ডেঙ্গুতে মৃত্যু পর্যালোচনায় কমিটি হয়েছে। এত মৃত্যুর পরও কমিটি ঠিকভাবে কাজ করছে না।
ডেঙ্গুতে মৃত্যু হাজার ছাড়াল। এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এত মৃত্যু হবে, এটা অনেকেই ভাবেননি। বাংলাদেশকে কেন এত মৃত্যুর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে, সেই বিশ্লেষণ স্বাস্থ্য বিভাগের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। ডেঙ্গু মৃত্যু পর্যালোচনার একটি কমিটি হয়েছে, তবে কাজ হচ্ছে না।
দেশের ইতিহাসে এ বছরই ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন, সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দেওয়া তথ্যে বলা হয়েছে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় (শনিবার সকাল ৮টা থেকে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত) সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা হলো ১ হাজার ৬। এর আগে ডেঙ্গুতে দেশে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছিল গত বছর—২৮১ জন।
সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে নতুন করে ২ হাজার ৮৮২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে এ বছর ২ লাখ ৬ হাজার ২৮৮ জন রোগী হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছেন। ঢাকা শহরের বাইরে রোগীর সংখ্যা ঢাকা শহরের চেয়ে বেশি। যদিও ঢাকা শহরের ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেশি।
ঢাকা শহরে কেন মৃত্যু বেশি, শিশুদের কেন মৃত্যু বেশি, পুরুষের তুলনায় নারীরা কেন বেশি মারা যাচ্ছে—এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেত মৃত্যু পর্যালোচনা থেকে। আমার আশ্চর্য লাগছে, গুরুত্বপূর্ণ এই কাজটি করতে এত উদাসীনতা কেন? আমরা জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ হাতছাড়া করছি।জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে–নজির আহমেদ
এ বছর ডেঙ্গুতে বেশি মৃত্যুর কারণ এখনো বের করতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ডেঙ্গু বিশেষজ্ঞ ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি। গত কয়েক মাসে কেউ বলেছেন, এ বছর ডেঙ্গুর উপসর্গে পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। কেউ বলেছেন, এ বছর আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ‘শক সিনড্রোম’ বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, ৫৬ শতাংশ মৃত্যু হয়েছে রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে।
জুন মাস থেকে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা কারণ বিশ্লেষণের জন্য মৃত্যু পর্যালোচনার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। কেন্দ্রীয়ভাবে এই ধরনের কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে বা অতীতে করেছে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। কিন্তু এ বছর কাজটি করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা। একটি কমিটিও হয়েছে। ‘ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু পর্যালোচনা কমিটি’র সভাপতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক আহমেদুল কবীর।
২৭ আগস্ট রাজধানীর একটি হোটেলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণবিষয়ক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে আহমেদুল কবীর বলেছিলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে মৃত্যুর পর্যালোচনার তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে, সাংবাদিকদেরও জানানো হবে। ওই অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আনোয়ার হোসেন হাওলাদার উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানের ১৫ দিন পর ১১ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু পর্যালোচনা কমিটির সদস্যসচিব মো. আবুল কালাম আজাদ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিঠি দিয়ে প্রতিটি হাসপাতালে কমিটি গঠন করার কথা বলেন। চিঠিতে বলা হয়, তিন কার্যদিবসের মধ্যে কমিটি করতে হবে। কমিটিতে মেডিসিন, শিশু, গাইনি, জনস্বাস্থ্য, ল্যাবরেটরি মেডিসিন ও সিসিইউ বিশেষজ্ঞ রাখার কথা বলা হয়।
গতকাল ডেঙ্গুতে মৃত্যু পর্যালোচনার ফলাফল জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে মো. আবুল কালাম আজাদ কোনো তথ্য দেননি। তিনি আহমেদুল কবীরের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। কমিটির সদস্য আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীনও একই পরামর্শ দেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিটির একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, পর্যালোচনার কাজটি শেষ হলে কোন কারণে বেশি মৃত্যু হচ্ছে সেটি জানা যেত, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে রোগ ব্যবস্থাপনা কী হচ্ছে, তা–ও বোঝা যেত। কমিটির অন্য একজন সদস্য বলেছেন, ‘কাজটি নিয়ে আমরা নিজেরাই অন্ধকারে আছি।’
এ বছর ডেঙ্গুতে বেশি মৃত্যুর কারণ এখনো বের করতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ডেঙ্গু বিশেষজ্ঞ ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি। গত কয়েক মাসে কেউ বলেছেন, এ বছর ডেঙ্গুর উপসর্গে পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। কেউ বলেছেন, এ বছর আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ‘শক সিনড্রোম’ বেশি।
গতকাল একাধিকবার ফোন দিয়ে আহমেদুল কবীরের সঙ্গে কথা বলা যায়নি। খুদে বার্তা পাঠালে তারও কোনো উত্তর তিনি দেননি।
পরিস্থিতি জানা–বোঝা ও করণীয় নির্ধারণে মৃত্যু পর্যালোচনার দরকার আছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা। কিন্তু কাজটি স্বাস্থ্য বিভাগ করেনি। স্বাস্থ্য বিভাগের আন্তরিকতার ঘাটতি ও অদক্ষতার কারণে কাজটি হয়নি বলে অনেকে মনে করেন। জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে–নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকা শহরে কেন মৃত্যু বেশি, শিশুদের কেন মৃত্যু বেশি, পুরুষের তুলনায় নারীরা কেন বেশি মারা যাচ্ছে—এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেত মৃত্যু পর্যালোচনা থেকে। আমার আশ্চর্য লাগছে, গুরুত্বপূর্ণ এই কাজটি করতে এত উদাসীনতা কেন? আমরা জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ হাতছাড়া করছি।’
দেশে বড় আকারে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয় ২০০০ সালে। তখন ডেঙ্গু চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা অনেকের কাছে নতুন ছিল। ওই বছর ডেঙ্গুতে ৯৩ জনের মৃত্যু হয়।
এরপর প্রতিবছর মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। কোনো কোনো বছর মৃত্যু হয়েছে। তবে ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মানুষ আক্রান্ত হলেও মৃত্যুর কোনো তথ্য নেই।
করোনা মহামারির আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে বড় আকারে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। ওই বছর ডেঙ্গুতে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন, মারা যান ১৭৯ জন। আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৮৬৮ জন। আর এ বছর প্রথম ৯ মাসে মারা গেছেন ১ হাজার ৬ জন।