছে।
দীর্ঘ মেয়াদে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণপদ্ধতির আরেকটি হলো স্টেরাইল ইনসেক্ট টেকনিক (এসআইটি) বা কীট বন্ধ্যাকরণ পদ্ধতি। ব্রাজিল, স্পেন, ইতালি, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, চীনসহ বিভিন্ন দেশে মশার বিরুদ্ধে ৩৪টি পাইলট এসআইটি ট্রায়াল চালু রয়েছে। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এডিস মশার এসআইটি নিয়ে কাজ করছে।
বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের খাদ্য ও বিকিরণ জীববিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহ্ফুজা খান প্রথম আলোকে বলেন, এসআইটি একটি পরিবেশবান্ধব ও জীবজ নিয়ন্ত্রণ কৌশল। এখানে গবেষণাগারে মশা উৎপাদন ও বিকিরণের মাধ্যমে পুরুষ মশা বন্ধ্যা করা হয়। পরে বন্ধ্যা পুরুষ মশাগুলোকে প্রকৃতির স্ত্রী মশার সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়। এর ফলে স্ত্রী মশা কোনো বংশবিস্তার করতে পারবে না। এভাবে পর্যায়ক্রমে বন্ধ্যা পুরুষ মশা অবমুক্ত করার মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট এলাকার মশা কমে যায়।
আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থার (আইএইএ) গবেষণা প্রকল্পের সহায়তায় ২০০৮ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের খাদ্য ও বিকিরণ জীববিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের কীট-জীবপ্রযুক্তি বিভাগে এডিস মশার এসআইটি নিয়ে কাজ শুরু হয়।
মাহ্ফুজা খান বলেন, এখন তাঁরা এমন সক্ষমতায় এসেছেন, যাতে সপ্তাহে ৪০ থেকে ৫০ হাজারের বেশি বন্ধ্যা পুরুষ এডিস মশা গবেষণাগারে উৎপাদন করা সম্ভব। তা ছাড়া আইএইএ প্রকল্পের সহায়তায় গবেষণাগারে আধুনিক যন্ত্রপাতি, যেমন পুরুষ মশা পৃথককরণ যন্ত্র, কৃত্রিমভাবে রক্ত খাওয়ানো যন্ত্র (হেমোটেক সিস্টেম) আনা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘এলাকাভিত্তিক সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার একটি কৌশল হিসেবে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ঢাকার নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে এসআইটি পদ্ধতিটি প্রয়োগ করা আমাদের উদ্দেশ্য।’
মশার নিয়ন্ত্রণে উলবাকিয়ার কিছু সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, এটি ব্যয়বহুল। কারণ, বিদেশ থেকে মশা কিনতে হবে। যদি এক লাখ পুরুষ মশা ছাড়া হয়, এমনিতেই ৫০ হাজার মারা যাবে।
আবার গবেষণাগারে তৈরি এসব কৃত্রিম মশা প্রকৃতিতে থাকা স্ত্রী মশার সঙ্গে মিলনের ক্ষেত্রেও সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, প্রকৃতিতে থাকা পুরুষ মশা সেই জায়গা দখল করতে পারে। সব মিলিয়ে হয়তো হাজার দশেক মশা কার্যকর হতে পারে।’ তিনি বলেন, আবার উলবাকিয়া ব্যবহারের সময় মশকনিধন কার্যক্রম বন্ধ রাখার দরকার হয়। সেটাই এর সীমাবদ্ধতা। তিনি বিদেশি মশা না এনে দেশে মশা সৃষ্টির পরামর্শ দেন।
উলবাকিয়া বা এসআইটির সম্প্রসারণে ব্যাপকভাবে গবেষণার প্রয়োজনীয়তার তাগিদ দেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ‘এসব ব্যবস্থা আমাদের দেশের জন্য নতুন। প্রচলিত যে পদ্ধতিতে মশা নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তার সঙ্গে এসব পদ্ধতির কোনো সংঘাত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার।’