দেশে গত তিন বছর ধরে পশু কোরবানির সংখ্যা বাড়ছে। সরকারি তথ্য বলছে, গত বছরের ঈদুল আজহার তুলনায় এবার ৩ লাখ ৬৭ হাজারের বেশি পশু কোরবানি হয়েছে। তবে দেশে করোনা মহামারি দেখা দেওয়ার আগে যে পরিমাণ পশু কোরবানি হতো, তা এখনো হয় না।
কৃষি অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, মহামারির আগে মানুষের যে আর্থিক সক্ষমতা ছিল, তা এখন নেই। মূল্যস্ফীতির কারণে দৈনন্দিন খরচ বেড়ে যাওয়ায় মানুষের প্রকৃত আয় ও সঞ্চয় কমে গেছে। প্রকৃত আয় ও সঞ্চয় কমে যাওয়ায় অনেক মানুষের জন্য কোরবানি দেওয়া কঠিন হয়ে গেছে। এ কারণে এখন পশু কোরবানির সংখ্যা মহামারির আগের সময়ের চেয়ে কম।
২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার সংক্রমণ দেখা দেয়। সরকারি সংস্থা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবমতে, ২০১৯ সালে দেশে ১ কোটি ৬ লাখ পশু কোরবানি হয়েছিল। এবারের ঈদুল আজহায় ১ কোটি ৪ লাখ পশু কোরবানি হয়েছে। অর্থাৎ, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে দুই লাখ পশু কম কোরবানি হয়েছে।
আগে যাঁরা এককভাবে গরু কোরবানি দিতেন, তাঁদের অনেকেই এবার যৌথভাবে (ভাগে) দিয়েছেন। আবার গ্রামে দেখেছি, আগে গরু কোরবানি বেশি হতো, এবার খাসি কোরবানি বেশি হয়েছে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে। মানুষের আর্থিক সক্ষমতা কমায় কোরবানি কমেছে।বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ূন কবির
অধিদপ্তরের গত আট বছরের (২০১৭-২০২৪) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, করোনার আগপর্যন্ত প্রতিবছর দেশে পশু কোরবানি বাড়ছিল। তবে করোনা দেখা দিলে ২০২০ সালে পশু কোরবানি কমে যায়। সে বছর ৯৪ লাখ ৫০ হাজার পশু কোরবানি হয়। মহামারির মধ্যে ২০২১ সালে পশু কোরবানি আরও কমে। তবে মহামারির প্রকোপ কমে এলে ২০২২ সালে পশু কোরবানি বাড়ে। পরবর্তী দুই বছরে (২০২৩ ও ২০২৪ সাল) এই বাড়তি ধারা অব্যাহত থাকতে দেখা যায়। কিন্তু তা এখনো করোনার আগের অবস্থায় পৌঁছায়নি।
এবার দেশে ঈদুল আজহা উদ্যাপিত হয় ১৭ জুন। পরদিন ১৮ জুন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এবারের পশু কোরবানির চিত্র তুলে ধরে।
মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর মূলত পশু কোরবানির হিসাব করে থাকে। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেন, স্তরায়িত দৈব নমুনায়নের (স্ট্র্যাটিফায়েড র্যান্ডম স্যাম্পলিং) ভিত্তিতে তথ্য সংগ্রহ করে এবারের হিসাব করা হয়েছে। প্রতিটি উপজেলার অন্তত এক শতাংশ নমুনা সংগ্রহ করে হিসাবটি করা হয়েছে। যেমন—একটি উপজেলায় এক শটি গ্রাম থাকলে তার মধ্যে অন্তত একটি গ্রামে কোরবানি দেওয়া পশুর তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এবার কোরবানির পশু অবিক্রীত ছিল ২৫ লাখ ৭১ হাজার। ২০২১ সালের পর যা সর্বোচ্চ। ২০২১ সালে ২৮ লাখের বেশি কোরবানির পশু অবিক্রীত ছিল।
নমুনায়নের ভিত্তিতে হিসাব তৈরির বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ রেয়াজুল হক, এবার যে পশু কোরবানি দেওয়ার সংখ্যা বেড়েছে, তা মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কিছুটা হলেও বাড়ার বিষয়টিকে নির্দেশ করে।
তবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এখনো করোনা মহামারির আগের অবস্থায় ফেরেনি বলে মনে করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ূন কবির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে যাঁরা এককভাবে গরু কোরবানি দিতেন, তাঁদের অনেকেই এবার যৌথভাবে (ভাগে) দিয়েছেন। আবার গ্রামে দেখেছি, আগে গরু কোরবানি বেশি হতো, এবার খাসি কোরবানি বেশি হয়েছে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে। মানুষের আর্থিক সক্ষমতা কমায় কোরবানি কমেছে।’
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এবার কোরবানির পশু অবিক্রীত ছিল ২৫ লাখ ৭১ হাজার। ২০২১ সালের পর যা সর্বোচ্চ। ২০২১ সালে ২৮ লাখের বেশি কোরবানির পশু অবিক্রীত ছিল।
যে বছর দেশে করোনা দেখা দেয়, সেই ২০২০ সালে অবিক্রীত ছিল ২৪ লাখ ৪৭ হাজার কোরবানির পশু। আগের বছর ২০১৯ সালে অবিক্রীত ছিল ১১ লাখ ৭৪ হাজার পশু। অর্থাৎ, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে দ্বিগুণের বেশি পশু অবিক্রীত ছিল। ২০১৮ সালে অবিক্রীত ছিল ছিল ১০ লাখ ১৯ হাজার পশু। ২০১৭ সালে ১১ লাখ ৩৫ হাজার।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, এবার কোরবানির পশুর উৎপাদন বেশি ছিল। তাই পশু অবিক্রীত থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তা ছাড়া অবিক্রীত এই পশু সামনে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে দরকার পড়বে।
অবশ্য কোরবানির পশু নিয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে প্রশ্ন আছে। তা ছাড়া অন্তত তিনজন খামারি প্রথম আলোকে বলেছেন, এবার তাঁদের প্রস্তুত করা সব পশুই বিক্রি হয়েছে। এমনকি কোরবানির আগের দিন দুপুর নাগাদ রাজধানীর বিভিন্ন পশুর হাট ফাঁকা দেখা গেছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত বছরের মতো এবারও সবচেয়ে কম পশু কোরবানি হয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগে। এই সংখ্যা ৩ লাখ ৯২ হাজার ৫১৭ টি। এরপর কম পশু কোরবানি হয়েছে সিলেট বিভাগে, ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৭৪২টি। আর সবচেয়ে বেশি পশু কোরবানি হয়েছে ঢাকা বিভাগে। এই সংখ্যা ২৫ লাখ ২৯ হাজার ১৮২ টি।
ময়মনসিংহ ও সিলেট—এই দুই বিভাগেই চারটি করে জেলা রয়েছে। তবে সিলেটের তুলনায় ময়মনসিংহ বিভাগে জনসংখ্যা বেশি। অর্থাৎ, বেশি জনসংখ্যা থাকলেও সিলেটের তুলনায় ময়মনসিংহ বিভাগে কম কোরবানি হয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ূন কবির প্রথম আলোকে বলেন, সিলেটের অনেক মানুষ বিদেশে থাকেন। তাঁরা দেশে থাকা আত্মীয়-স্বজনের কাছে কোরবানির জন্য টাকা পাঠান। আর যে বিভাগগুলোয় বিদেশ থেকে সবচেয়ে কম অর্থ আসে, তার মধ্যে ময়মনসিংহ অন্যতম। তা ছাড়া এই বিভাগের জামালপুর জেলা নদীভাঙন প্রবণ এলাকা। সার্বিকভাবে ময়মনসিংহ বিভাগের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কম। সে কারণে ময়মনসিংহ বিভাগে কোরবানিও কম হয়।