আইন-অধিকার

প্রতিযোগিতা আইনের প্রয়োগ কেন গুরুত্বপূর্ণ

একটি আধুনিক ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব হলো, ব্যবসা-বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতি স্বাভাবিক রেখে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ করা এবং বাজারে ন্যায্য প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা। বাজারে ন্যায্য প্রতিযোগিতা বজায় থাকলে তা পণ্যের দাম কমাতে সাহায্য করে। বাজারে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা ও ন্যায্য প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন দেশে প্রতিযোগিতা আইন করা হয়। বাংলাদেশে ২০১২ সালে প্রতিযোগিতা আইন প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমে সরকার পণ্য ও পরিষেবার উৎপাদন, সরবরাহ, বিতরণ, সঞ্চয় বা অধিগ্রহণ নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

প্রতিযোগিতা আইনের পটভূমি

বাজারে কারসাজি করে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি বা হ্রাস নতুন কোনো সমস্যা নয়। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অবৈধভাবে লাভবান কিংবা মনোপলির মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ পুরোনো একটি সমস্যা। গত শতাব্দীর ৯০–এর দশক থেকেই বাংলাদেশ মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ করে, ব্যবসা–বাণিজ্যেরও সম্প্রসারণ ঘটে। মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রধান শর্তই হলো বাজার হবে উন্মুক্ত। অর্থাৎ, বাজারের স্বাভাবিক লেনদেনে কেউ কারসাজি করে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না বা পারস্পরিক যোগসাজশের মাধ্যমে কোনো মনোপলি করতে পারবে না। এ রকম উদ্দেশ্যের কথা বলেই ২০১২ সালে পূর্ববর্তী ‘মনোপলিস অ্যান্ড রেসট্রিকটিভ ট্রেড প্র্যাকটিসেস (কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন) অর্ডিন্যান্স-১৯৭০’ রহিত করে ‘প্রতিযোগিতা আইন-২০১২’ প্রণয়ন করা হয়।

প্রতিযোগিতা কমিশন গঠন

প্রতিযোগিতা আইনের উদ্দেশ্যগুলো অর্জন করার জন্য প্রতিযোগিতা আইনের ৫ ধারা মোতাবেক সরকার বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন গঠন করেছে। বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন ২০১৬ সালে গঠিত হয়। আইনের ৭ ধারা মোতাবেক একজন চেয়ারপারসন এবং চারজন সদস্য সমন্বয়ে কমিশন গঠন করা হয়েছে। ধারা ৭(৩)–এ বলা হয়েছে, ‘অর্থনীতি, বাজারসম্পর্কিত বিষয় বা জনপ্রশাসন বা অনুরূপ যেকোনো বিষয় বা আইন পেশায় কিংবা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আইনবিষয়ক কর্মকাণ্ডে অথবা সরকারের বিবেচনায় কমিশনের জন্য প্রয়োজনীয় অন্য কোনো বিষয়ে ১৫ (পনেরো) বৎসরের বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি কমিশনের চেয়ারপারসন বা সদস্য হিসেবে নিয়োগ লাভের যোগ্য বলিয়া বিবেচিত হইবেন।’

এই কমিশন গঠনের মূল উদ্দেশ্য হলো, একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে বাজারসংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন ও সম্পৃক্ত করা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু ব্যবসায়িক পরিবেশ গড়ে তোলা। বাজারে অনৈতিক মুনাফার লোভে প্রতিযোগিতাবিরোধী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করাও প্রতিযোগিতা আইনের উদ্দেশ্য। এই আইন বাস্তবায়নে উচ্চতর জ্ঞানভিত্তিক, গবেষণাধর্মী এবং তথ্য–যোগাযোগপ্রযুক্তিনির্ভর একটি কমিশন গড়ে তোলার কথাও বলা হয়েছে এই আইনে।

