চলতি মাসের বৃষ্টি ডেঙ্গু নিয়ে নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। রাজধানীতে এ মাসে গড়ে যে বৃষ্টি হয়, মাসের তিন দিন বাকি থাকতেই সেটি ছাড়িয়ে গেছে। গত বছর এ মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বৃষ্টি হয়েছিল। ২২ বছরের মধ্যে গত বছর ডেঙ্গুর সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যুর পেছনে এই অতিবৃষ্টির ভূমিকা ছিল বলে মনে করা হয়।
গত বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় এবার ডেঙ্গুতে সংক্রমণ ও মৃত্যু প্রায় দ্বিগুণ বেশি। আবার ঢাকার বাইরে এবার মাত্রাতিরিক্ত সংক্রমণ, আগের বছরের ডেঙ্গুর ধারাবাহিকতা—এসব কারণে এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কীটতত্ত্ববিদ, জনস্বাস্থ্যবিদ ও চিকিৎসকেরা।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে, প্রতিবছর মার্চে গড়ে ঢাকায় ৬৫ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। গত বৃহস্পতিবার সকালের হিসাবে, ঢাকার বৃষ্টি ৮৩ মিলিমিটার পার হয়ে গেছে। দেশে মার্চে গড়ে ৫২ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছেন, এ মাসে ইতিমধ্যে গড়ে ১৫ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, এ মাসে আরও বৃষ্টি হতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছর মার্চে স্বাভাবিকের চেয়ে ৭৮ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছিল। এবারও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। ফলে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়তে পারে।’
ডেঙ্গু রোগ বহন করে এডিস মশা। এই মশার বৃদ্ধিতে বৃষ্টি ও তাপমাত্রার নিবিড় সম্পর্ক আছে বলেই মনে করেন কীটতত্ত্ববিদেরা।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কীটতত্ত্ববিদ তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ বলছিলেন, দেশে সবচেয়ে বেশি যে মশার উপস্থিতি, সেই কিউলেক্সের সঙ্গে এডিস মশার একটি বড় ভিন্নতা আছে। কিউলেক্সের শূককীট যেমন পানিতে ভেসে থাকে, এডিসের তেমন নয়। অনেক সময় শুকনা পাত্রের গায়ে এটি লেগে থাকে। তাই একে চিহ্নিত করা কঠিন। কিউলেক্স ভেসে থাকে বলে তাঁকে মারা সহজ হয়। পাত্রের গায়ে লেগে থাকা এডিসের শূককীট বৃষ্টির পানি পাওয়ার পর এর অন্তত ২০ শতাংশ একবারে প্রাপ্তবয়স্ক মশায় পরিণত হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৃষ্টির সঙ্গে তাপ বাড়লে এডিস মশার পোয়াবারো। তাপমাত্রা বাড়লে মশার দেহে ডেঙ্গুর জীবাণু দ্রুত বেড়ে যায়। বাড়ে মশার রক্ত হজমের হারও।
এনটোমোলজিক্যাল সোসাইটি অব আমেরিকার জার্নাল অব মেডিকেল এনটোমোলজিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে চলতি শতকের প্রথম দশকের তুলনায় দ্বিতীয় দশকে দেশের তাপমাত্রা প্রায় আধা ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এটি এডিসের প্রকোপ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।
এভাবে বৃষ্টি ও তাপ বাড়লে এডিস মশার প্রজনের সময় কমে আসে বলে জানান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, একটি মশা শীতকালে ১৫ দিন সময় নিয়ে পূর্ণাঙ্গ মশায় রূপান্তরিত হয়। আবার উপযোগী তাপমাত্রা ও বৃষ্টি পেলে সেই মশা ৬ থেকে ১০ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ হতে পারে। এটি এডিস মশার ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য।’
ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে দুই সিটি করপোরেশনের নিজস্ব জরিপ ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেন জনস্বাস্থ্যবিদ ও কীটতত্ত্ববিদেরা। কিন্তু এখনো দুই সিটির এমন সক্ষমতা গড়ে ওঠেনি। মশার ঘনত্ব কোথায়, কী অবস্থায় আছে—তা জানতে দুই সিটি ভরসা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার বছরজুড়ে চলা তিন জরিপের ওপর। এই তিন জরিপ হয়—প্রাক্–বর্ষা, বর্ষা ও বর্ষার পর।
গত কয়েক দিন রাজধানীতে যে বৃষ্টি হয়েছে, তাতে দ্রুত এই দুই সিটির মশা পরিস্থিতির জরিপ দরকার ছিল বলে মনে করেন কীটতত্ত্ববিদ তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলছিলেন, ‘এখন যদি বোঝা যেত মশা কতটা বাড়ল, তাহলে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারত দুই সিটি করপোরেশন। কিন্তু তাদের সেই সক্ষমতা নেই। তাই যখন পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে, তখন তারা কাজ করতে শুরু করবে।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবীর বলেন, এবার বৃষ্টির পর দক্ষিণ সিটিতে কোনো জরিপ হয়নি, সেই সক্ষমতাও তাদের নেই।
