আলোচিত ও বিতর্কিত যাঁরা নৌকা খোয়ালেন

উপরে বাঁ থেকে খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মহীউদ্দীন খান আলমগীর, মুরাদ হাসান ও পঙ্কজ নাথ; নিচে বাঁ থেকে জাকির হোসেন, সাইফুজ্জামান শিখর, নাঈমুর রহমান দুর্জয় ও শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন
উপরে বাঁ থেকে খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মহীউদ্দীন খান আলমগীর, মুরাদ হাসান ও পঙ্কজ নাথ; নিচে বাঁ থেকে জাকির হোসেন, সাইফুজ্জামান শিখর, নাঈমুর রহমান দুর্জয় ও শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ঘোষণা করা হয়েছে। এ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে অনেক দিন ধরেই বেশ কয়েকজন আলোচিত সংসদ সদস্যের বাদ পড়া নিয়ে গুঞ্জন ছিল। শেষ পর্যন্ত তাঁদের মধ্যে অনেকেই বাদ পড়েছেন। লুটপাট, দখল, দুর্নীতি, বিতর্কিত মন্তব্যসহ নানা কারণে তাঁরা বিভিন্ন সময় সমালোচিত হয়েছেন।

নানা কারণে আলোচনায় ছিলেন ফরিদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের পরপর দুই মেয়াদে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে বর্তমান সরকারে মন্ত্রিসভায় তিনি ছিলেন না। ফরিদপুরের স্থানীয় দুই নেতা রুবেল-বরকতের হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ নিয়ে মোশাররফ হোসেন আলোচনায় আসেন। তাঁর আসনে এবার মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হক। এ ছাড়া খন্দকার মোশাররফ হোসেনের জামাতা হাবিবে মিল্লাত বাদ পড়েছেন। তিনি সিরাজগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য। এবার সেখানে নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জান্নাত আরা হেনরী।

অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে পড়েন তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান। এরপর তিনি মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন, হারান আওয়ামী লীগের পদও। এবার হারালেন দলীয় মনোনয়ন। তাঁর বদলে জামালপুর-৪ আসনে এবার মনোনয়ন পেয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের মৎস্য ও প্রাণিবিষয়ক সম্পাদক মো. মাহবুবুর রহমান। তাঁর বাবা আবদুল মালেক একসময় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন।

বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে সমালোচিত হন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। তাঁর নির্বাচনী এলাকা কুড়িগ্রাম-৪ আসনে এবার মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য মো. বিপ্লব হাসান। যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বিপ্লব ছাত্রলীগের সোহাগ–নাজমুল কমিটির উপ–আইনবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন।

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমান সংসদের সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীরও এবার দলীয় মনোনয়ন পাননি। ব্যাংক কেলেঙ্কারি নিয়ে তাঁর নাম আলোচনায় আসে। কচুয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত চাঁদপুর-১ আসনে এবার মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ।

হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত বরিশাল-৪ আসনে পরপর দুবার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ নাথ। দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বিরোধে বিতর্কিত হন তিনি। এবারও দলের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তবে বাদ পড়েছেন নৌকা প্রতীকে মনোনীতদের তালিকা থেকে। এখানে প্রথমবারের মতো প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ।

রাজধানীর ধানমন্ডি–নিউমার্কেট এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-১০ আসনে উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন ব্যবসায়ী শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। তিনি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ও তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি। এবার তাঁকে বাদ দিয়ে এ আসনে নৌকা প্রতীক তুলে দেওয়া হয়েছে চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমেদের হাতে।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক ও কিশোরগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ এবার দলীয় মনোনয়ন পাননি। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে তাঁর বিরোধের খবর বিভিন্ন সময় সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছিল। এবার সেখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন পুলিশের আরেক সাবেক কর্মকর্তা আবদুল কাহার আকন্দ।

মাগুরা-১ আসন থেকে বর্তমানে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন সাইফুজ্জামান শিখর। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাবেক সহকারী একান্ত সচিব। তাঁর বাবা চারবার সংসদ সদস্য ছিলেন। এবার সেখানে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান।

মানিকগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দুর্জয়ও দলীয় মনোনয়ন হারিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় জমি দখলের অভিযোগ ওঠে। এখানে মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুস সালাম।

আবাসন ব্যবসায়ী এনামুল হক নানা কারণে আলোচনায় আসেন। ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রেরও ব্যবসা আছে তাঁর। রাজশাহী-৪ আসনের এই সংসদ সদস্য এবার বাদ পড়েছেন। এখানে মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক উপকমিটির সদস্য মো. আবুল কালাম আজাদ।

প্রধানমন্ত্রীর সাবেক উপদেষ্টা প্রয়াত এইচ টি ইমামের ছেলে তানভীর ইমাম এবার বাদ পড়েছেন। তাঁর নির্বাচনী এলাকা সিরাজগঞ্জ-৪ আসনে এবার নৌকা পেয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম। তিনি উল্লাপাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন, সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন। নানা কারণে সমালোচিত হয়েছেন খুলনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য বেগম মন্নুজান সুফিয়ান। তিনি বর্তমান সরকারের শ্রম প্রতিমন্ত্রী। এখানে এবার নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন।

নানা কারণে আলোচিত ছিলেন বরগুনা-২ আসনের সংসদ সদস্য শওকত হাচানুর রহমান (রিমন)। এবার সেখানে মনোনয়ন পেয়েছেন সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য সুলতানা নাদিরা। নেত্রকোনা-৫ আসনের সংসদ সদস্য ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল সম্প্রতি সমালোচনায় পড়েন তাঁর স্ত্রী করা এক মামলা নিয়ে। স্নাতকপড়ুয়া এক তরুণীকে প্রধান আসামি করে মামলায় অভিযোগ করা হয়, এই সংসদ সদস্যকে অপহরণ, তাঁর স্বাক্ষর জাল ও নাম ভাঙিয়ে টাকা আদায় করা হয়েছে। এই আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেনকে।

মোহাম্মদপুর এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৩ আসনে একাদশ সংসদ নির্বাচনে নতুন করে মনোনয়ন পেয়ে আলোচনায় আসেন মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা সাদেক খান। এবার তাঁকে সরিয়ে এ আসনের পুরোনো সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য।

হাওরে দখল, দুর্নীতির জন্য সমালোচিত হন সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন (রতন)। এবার তাঁকে সরিয়ে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রণজিৎ চন্দ্র সরকারকে। আর সুনামগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য জয়া সেনগুপ্ত মনোনয়ন হারিয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের নেতা প্রয়াত সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের স্ত্রী। পুলিশের বর্তমান মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনের ভাই চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মাহমুদ এখানে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন।

সরকারি জমি দখলসহ নানা অভিযোগে বিতর্কিত হয়ে পড়েন কুমিল্লা-১ আসনের সংসদ সদস্য সুবিদ আলী ভূঁইয়া। এখানে এবার নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক আবদুস সবুর।

চট্টগ্রাম এলাকার বিতর্কিত কয়েকজনও মনোনীতদের তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। বর্তমান সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী বেশ কয়েকবার বিতর্কের মুখে পড়েন। চট্টগ্রাম-১২ আসনে এবার সেখানে মনোনয়ন পেয়েছেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি পটিয়া উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ থেকে সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন। চট্টগ্রাম-৪ আসনে গত দুবারের সংসদ সদস্য দিদারুল আলম। পাহাড় কেটে ইস্পাত কারখানা স্থাপনসহ বিভিন্ন অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। এবার সেখানে মনোনয়ন পেয়েছেন সম্প্রতি পদত্যাগ করা সীতাকুণ্ড উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম আল মামুন। তাঁর বাবাও একসময় এখানে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন।

বনের জমি দখল ও অস্ত্রধারী নিয়ে মিছিল করে সমালোচিত হন কক্সবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম। এবার সেখানে মনোনয়ন পেয়েছেন কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সালাহ উদ্দীন আহমদ।