প্রতিযোগিতা কমিশনের কার্যক্রম

বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন এখন পর্যন্ত ১২টি মামলা নিষ্পত্তি করে আদেশ দিয়েছে। ২০১৬ সালে এ কমিশন গঠিত হলেও ২০১৭ সালে কমিশনে প্রথম মামলা করা হয়। একটি মামলার অভিযোগে বলা হয়, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের সংগঠন রাওয়া ক্লাবের কনভেনশন হলে কোনো অনুষ্ঠান হলে ইকবাল ক্যাটারিং সার্ভিস লিমিটেড থেকে বাধ্যতামূলকভাবে খাবার নিতে হয়। তারা যে দাম নির্ধারণ করে, ভোক্তারা সে দামে নিতে বাধ্য হন। বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন তার রায়ে রাওয়া ক্লাবকে ইকবাল ক্যাটারিং সার্ভিস লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি বাতিল ও নতুন করে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে একাধিক ক্যাটারিং সার্ভিস নিয়োগের আদেশ দেন। কমিশন স্বতঃপ্রণোদিতভাবে প্রথমবারের মতো মামলা করেছিল রাজধানী আইডিয়াল স্কুলের বিরুদ্ধে। মামলায় অভিযোগ ছিল, স্কুল কর্তৃপক্ষ শুধু একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রদের স্কুল ড্রেস বানানোর নিয়ম চালু করেছিল। কমিশনের আদেশে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে কমপক্ষে তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে স্কুল ড্রেস বানানোর আদেশ দেওয়া হয়।

কমিশনের আরেকটি রায়ে দেশের একটি বৃহৎ ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে রেফ্রিজারেটর বাজারজাতকরণ ও ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিকভাবে মূল্য হ্রাস বা বৃদ্ধি না করার আদেশ দেয়। গত বছর মে মাসে বাজার থেকে সয়াবিন গায়েব হয়ে যায়। কতিপয় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যোগসাজশের মাধ্যমে ‘সিন্ডিকেট’ করে বাজারে সয়াবিনের মূল্য বাড়িয়ে দেয়। মূল্য কারসাজির জন্য বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন আটটি বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করে। সম্প্রতি চিনির দাম বাড়ানোর অভিযোগে কমিশন কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।

প্রতিযোগিতা আইনের গুরুত্ব

মুক্তবাজার অর্থনীতিতে টিকে থাকতে হলে উৎপাদনশীলতার পাশাপাশি উদ্ভাবনী দক্ষতাও প্রয়োজন। বাজারে স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা থাকলে উদ্ভাবনী দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। কোনো কিছু এককভাবে নিয়ন্ত্রিত হলে সে বিষয়ে ভোক্তাদের সেটাই গ্রহণ করতে হয়, তাদের বিকল্প থাকে না। এ ছাড়া টেকসই অর্থনীতি জোরদার করতে এ ধরনের আইনের কোনো বিকল্প নেই। বাজারব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি কোনো বিশেষ দল বা অসাধু গোষ্ঠীর সৃষ্টি করা যোগসাজশ বা একচেটিয়া ব্যবসার মাধ্যমে বাজারকে অস্থিতিশীল করে তোলার যে অপচেষ্টা, তা চিহ্নিত ও নিরসন করা প্রতিযোগিতা আইনের অন্যতম উদ্দেশ্য। এই আইনের সুষ্ঠু ব্যবহার নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমাতে ও পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখতে পারে। সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর আইন হলো প্রতিযোগিতা আইন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আইন ভালোভাবে বাস্তবায়িত হলে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার কমপক্ষে ২ শতাংশ বাড়বে।

বিজয় কি–বোর্ড নিয়ে বিতর্ক

তথ্যপ্রযুক্তিসংক্রান্ত পণ্য ও সেবার মান নির্ধারণে কারিগরি কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল। এই সংস্থা ২০১৭ সালে বিজয়কে জাতীয় কি-বোর্ড হিসেবে ঘোষণা করে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল কি নির্দিষ্ট কোনো সফটওয়্যার বা কি-বোর্ডকে জাতীয় বা বাংলা টাইপের একমাত্র কি-বোর্ড হিসেবে ঘোষণা করতে পারে? ২০১৭ সালে যখন বিজয়কে জাতীয় কি-বোর্ড লে-আউট হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়, প্রতিযোগিতা আইন-২০১২ তখন কার্যকর। সে হিসেবে এই ঘোষণা আইনের পরিপন্থী এবং অবৈধ। এটি সরাসরি ১৫ ও ১৬ ধারার লঙ্ঘন। আমরা এখন বাংলা লেখার জন্য অনেকটাই বিজয়ের ওপর নির্ভরশীল। এখানে কোনো প্রতিযোগিতা নেই বলে এই খাতের বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনাও কম। ধারা ২(ণ) অনুযায়ী, মনোপলি হলো মাত্র একজন ব্যক্তি বা একটি প্রতিষ্ঠান কোনো পণ্য বা সেবার বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, এমন অবস্থা। প্রতিযোগিতা আইনে এটা নিষিদ্ধ।

কাইয়ুম আহমেদ ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী