বিআরটি

একটি ‘মহাদুর্ভোগের’ প্রকল্প 

কর্তৃপক্ষ হতাশা প্রকাশ করেই দায় সারছে। প্রকল্পের পদে পদে অব্যবস্থাপনা। কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। 

‘আশা করি, এ সড়কে আগামী বর্ষাকালে মানুষের ভোগান্তি আর হবে না। এ বর্ষাকালটাই হবে ভোগান্তির শেষ বর্ষাকাল।’ গত বছর ৩ সেপ্টেম্বর টঙ্গীর চেরাগ আলী এলাকায় বিআরটি প্রকল্পের চলমান কাজ পরিদর্শন শেষে এ আশ্বাস দিয়েছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছিলেন, চলতি ডিসেম্বরে বিআরটি প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।

এক বছর পর ১৬ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে সড়কমন্ত্রী বলেছেন, বিআরটি প্রকল্প এখন গলার কাঁটা। 

বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের জয়দেবপুর পর্যন্ত ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার পথে বিআরটি হচ্ছে। কোথাও উড়ালপথে, কোথাও বিদ্যমান সড়কে চলাচল করার কথা বিশেষ বাস। 

কারণ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যেসব ক্রেন ভাড়া করেছে, সেগুলোর সক্ষমতায় ঘাটতি আছে। ক্রেন ও নির্মাণকাজে ব্যবহৃত ভারী যানের চালকদের কারোরই যথাযথ লাইসেন্স নেই। নির্মাণ এলাকা মানসম্মতভাবে বেড়া দিয়ে আটকে দেওয়ার জন্য যে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান এবং দক্ষতা দরকার, তা নেই ঠিকাদারের।

পাঁচ বছর আগে এ প্রকল্পের নির্মাণকাজের শুরু থেকেই অব্যবস্থাপনার কারণে মানুষ যানজটে ভুগছে। এখন বৃষ্টি হলে বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত স্থানে স্থানে হাঁটুপানি জমে যাচ্ছে। বৃষ্টি ছাড়া অন্যান্য দিনেও সড়কের খানাখন্দ ও নির্মাণকাজের কারণে সড়ক সরু হওয়ায় যানজট লেগেই থাকছে। এক ঘণ্টার যাত্রা কখনো কখনো পাঁচ-সাত ঘণ্টা পর্যন্ত লাগছে। বিআরটি প্রকল্প এখন যেন মহাদুর্ভোগের আরেক নামে পরিণত হয়েছে। 

গত কয়েক বছরে সড়কমন্ত্রী, মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রকল্প কর্মকর্তারা—নির্মাণকাজ পরিদর্শনে গিয়ে বহুবার ভোগান্তি নিরসনের আশ্বাস দিয়েছেন, চালুর দিনক্ষণ জানিয়েছেন। কিন্তু অবস্থার কিছুই পরিবর্তন হয়নি। এক দশক আগে নেওয়া এ প্রকল্পের নির্মাণকাজ আর শেষ হয় না। ভোগান্তিও যায় না। 

২০১২ সালে বিআরটি প্রকল্প নেওয়া হয়। কিছুটা উড়ালপথ, কোথাও বিদ্যমান সড়কে—বিশেষ বাস দিয়ে ২০১৬ সালে নতুন এ ব্যবস্থা চালুর কথা ছিল। প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, বিআরটি চালু হলে ঘণ্টায় ২০ হাজার যাত্রী যাতায়াত করতে পারবে। যানজট, সিগন্যাল কিংবা অন্য কোনো বাধায় বাস আটকে থাকবে না।

গত আগস্ট পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে ৮১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে ১০৯ শতাংশ, যা টাকার অঙ্কে ২ হাজার ২২৫ কোটি টাকা।

গতকাল বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। মন্ত্রণালয়ের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী প্রথম আলোকে বলেন, তিনি গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রকল্প কর্মকর্তা ও ঠিকাদারকে নিয়ে বৈঠক করেছেন। ব্যস্ত সড়কের কারণে শুক্র ও শনিবার ছাড়া কাজ করা যায় না। এখন থেকে রাতে বেশি কাজ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তিনি দাবি করেন, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে বৃষ্টিতে যানজট বেড়েছিল। এখন যানজট কমেছে। বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণকাজ এবং এ পথে ভিআইপিদের চলাচলসহ আরও অনেক কারণে যানজট হয়। তিনি জানান, আগামী মার্চে প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্য ঠিক করেছেন তাঁরা। 

যাত্রীর নিত্যদুর্ভোগের জীবন

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১৯ সালে বিআরটি প্রকল্প থেকে করা এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, টঙ্গী কলেজগেট থেকে ভোগরা বাইপাস পর্যন্ত অংশে দিনে গড়ে ২৪ হাজার ৭৫৪টি যানবাহন চলাচল করে। চলতি বছরের শুরুতে ঢাকা মহানগর পুলিশের এক সমীক্ষায় এসেছে, আবদুল্লাহপুর হয়ে দৈনিক প্রায় ৪০ হাজার যানবাহন চলাচল করে। 

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, চার বছরের প্রকল্প ১০ বছরেও শেষ হলো না। ব্যয় বাড়ল। গার্ডারচাপায় মানুষ মারা গেল। লাখ লাখ মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। এর পেছনে দায়ী কে—এটা নিয়ে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় বা সরকারের কোনো সংস্থা প্রশ্ন তুলছে না। এখন পর্যন্ত প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে জবাবদিহি করতে হয়নি। শুধু গার্ডারচাপায় ঠিকাদারকে দায়ী করা হয়েছে। কিন্তু ঠিকাদারকে জরিমানা করা, কালোতালিকাভুক্ত করা কিংবা অন্য কোনো শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি।

প্রকল্পের কাজ বাকি রেখেই উত্তরা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত উড়ালপথের একাংশ যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ। পুলিশের আশঙ্কা, এতে মানুষের দুর্ভোগ না কমে বাড়তে পারে।

বিমানবন্দর থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত এলাকায় বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ পথ শুধু উত্তরা, টঙ্গী ও গাজীপুরের মানুষই ব্যবহার করে না; বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের সব জেলার মানুষের মূল পথ এটি। ঢাকার সঙ্গে কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, এমনকি বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের মানুষের সড়ক যোগাযোগেরও বিকল্প পথ এটি। উত্তরবঙ্গগামী যানবাহনের একটা বড় অংশ চলে উত্তরা-আবদুল্লাহপুর হয়ে। 

এখন প্রায়ই ট্রাফিক পুলিশ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিআরটি প্রকল্প এলাকা এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিচ্ছে। সর্বশেষ ২৪ অক্টোবর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়, ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’–এর প্রভাবে প্রবল বৃষ্টিপাত হওয়ায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের বিভিন্ন অংশে বড় বড় গর্তের কারণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে খিলক্ষেত-উত্তরা হয়ে গাজীপুরমুখী যান চলাচলে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটছে। এ অবস্থায় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া এ সড়ক ব্যবহার না করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। গত ১০ আগস্ট পুলিশ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিআরটি প্রকল্প এলাকা দিয়ে যাতায়াতের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সময় হাতে নিয়ে বের হওয়ার পরামর্শ দেয়।

ভোগান্তির শেষ কবে?

প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে নির্মাণকাজ করতে গিয়ে তিন দফায় দুর্ঘটনায় ছয়জনের প্রাণ গেছে। সর্বশেষ বিমানবন্দর সড়কে গত ১৫ আগস্ট গার্ডারচাপায় একই পরিবারের পাঁচজন মারা গেছেন। ঋণদাতা সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে, নিরাপত্তা পুরোপুরি নিশ্চিত না করে আবার কাজ শুরু করা যাবে না। এরপর থেকে ভারী কাজ বন্ধ আছে। বিআরটি প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, এ প্রকল্পে যানবাহন ব্যবস্থাপনা, সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ এবং নির্মাণকাজের সময় আশপাশ নিরাপদ রাখার জন্য প্রতি কিলোমিটারে মাসে ৯৩ হাজার টাকা ঠিকাদারের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ পুরো প্রকল্প এলাকায় মাসে ১৯ লাখ টাকা দেওয়া হচ্ছে শুধু ব্যবস্থাপনায়। এরপরও যানজট হচ্ছে, গার্ডার ধসে প্রাণহানি হচ্ছে।

গাজীপুরের মধ্য দিয়ে গেছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক। দীর্ঘদিন ধরে এ সড়কে চলছে বিআরটি প্রকল্পের কাজ। ফলে যানজট লেগেই থাকে। গত সোমবার চান্দনা চৌরাস্তায়

বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা আছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের এমন একজন প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, কোথাও কোনো নির্মাণকাজ শুরুর প্রথমেই এ কাজের জন্য কতটুকু জায়গা সরাসরি লাগবে, এর প্রভাবক এলাকা কতটুকু, তা চিহ্নিত করতে হয়। এরপর প্রয়োজনমতো বেড়া দেওয়া এবং নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ করতে হয়। বিআরটি প্রকল্পে এখন পর্যন্ত প্রভাবক এলাকা চিহ্নিত করে তা নিরাপদ করার কোনো চেষ্টাই করা হয়নি।

বিআরটি প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এডিবির চাওয়ামতো নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। কারণ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যেসব ক্রেন ভাড়া করেছে, সেগুলোর সক্ষমতায় ঘাটতি আছে। ক্রেন ও নির্মাণকাজে ব্যবহৃত ভারী যানের চালকদের কারোরই যথাযথ লাইসেন্স নেই। নির্মাণ এলাকা মানসম্মতভাবে বেড়া দিয়ে আটকে দেওয়ার জন্য যে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান এবং দক্ষতা দরকার, তা নেই ঠিকাদারের। এ পরিস্থিতিতে কাজ শুরুর বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। 

প্রকল্পের কাজ বাকি রেখেই উত্তরা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত উড়ালপথের একাংশ যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ। পুলিশের আশঙ্কা, এতে মানুষের দুর্ভোগ না কমে বাড়তে পারে।

প্রকল্প-সংক্রান্ত নথি অনুসারে, বিআরটি প্রকল্পের নির্মাণকাজের চারটি ভাগ। এর মধ্যে উড়ালপথ ও সড়ক নির্মাণের দায়িত্ব পালন করছে তিনটি চীনা কোম্পানি। এগুলো হচ্ছে চায়না গেজহুবা গ্রুপ, জিয়াংশু প্রভিন্সিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ এবং ওয়েহেই ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেটিভ। আর গাজীপুরে ডিপো নির্মাণের দায়িত্বে ছিল দেশীয় কোম্পানি সেল-ইউডিসি। এদের কাজ আগেই শেষ হয়েছে। 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহনবিশেষজ্ঞ মো. হাদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তি ও বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের যুগে একটি বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়নে এত দীর্ঘ সময় লাগার বিষয়টি অস্বাভাবিক। তিনি বলেন, দেশের প্রধান বিমানবন্দর এ পথে। গাজীপুরে শিল্প এলাকা রয়েছে। এমন একটা পথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু মানুষগুলোর যে শারীরিক ও মানসিক ধকল যাচ্ছে, এর ক্ষতি আরও অনেক। এভাবে দিনের পর দিন সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কেন চলছে, এর দায় কার, তা খুঁজে বের করা উচিত।