তবে এবার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় উত্তর সিটি করপোরেশন বৃষ্টির পরপরই চারটি এলাকায় লার্ভা সংগ্রহে নামে বলে জানান সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী। তিনি বলেন, চার দিন পর গত বৃহস্পতিবার মিরপুর এলাকায় এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে। তার মানে এডিসের বিস্তার আছে।
গত বছর অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছিল বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ‘এবার মার্চের এই বৃষ্টি ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে “মরার উপর খাঁড়ার ঘা” হয়ে গেল। কারণ, এ সময়ে সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সবারই মশা দমন তৎপরতা অনেকটাই কমে গেছে। এ সময় এডিসের বংশ বৃদ্ধির আশঙ্কা যথেষ্ট।’
২০২২ সালের ডেঙ্গুর ধারাবাহিকতায় দেশে গত বছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ২০২২ সালে বর্ষা দেরিতে এসেছিল। বছরের সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয়েছিল অক্টোবরে। আর সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছিল নভেম্বরে। এরপর ডেঙ্গুর সংক্রমণের ধারাবাহিকতা চলতে থাকে। চলতি বছরও গতবারের ধারাবাহিকতা রয়ে গেছে। গত ডিসেম্বর থেকে শীত মৌসুমে সংক্রমণ কমছে বটে, তবে একেবারে শেষ হয়নি।
গত বছরের এই ধারাবাহিকতা এবারও ডেঙ্গুর বড় বিস্তৃতির ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করেন ভাইরোলজিস্ট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেলে ইউনিভার্সিটির সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই ধারাবাহিকতার বিষয়টি কেউ খেয়াল করছে বলে মনে হয় না। ডেঙ্গুর সংক্রমণে ছেদ পড়ল না। এটা আশঙ্কার।’
এবার প্রথম তিন মাসে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ও মৃত্যু বৃষ্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ভাবাচ্ছে। গত বছরের চেয়ে এবার প্রথম তিন মাসে ডেঙ্গুতে প্রায় দ্বিগুণ সংক্রমণ ও মৃত্যু হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চলতি বছর ডেঙ্গুতে সংক্রমণ ছিল ১ হাজার ৬৬৯ জন। আগের বছর মার্চ পর্যন্ত ছিল ৮৪৩। এবার ইতিমধ্যে ডেঙ্গুতে ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে, গত বছর ছিল ৯ জন।
এবার ঢাকার বাইরে সংক্রমণের সংখ্যা গত বছরের দ্বিগুণের বেশি। গত বছর ঢাকার বাইরে মার্চ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪১২। এবার তা হয়েছে, ১ হাজার ৮২।
ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগে এবার গত বছরের তুলনায় রেকর্ড সংক্রমণ হয়েছে। গত বছর চট্টগ্রাম বিভাগে মার্চ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৯৬, এবার ২৭ মার্চ পর্যন্ত ৪৯৮। বরিশালে গত বছর আক্রান্ত ছিল ৯৩ এবং এবার ২০১ জন।
জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন বলছিলেন, ‘এবার ঢাকার বাইরে যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তা ভীতিকর। ঢাকার দুই সিটির সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মশা রোধে কিছু কার্যক্রম আছে। বাইরে তো সেই অর্থে কিছুই নেই। আবার ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুর শুধু একটি ধরনে আক্রান্ত বেশি। এবার তাদের দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা আছে। আর তা হলে পরিস্থিতি নাজুক হতে পারে।’
ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন বলেছেন, বছরের শুরুতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি দেখা যাচ্ছে। গত বছর ডেঙ্গুতে দেশে রেকর্ডসংখ্যক মৃত্যু হয়েছে। এ বছর পরিস্থিতি গত বছরের চেয়ে খারাপ হওয়ার আশঙ্কা আছে।
এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ঢাকার দুই সিটির মানুষ। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। তবে দক্ষিণ সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শেখ ফজলে শামসুল কবীরের দাবি, ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি আগের মতো হবে না।’
এ বিষয়ে কথা বলতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. নাজমুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দুই সিটির এত দিনের কর্মকাণ্ড মোটেও আশাব্যঞ্জক নয় বলেই মনে করেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি বলছেন, ‘এবার বড় সংক্রমণের আশঙ্কা করছি। কিন্তু দুই সিটি এবং সংশ্লিষ্টদের কাজ লোক দেখানো। কাউকে দেখি বড় বড় মেশিন নিয়ে মশা মারতে যান। কিন্তু ক্যামেরা চলে গেলে সেখানে কী হয়, তা জানি না। আসলে সব কাজ হচ্ছে লোক দেখানো।’