আমদানি করা গ্যাস সরবরাহ কমেছে। দেশেও বাড়ছে না গ্যাসের উৎপাদন। বিশ্ববাজারে দাম বাড়ছেই।
গ্যাস–সংকটের কারণে এখন রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় চুলা জ্বলছে না। একই পরিস্থিতি শিল্পে। গ্যাসের অভাবে স্বাভাবিক সময়ের মতো কারখানা চালানো যাচ্ছে না, কমছে শিল্পের উৎপাদন। পরিবহন খাতও ভুগছে গ্যাস–সংকটে।
দেশে দিনে মোট ৩৮০ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে পেট্রোবাংলা সরবরাহ করতে পারত ৩০০ কোটি ঘনফুটের মতো। এখন পারছে ২৭৫ থেকে ২৮০ কোটি ঘনফুট। কারণ, চড়া দামের কারণে বৈশ্বিক খোলাবাজার থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কেনা বন্ধ আড়াই মাস ধরে।
অন্য সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন অথবা সার কারখানায় সরবরাহ কমিয়ে শিল্পে গ্যাসের চাহিদা পূরণ করা হতো। এখন সেই সুযোগটিও নেই। কারণ, বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিকল্প জ্বালানি ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলের দাম বেড়ে গেছে। ফলে গ্যাস দিয়েই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হচ্ছে। সার কারখানা বন্ধ করে দিলেও বিপদ। বিশ্ববাজারে সারের দাম চড়া, আমদানিতে বাড়তি খরচ লাগছে। তাই দেশি সার কারখানা চালু রাখতে হচ্ছে।
আমদানিনির্ভরতা ভুল নীতি ছিল। তাই এখন ভুগতেই হবে, এটা কৃতকর্মের ফল।বদরূল ইমাম, ভূতত্ত্ববিদ
সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এই যে সব খাতেই এখন গ্যাস–সংকট চলছে। ঢাকার বাসিন্দারা কেউ কেউ রাতে অথবা খুব ভোরে উঠে রান্না করছেন। কেউ কেউ কিনেছেন তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) সিলিন্ডার। তাঁদের এলপিজির দামও দিতে হচ্ছে। আবার সরকারি গ্যাসের বিলও পরিশোধ করতে হচ্ছে।
ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা কামরুন্নেছা প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক দিন ধরে দিনের বেলায় চুলা জ্বালানোই যাচ্ছে না। ভোরের দিকে এবং রাতে গ্যাস পাওয়া যায়। বিকল্প হিসেবে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ব্যবহার করতে হয়। তিনি বলেন, এলপিজি সিলিন্ডারও কিনতে হচ্ছে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দরে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান প্রথম আলোকে বলেন, সরবরাহে কিছুটা ঘাটতি আছে, এটা ঠিক। সারা বিশ্বেই গ্যাসের সমস্যা এখন। এ নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে চিন্তাভাবনা চলছে।নাজমুল আহসান, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান
দেশে দুভাবে গ্যাসের চাহিদা মেটানো হয়—দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রে থেকে উৎপাদিত এবং আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি)। দিনে দেশি গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাস সরবরাহ করা হতো ২৩০ কোটি ঘনফুটের মতো। আর এলএনজি আমদানি হতো ৭০ থেকে ৭৫ কোটি ঘনফুট। এখন এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে ৪৮ কোটি ঘনফুট।
সমস্যা হলো, বিশ্ববাজার থেকে এখন পর্যাপ্ত এলএনজি কিনতে পারছে না বাংলাদেশ। কারণ, দাম অত্যন্ত চড়া। গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এলএনজির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। রাশিয়ার গ্যাস না পেয়ে ইউরোপের দেশগুলো খোলাবাজার থেকে কিনছে। এতে দরটি বাংলাদেশের নাগালের বাইরে চলে গেছে। সরকারও খোলাবাজার থেকে চড়া দামে গ্যাস কেনা বন্ধ করে দিয়েছে।
