কেনা ও উপহার পাওয়া এসব গাড়ি ব্যবহারের সক্ষমতা নেই সিটি করপোরেশনের।
চট্টগ্রাম নগরে বছরজুড়ে ধুলাবালুর যন্ত্রণা লেগে থাকে। সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা ঝাড়ু দিলেও ধুলা রয়ে যায়। ধুলা পরিষ্কারের জন্য একে একে ছয়টি গাড়ি পেয়েছিল সিটি করপোরেশন। কিন্তু এসব গাড়ি উল্টো ধুলা ছড়ায়। তাই দামি গাড়িগুলো ব্যবহার না করে ফেলে রাখা হয়েছে। এভাবে ফেলে রাখতে রাখতে তিনটি গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। যে তিনটি আছে, সেগুলোও ব্যবহৃত হচ্ছে না।
নষ্ট হয়ে যাওয়া গাড়িগুলোর মধ্যে দুটি এখন নিলামে বিক্রি করতে গত ১০ মে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। কোটি টাকা দামের গাড়িগুলো এখন বিক্রি করা হবে নামমাত্র মূল্যে।
এই তিনটি গাড়ি প্রায় অব্যবহৃত অবস্থায় ফেলে রাখায় নষ্ট হয়ে গেছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া দুটি গাড়ি আছে নগরের সাগরিকায় অবস্থিত সিটি করপোরেশনের স্টোরে। এগুলো নিলামে বিক্রি করে দেওয়া হবে। আর নিজেদের টাকায় কেনা গাড়ি পড়ে রয়েছে আগ্রাবাদে।
শুধু ধুলা পরিষ্কারের ছয়টি গাড়ি নয়, অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকা একটি আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স, দুটি অ্যাম্ফিবিয়াস এক্সকাভেটর (উভচর খননযন্ত্র), একটি বিটুমিন স্পেয়ার ট্রাক (রাস্তায় বিটুমিন দেওয়ার গাড়ি) এবং খাদ্য পরীক্ষার ভ্রাম্যমাণ গাড়ি। এই ১১টি গাড়ির আনুমানিক দাম ১৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স ও খাদ্য পরীক্ষাগারের গাড়ি এক দিনের জন্যও ব্যবহার হয়নি। উভচর খননযন্ত্র ও বিটুমিন স্পেয়ার ট্রাক ব্যবহার হচ্ছে না চার বছর ধরে। আর ধুলা পরিষ্কারের তিনটি গাড়ি ব্যবহৃত হয়েছে প্রায় পাঁচ মাস আগে। এগুলো নিয়মিত ব্যবহার করা হয় না।
তবে গাড়িগুলো এভাবে ফেলে রাখায় জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ অপচয় হচ্ছে বলে জানান নগর–পরিকল্পনাবিদেরা। তাঁদের মতে, এগুলো কেনার আগেই এর প্রয়োজনীয়তা এবং এগুলো পরিচালনার জন্য দক্ষ জনবল আছে কি না, যাচাই করা দরকার ছিল।
সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ধুলা পরিষ্কারের গাড়িগুলো মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এগুলো ব্যবহার উপযোগী নয়। যদি সিটি করপোরেশনের টাকায় কেনা হতো, তাহলে দায়ীদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া যেত। আর দীর্ঘদিন ব্যবহার না হওয়ায় অ্যাম্ফিবিয়াস এক্সকাভেটরগুলো ব্যবহার উপযোগী করে সাধারণ এক্সকাভেটর করা হচ্ছে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ২০২০ সালে ২৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকায় ২০টি রোড গাড়ি কিনেছিল। মন্ত্রণালয়ের বাজেটের মন্ত্রীর অভিপ্রায় খাত থেকে ‘রোড সুইপার’ কেনার ব্যয় বহন করা হয়। এই ২০টি গাড়ির তিনটি দেওয়া হয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে।
ফেলে রাখায় নষ্ট, এখন নিলামে
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন রাস্তাঘাটের ধুলাবালু স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিষ্কারের জন্য ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো ৫০ লাখ ৩০ হাজার টাকা দিয়ে একটি গাড়ি কিনেছিল। কিন্তু তা কাজে আসেনি। এর তিন বছর পর ২০১৩ সালের ৮ জুন ধুলা পরিষ্কারের জন্য দুটি গাড়ি দেয় পরিবেশ মন্ত্রণালয়। গাড়ি দুটির দাম ছিল ১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা।
এই তিনটি গাড়ি প্রায় অব্যবহৃত অবস্থায় ফেলে রাখায় নষ্ট হয়ে গেছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া দুটি গাড়ি আছে নগরের সাগরিকায় অবস্থিত সিটি করপোরেশনের স্টোরে। এগুলো নিলামে বিক্রি করে দেওয়া হবে। আর নিজেদের টাকায় কেনা গাড়ি পড়ে রয়েছে আগ্রাবাদে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ২০২০ সালে ২৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকায় ২০টি রোড গাড়ি কিনেছিল। মন্ত্রণালয়ের বাজেটের মন্ত্রীর অভিপ্রায় খাত থেকে ‘রোড সুইপার’ কেনার ব্যয় বহন করা হয়। এই ২০টি গাড়ির তিনটি দেওয়া হয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে।
২০২০ সালের ২৮ অক্টোবর গাড়িগুলোর উদ্বোধন করেছিলেন সিটি করপোরেশনের তৎকালীন প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। গাড়িগুলো চালুর পর থেকে গত সাড়ে তিন বছরে ৪০ থেকে ৫০ দিন চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিটি করপোরেশনের চালকেরা।
ধুলা পরিষ্কারের গাড়িগুলো দেশের সড়কে ব্যবহারের উপযোগী নয় বলে দাবি করেন সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) আকবর আলী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এগুলো দিয়ে সড়ক পরিষ্কার করতে গেলে উল্টো আশপাশের এলাকা ধুলাময় হয়ে যায়। তাই এগুলো খুব একটা ব্যবহার করা হয়নি। সর্বশেষ পাঁচ মাস আগে খুব ভোরে একবার ব্যবহার করা হয়েছিল।
চার কোটি টাকার দুটি গাড়ি এক দিনও ব্যবহার হয়নি
২০২২ সালের ২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে একটি আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স উপহার দিয়েছিল ভারত সরকার। এটির দাম কত, তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি সিটি করপোরেশনের চিকিৎসা ও প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তারা। তবে চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ ধরনের একটি অ্যাম্বুলেন্সের দাম এক থেকে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত হয়। এই গাড়িটির দামও দুই কোটি টাকা হতে পারে।
উপহার পাওয়ার পর গাড়িটি এক দিনের জন্য ব্যবহার করা হয়নি। গাড়িটি কখনো নগরের আন্দরকিল্লায় সিটি করপোরেশনের পুরোনো নগর ভবন প্রাঙ্গণে, কখনো সংস্থাটির দামপাড়া ইয়ার্ডে রাখা হয়। বর্তমানে অ্যাম্বুলেন্সটি নগরের দামপাড়া ইয়ার্ডে পড়ে আছে।
দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব এবং চাহিদা না থাকায় অ্যাম্বুলেন্সটি ব্যবহার করা যাচ্ছে না বলে দাবি করেছেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের আওতায় চারটি মাতৃসদন, একটি জেনারেল হাসপাতালসহ ৫০টি নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও দাতব্য চিকিৎসালয় রয়েছে। হাসপাতালগুলোতে প্রসূতি মায়ের অস্ত্রোপচারের সুবিধা রয়েছে।
এগুলো দিয়ে সড়ক পরিষ্কার করতে গেলে উল্টো আশপাশের এলাকা ধুলাময় হয়ে যায়। তাই এগুলো খুব একটা ব্যবহার করা হয়নি। সর্বশেষ পাঁচ মাস আগে খুব ভোরে একবার ব্যবহার করা হয়েছিল।সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) আকবর আলী
ব্যবহার না হলেও আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সটি সচল আছে বলে জানান তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আকবর আলী। তাঁর মতে, চাহিদা না থাকায় এটি ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আ ম ম মিনহাজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দক্ষ জনবল ও চাহিদার অভাবের কথা বলে দামি ও গুরুত্বপূর্ণ অ্যাম্বুলেন্সটি ফেলে রেখে নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। এটি চালু থাকলে মানুষ স্বল্প টাকায় ব্যবহার করতে পারতেন। এখন তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন।
এদিকে নগরের বিবিরহাটে সাড়ে ৫ হাজার বর্গফুট জায়গার ওপর আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগার নির্মাণ করা হয়েছিল। সিটি করপোরেশনের এই প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন যন্ত্রপাতির পাশাপাশি একটি গাড়িও কেনা হয়েছিল। জার্মানির একটি সংস্থার দেওয়া এই গাড়িটির দাম আনুমানিক দুই কোটি টাকা। গাড়িটি পাঁচ বছর আগে দেওয়া হলেও এক দিনের জন্যও ব্যবহার করা হয়নি বলে জানান যান্ত্রিক শাখার কর্মকর্তারা। বর্তমানে গাড়িটি সিটি করপোরেশনের দামপাড়া ইয়ার্ডে পড়ে আছে।
এখন অন্য কাজে ব্যবহারের চেষ্টা
নগরের খাল খননের জন্য ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকায় দুটি হাইড্রোলিক অ্যাম্ফিবিয়াস এক্সকাভেটর কিনেছিল সিটি করপোরেশন। করপোরেশনের নিজস্ব তহবিল থেকে কেনা এসব খননযন্ত্র খালের মধ্যেও ভেসে ভেসে মাটি খনন করতে পারত। তবে ২০১৯ সালের পর থেকে এই দুটি খননযন্ত্র আর ব্যবহার করেনি সিটি করপোরেশন। এখন যন্ত্রগুলো কেটে সাধারণ খননযন্ত্র (শুধু ভূমিতে চলতে পারবে) বানানো হয়েছে।
দামি খননযন্ত্র দুটি পাল্টে ফেলায় সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। তাঁদের মন্তব্য, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ কয়েক বছরের মধ্যে শেষ হবে। এরপর খাল খননের কাজ সিটি করপোরেশনের কাঁধে আসবে। তখন এ ধরনের যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হবে। এগুলো যদি ঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো, তাহলে ওই সময় ব্যবহার করা যেত।
এ ছাড়া সড়ক পিচঢালাই (কার্পেটিং) করার আগে বিটুমিন দেওয়ার জন্য বিটুমিন স্পেয়ার ট্রাক নামের একটি গাড়ি কিনেছিল ৭০ লাখ টাকা দিয়ে। ২০২০ সালের শুরুতে এই গাড়ি কেনা হয়। কেনার পর পরীক্ষামূলকভাবে ৭ থেকে ১০ দিন ব্যবহার করা হয়েছিল। এখন গাড়িটি কেটে পানির ভাউজারে পরিণত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
অ্যাম্ফিবিয়াস এক্সকাভেটর ও বিটুমিন স্পেয়ার ট্রাক ব্যবহার না হওয়ার প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) মো. আকবর আলী দাবি করেন, অ্যাম্ফিবিয়াস এক্সকাভেটরগুলো খালে নামানোর জন্য যে পরিমাণ জায়গা দরকার, তা নেই। এগুলো কোনো কাজে আসছিল না বলে কেটে সাধারণ এক্সকাভেটর করা হয়েছে। আর বিটুমিন স্পেয়ার ট্রাকও কেউ ব্যবহার করে না। তাই পাল্টে পানির ভাউজার করা হবে।
দামি গাড়ি ও যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণে সিটি করপোরেশনের দুর্বলতা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সভাপতি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের যন্ত্রপাতি ও গাড়ি কেনার আগে দক্ষ জনবল ও অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি নিশ্চিত করা দরকার ছিল। মন্ত্রণালয়গুলোর দায়িত্ব ছিল এগুলোর ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণে সিটি করপোরেশনের সক্ষমতা আছে কি না, তা দেখা। তাহলে জনগণের এত অর্থ অপচয় হতো না।