কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া সমুদ্রসৈকতের শাপলাপুর পয়েন্ট। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় এখানে ভেসে আসে প্রায় ৩৫ কেজি ওজনের বিশাল একটি মৃত মা কাছিম। কাছিমটির পেছনের বাঁ পা কাটা। মুখে ও পিঠে আঘাতের চিহ্ন। সম্ভবত ধারালো কিছুর আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয় এটি।
সেই রাতেই টেকনাফের লম্বরী পর্যটন ঘাট, দরগার ছড়াসহ বিভিন্ন সৈকতে ভেসে আসে আরও অন্তত ৯টি মা কাছিমের মৃতদেহ। এর আগের দিন বুধবার বাহারছড়ার বড় ডেইল, শিলখালী চৌকিদারপাড়া, মাথাভাঙ্গা ও উত্তর শিলখালী সৈকতে ১৫টি মা কাছিম ভেসে আসে। সব মিলিয়ে দুই দিনে কেবল টেকনাফের সৈকতে ভেসে আসা কাছিমের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫টিতে। ভেসে আসা একাধিক কাছিমের পেটে ডিম ছিল বলে পরিবেশকর্মীরা জানিয়েছেন।
টেকনাফে মা কাছিমের প্রজননের জন্য কোডেকের গড়ে তোলা হ্যাচারিতে পাহারাদার হিসেবে কাজ করেন মোহাম্মদ ইউসুফ, মো. হাশেম, আবদুল মান্নান, আবদুল মজিদ, মনির আহমদ, শফিউল্লাহ ও দিল মোহাম্মদ। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা ১০ থেকে ২৫ বছর এ কাজের সঙ্গে জড়িত। এর আগে কখনো এত কাছিম মরতে দেখেননি। এ বছর সমুদ্রতটে প্রচুর মৃত মা কাছিম পাওয়া যাচ্ছে, যা খুবই হতাশাজনক। ডিম পাড়ার জন্য নিরাপদ স্থানের খোঁজে ছিল মা কাছিমগুলো। জালে আটকা পড়লে জেলেরা পিটিয়ে হত্যা করেন সেগুলো।
বেসরকারি সংস্থা কোডেকের নেচার অ্যান্ড লাইফ প্রকল্পের কর্মকর্তা অসীম বড়ুয়া বলেন, গভীর সাগর থেকে হাজার কিলোমিটার উপকূল পাড়ি দিয়ে মা কাছিমগুলো শীতের মৌসুমে বালুকাময় সৈকতে ডিম পাড়তে ছুটে আসে। সৈকতের কূলের কাছাকাছি এসে মা কাছিমগুলো জেলেদের পুঁতে রাখা নিষিদ্ধ জালে আটকা পড়ে মারা যাচ্ছে। কিছু কাছিম মারা পড়ছে মাছ ধরার ট্রলার অথবা গভীর সাগরে চলাচলকারী জাহাজে ধাক্কা খেয়ে। ডিম পাড়তে আসা বেশির ভাগ কাছিম জলপাই রঙের (অলিভ রিডলে)। তারা একসঙ্গে ৩০ থেকে ১২০টি পর্যন্ত ডিম পাড়ে।
টেকনাফের মহেশখালিয়াপাড়া ও বাহারছড়ার শামলাপুর এলাকার জেলে আবদুল আমিন ও আজিজুল ইসলাম সোনাদিয়া–সেন্ট মার্টিন দ্বীপ এলাকায় মাছ ধরেন। তাঁরা জানান, এ এলাকার প্রায় ১২০ কিলোমিটার উপকূলে পুঁতে রাখা হয়েছে অন্তত ছয় হাজার নিষিদ্ধ বিহিঙ্গি ও কারেন্ট জাল। গভীর সাগর থেকে ডিম পাড়তে কাছিমগুলো যখন উপকূলের দিকে ছুটে আসে, তখন জালে আটকা পড়ে। এ সময় ক্লান্ত ও দুর্বল হয়ে পড়া গর্ভবতী মা কাছিমগুলোকে লাঠি কিংবা ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হত্যা করে সাগরে ফেলে দেন জেলেরা। জোয়ারের সময় মৃতদেহগুলো সমুদ্রসৈকতে ভেসে আসে।
এ ব্যাপারে বাহারছড়ার শামলাপুর ফিশিং বোট মালিক সমিতির সভাপতি বেলাল উদ্দিন বলেন, সাগরে মাছ ধরার নৌযান রয়েছে প্রায় ছয় হাজার। নৌযানের জেলেদের নিষেধ করা আছে, মাছ ধরার জালে কাছিম আটকা পড়লে হত্যা না করে ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু তারপরও মা কাছিম মারা যাচ্ছে।
উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, উপকূলের নিষিদ্ধ জাল উচ্ছেদের জন্য মৎস্য বিভাগ ও কোস্টগার্ড প্রায় সময় অভিযান পরিচালনা করে। বিপুলসংখ্যক নিষিদ্ধ জাল জব্দ করে আগুনে ধ্বংসও করা হয়। তারপরও মা কাছিমের মৃত্যু রোধ করা যাচ্ছে না।
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা দিপু প্রথম আলোকে বলেন, দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাং, নয়াপাড়া, মহেশখালিয়াপাড়া, বাহারছড়া, উখিয়ার মনখালী, ছেপটখালী, পাটোয়ারটেক, ইনানী, কক্সবাজারের হিমছড়ি, দরিয়ানগর, কলাতলী সৈকতসহ মহেশখালী ও সোনাদিয়া উপকূলে প্রতিদিন গড়ে কয়েকটি করে মৃত মা কাছিম ভেসে আসছে। ২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২০ দিনে অন্তত ৩৫টি মৃত কাছিম সৈকতে ভেসে আসে। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ কাছিমের শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল।
নিষিদ্ধ জাল ছাড়াও সৈকতে ডিম পাড়তে আসা মা কাছিম বেওয়ারিশ কুকুরের আক্রমণের শিকার হয়ে মারা পড়ছে। বিশেষত সেন্ট মার্টিন দ্বীপে কুকুরের হামলার ঘটনা ঘটছে। সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, গত সাত দিনে দ্বীপের সৈকতে ১০-১৫টি মৃত মা কাছিম ভেসে আসে। অধিকাংশ কাছিম কুকুরে খেয়ে ফেলেছে। অবশিষ্ট কাছিম বালুচরে পুঁতে ফেলা হয়েছে। এলাকায় বেওয়ারিশ কুকুরের দায়িত্ব নেওয়ার যেমন কেউ নেই, তেমনি জেলেদের সচেতন করছে না কেউ। নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার সম্পর্কে সরকারের নীতিমালা নিয়ে স্থানীয় জেলেদের ধারণা নেই।
সামুদ্রিক প্রাণী কাছিম সমুদ্রের বাস্তুসংস্থানের অন্যতম প্রধান উপাদান। তারা জেলি মাছজাতীয় বিষাক্ত সামুদ্রিক প্রাণী খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। কাছিম না থাকলে সমুদ্রে দূষণ বাড়ার পাশাপাশি জেলি মাছের সংখ্যা বেড়ে যাবে বলে গবেষকেরা মনে করেন। এতে মৎস্য সম্পদে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মো. শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, জালে আটকে পড়া কাছিম দু-তিন ঘণ্টা জীবিত থাকতে পারে। কিন্তু জেলেরা পিটিয়ে মা কাছিম হত্যা করে সাগরে নিক্ষেপ করছেন। কাছিম সমুদ্রের ময়লা-আবর্জনা ও জেলি মাছ খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। তাদের বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব সবার।