দেশে এলএনজি আমদানি করে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল)। এ কোম্পানির সূত্র বলছে, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় ওমান ও কাতার থেকে প্রতি মাসে পাঁচটি করে এলএনজি কার্গো (জাহাজ) আনা হচ্ছে। এতে প্রতি ইউনিট এলএনজির দাম পড়ছে এখন প্রায় ১৫ মার্কিন ডলার। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে এই দর ছিল ১০ ডলারের কম। আর সিঙ্গাপুরের খোলাবাজার থেকে কেনা এলএনজি নিয়ে প্রতি মাসে তিনটি করে জাহাজ আসার কথা। এখন বিশ্ববাজারে প্রতি ইউনিট এলএনজির দাম ৬০ ডলারের বেশি। গত জুনেও তা ৩৬ ডলারে ছিল। গত বছর নেমেছিল ৪ ডলারে।
দাম বেশি থাকায় আপাতত খোলাবাজার থেকে এলএনজি না কেনার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, সরবরাহে কিছুটা ঘাটতি আছে, এটা ঠিক। সারা বিশ্বেই গ্যাসের সমস্যা এখন। এ নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে চিন্তাভাবনা চলছে। তিনি বলেন, দাম সহনীয় হলে এলএনজি আমদানি বাড়ানোর কথা ভাবতে পারে সরকার। এখন দেশি উৎস থেকে উৎপাদন বাড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।
দিনের বেলায় গ্যাসের চাপ খুবই কম থাকে। রাত ১২টার পর চাপ বাড়ে। তখন আর গ্রাহক থাকে না।ফারহান নূর, সিএনজি স্টেশনগুলোর মালিকদের সমিতি সিএনজি ফিলিং স্টেশন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক
পেট্রোবাংলার কাছ থেকে নিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাস সরবরাহ করে দেশের ছয়টি বিতরণ সংস্থা। এ সংস্থাগুলোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, চাহিদা অনুসারে সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। এতে করে পাইপলাইনে গ্যাসের চাপ কমে গেছে। গ্রাহকেরা নিয়মিত অভিযোগ করছেন। কিন্তু তাঁরা কোনো সমাধান দিতে পারছেন না।
ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে গ্যাস সরবরাহ করে দেশের শীর্ষ গ্যাস বিতরণকারী সরকারি কোম্পানি তিতাস গ্যাস। এখন দিনে ১৮০ থেকে ১৯০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে তিতাস পাচ্ছে ১৬০ কোটি ঘনফুটের মতো। ফলে তারা গ্রাহকদের গ্যাস দিতে পারছে না। গ্রাহকেরাও দিনভর গ্রাহকেরা ফোন করছেন তিতাসের অভিযোগ কেন্দ্রে।
তিতাস সূত্র বলছে, ঢাকার প্রায় সব এলাকা থেকেই আসছে অভিযোগ। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর, মিরপুর, পাইকপাড়া, রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, পুরান ঢাকা, কল্যাণপুর ও উত্তরা থেকে আসা অভিযোগ বেশি। তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশীদ মোল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত এভাবেই চলতে হবে।
কোথাও ৬ ঘণ্টা, কোথাও ১২ ঘণ্টা পুরোপুরি বন্ধ থাকছে কারখানা। বাকি সময়েও গ্যাসের চাপ কম থাকছে। এতে উৎপাদন ৫০ শতাংশ কমে গেছে।মোহাম্মদ আলী, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি
পেট্রোবাংলার গতকাল সোমবারের গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ প্রতিবেদন বলছে, এদিন বিদ্যুৎ খাতে ২২৫ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে ১০৬ কোটি ঘনফুট। সার কারখানায় চাহিদা ৩২ কোটি ঘনফুট। বিপরীতে তারা পেয়েছে ১৬ কোটি ঘনফুট।
পরিবহনে গ্যাস সরবরাহকারী সিএনজি স্টেশনগুলো এখন দিনে পাঁচ ঘণ্টা (সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা) করে বন্ধ থাকছে। বাকি সময়েও ঠিকমতো গ্যাস পাচ্ছে না তারা। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, সাধারণত ১৫ পিএসআই (গ্যাসের চাপ মাপার একক) থাকলে গ্যাসের চাপ স্বাভাবিক বলে ধরা হয়। ১০ পিএসআই হলেও তা দিয়ে কাজ চালানো যায়। কিন্তু দুই মাস ধরে বেশির ভাগ সময় দিনের বেলা দুই থেকে তিন পিএসআইয়ের বেশি পাওয়া যাচ্ছে না।
সিএনজি স্টেশনগুলোর মালিকদের সমিতি সিএনজি ফিলিং স্টেশন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফারহান নূর প্রথম আলোকে বলেন, দিনের বেলায় গ্যাসের চাপ খুবই কম থাকে। রাত ১২টার পর চাপ বাড়ে। তখন আর গ্রাহক থাকে না।
নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও গাজীপুরের কারখানাগুলো সচল রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। ওই সব এলাকায় কারখানা প্রতিষ্ঠা করা ব্যবসায়ীরা বলছেন, গাজীপুরে বিকেল পাঁচটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত কারখানা পুরোপুরি বন্ধ রাখতে হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জে দিনের বেলায় গ্যাস পাওয়া যায় না, রাতে উৎপাদন কাজ চালাতে হয়।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, কোথাও ৬ ঘণ্টা, কোথাও ১২ ঘণ্টা পুরোপুরি বন্ধ থাকছে কারখানা। বাকি সময়েও গ্যাসের চাপ কম থাকছে। এতে উৎপাদন ৫০ শতাংশ কমে গেছে।
ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের ৬৪টি কারখানায় গ্যাস সরবরাহ ও পোশাক উৎপাদন পরিস্থিতি জানতে একটি জরিপ করেছে নিট পোশাকশিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ। জরিপে উঠে এসেছে, গত দুই মাসে কারখানাগুলোতে গ্যাসের চাপ অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। গড়ে ১ দশমিক ৮ পিএসআই করে গ্যাস পেয়েছে তারা। এতে কারখানার উৎপাদন ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে গেছে।
গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী।
এতে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ও তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক সূত্র বলছে, গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় উৎপাদন কমার পরিস্থিতি বৈঠকে তুলে ধরেন ব্যবসায়ী নেতারা। তবে পরিস্থিতির উন্নতি কবে হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা পাননি ব্যবসায়ীরা। শুধু শীতে বিদ্যুৎ খাতে চাহিদা কমলে শিল্পে সরবরাহ বাড়তে পারে।
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, নারায়ণগঞ্জে সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা, কোনো কোনো দিন রাত ১১টা পর্যন্ত গ্যাসের চাপ শূন্য বা তার কাছাকাছি থাকে। ফলে সে সময় পূর্ণ উৎপাদন সম্ভব হয় না। রাতে গ্যাসের চাপ বাড়লে উৎপাদন করতে হয়।
অভিযোগ আছে, দেশে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে জোর না দিয়ে সরকার আমদানির দিকে ঝুঁকেছে। এ আমদানিনির্ভরতাই সংকট তৈরি করেছে। এখন দেশীয়ভাবে যে গ্যাস উৎপাদিত হয়, তার ৬০ শতাংশ সরবরাহ করে শেভরন। এক কোম্পানির ওপর এমন নির্ভরতাও ভোগাতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, এখন দেশি গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন বাড়ানোর তোড়জোড় শুরু করেছে পেট্রোবাংলা। এটি আগে থেকেই করা উচিত ছিল।
ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, ইউরোপ এলএনজির বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়িয়েছে। দাম আরও বাড়তে পারে। তাই পরিস্থিতির আপাতত উন্নতির সম্ভাবনা নেই। তিনি বলেন, অবশেষে সরকার দেশে উৎপাদন বাড়ানোয় জোর দিচ্ছে, যা পাঁচ বছর আগেই করা উচিত ছিল। তবে রাতারাতি গ্যাস পাওয়া যাবে না।
বদরূল ইমাম আরও বলেন, আমদানিনির্ভরতা ভুল নীতি ছিল। তাই এখন ভুগতেই হবে, এটা কৃতকর্মের ফল।