মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু থেকে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে। দালালের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা নৌকায় চড়ে টেকনাফ সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে। অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিচ্ছেন জেলার বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে।
সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, গত সাত-আট দিনে ১৪ হাজার টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে ঠাঁই নিয়েছে। বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য মংডু সীমান্তে জড়ো হয়েছে আরও ৬০-৭০ হাজার রোহিঙ্গা। নাফ নদী ও সীমান্তে বিজিবি ও কোস্টগার্ড বাহিনীর কড়া নজরদারির মধ্যেও বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশের ঘটনায় উদ্বিগ্ন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ।
সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, কয়েক দিন ধরে রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপের চলমান যুদ্ধ তীব্র হচ্ছে। গতকাল রোববার সন্ধ্যা থেকে আজ সোমবার বেলা ১১টা পর্যন্ত সরকারি বাহিনীর সঙ্গে দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) লড়াই চলছে। মংডু টাউনে থাকা সেনা ও বিজিপির দুটি ব্যারাক (ব্যাটালিয়ন) দখলের জন্য মরিয়া আরাকান আর্মি। গোলাগুলির পাশাপাশি দুই পক্ষ থেকে ছোড়া হচ্ছে মর্টার শেল, গ্রেনেড-বোমা। মাঝেমধ্যে ড্রোন হামলাও চালানো হচ্ছে।
মংডু টাউনের পাশে লাগোয়া পাঁচটি গ্রাম সুধাপাড়া, মংনিপাড়া, সিকদারপাড়া, উকিলপাড়া, নুরুল্লাপাড়া দখল করে ৫০-৬০ হাজার রোহিঙ্গাকে উচ্ছেদ করেছে বিদ্রোহী আরাকান আর্মি। মংডুসহ আশপাশের রাখাইন রাজ্যে বর্তমানে তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে।
টেকনাফের নয়াপাড়া আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-২৪) ঠাঁই নিয়েছে মংডু থেকে পালিয়ে আসা কয়েক শ রোহিঙ্গা। পাশের জাদিমুরা, মুছনীসহ কয়েকটি আশ্রয়শিবিরেও ঠাঁই নিয়েছে অন্তত এক হাজার রোহিঙ্গা। বেশির ভাগই নারী এ শিশু। গতকাল বিকেলে নয়াপাড়া আশ্রয়শিবিরে ই-ব্লকে পাওয়া যায় অন্তত ১৬০ জন রোহিঙ্গাকে। সবার বাড়ি মংডুর দলিয়াপাড়া ও সুদাপাড়াতে। দলের একজন হাকিম আলী (৫১) বলেন, ৪ সেপ্টেম্বর রাতে নৌকায় নাফ নদী অতিক্রম করে তিনি এই আশ্রয়শিবিরে ঢুকেছেন। সঙ্গে স্ত্রী, পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ে। ওঠেন এক আত্মীয়ের ঘরে। গাদাগাদি করে থাকছেন সবাই। নাফ নদী পারাপারে টেকনাফের দালালদের দিতে হয়েছে মাথাপিছু পাঁচ লাখ কিয়েত(মিয়ানমারের মুদ্রা, ১৮ কিয়েতে ১ টাকা)। এক নৌকায় ১০-১২ জন আসা যায়।
রেহেনা বেগম (৪৫) নামের আরেক রোহিঙ্গা নারী বলেন, মংডুতে জান্তা সরকারের সঙ্গে আরাকান আর্মির লড়াই আরও তীব্র হয়েছে। মর্টার শেলের আঘাতে তাঁর বাড়ি বিধ্বস্ত হয়। স্বামীও নিখোঁজ। তিন সন্তান নিয়ে তিনি পাঁচ দিন আগে টেকনাফে পালিয়ে আসেন। তারপর ওই আশ্রয়শিবিরে ঠাঁই নেন। তাঁদের মাথাপিছু পাঁচ লাখ কিয়েত করে দিতে হয়েছে।
নয়াপাড়ার আশ্রয়শিবিরের ই-ব্লকের অন্তত ৩৪টি ঘরে তিন শতাধিক রোহিঙ্গা ঠাঁই নিয়েছে জানিয়ে ওই ব্লকের রোহিঙ্গা নেতা নুরুল আলম বলেন, কমবেশি সব রোহিঙ্গা দালালের মাধ্যমে আশ্রয়শিবিরে পৌঁছায়। মংডুর পশ্চিমে চার কিলোমিটার প্রস্থের নাফ নদীর এপারে টেকনাফ উপজেলা।
উখিয়ার লম্বাশিয়া, কুতুপালং, বালুখালী আশ্রয়শিবিরেও কয়েক হাজার রোহিঙ্গা ঢুকে পড়েছে। লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের একটি আস্তানায় কথা হয় তিন দিন আগে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা ছৈয়দ করিম ও হাবিব উল্লাহর সঙ্গে। হাবিব উল্লাহ (৪৫) বলেন, মর্টার শেলের আঘাতে তাঁদের ঘর পুড়ে গেছে ১১ দিন আগে। এরপর পাশের প্যারাবনে লুকিয়ে ছিলেন কয়েক দিন। সাত দিন অপেক্ষার পর বাংলাদেশে পালিয়ে আসার নৌকা পেয়েছেন তাঁরা।
টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে গতকাল রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১২ থেকে ১৪ হাজার রোহিঙ্গা ঠাঁই নিয়েছেন জানিয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নতুন করে আসা রোহিঙ্গারা আশ্রয়শিবিরগুলোতে থাকা আত্মীয়-স্বজনের (পুরোনো রোহিঙ্গা) ঘরে আছেন। তাঁদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ ও আহত রোহিঙ্গাও আছেন। তাঁদের আশ্রয়শিবিরে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। নতুন আসা রোহিঙ্গাদের আবাসন নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
গত মঙ্গলবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, তখন পর্যন্ত আট হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কক্সবাজার শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বলেন, নাফ নদী ও সীমান্তে কড়াকড়ির পরও রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ স্থানীয় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ও উদ্বেগের সৃষ্টি করছে। রাখাইন রাজ্যে বর্তমানে এখনো পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আছে। তারাও যদি বাংলাদেশে চলে আসে, তাহলে নতুন সংকট দেখা দেবে। যেকোনো মূল্যে অনুপ্রবেশ ঠেকানো দরকার।
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে আট লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। গত সাত বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।
রোহিঙ্গাদের অধিকার সংগঠন ‘আরাকান সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জুবায়ের বলেন, জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা–সংকটের গুরুত্ব দিচ্ছে না। এ কারণে নতুন করে আরও রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটছে। রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও জান্তা বাহিনী লড়াইয়ে রোহিঙ্গারা নির্মূল হচ্ছে। লড়াই বন্ধে আন্তর্জাতিক মহলের কঠোর হস্তক্ষেপ দরকার।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে। অনুপ্রবেশের সময় বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে নাফ নদী থেকে পুনরায় মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদী ও সীমান্তে টহল জোরদার করা হয়েছে।