দেশের অধিকাংশ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ক্ষতিকর সাকার মাছ। এ নিয়ে সরকারি মহলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এখন মাছটি আমদানি, প্রজনন, চাষ, বিক্রি, পরিবহন প্রভৃতি নিষিদ্ধের প্রস্তাব দিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর। সম্প্রতি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে একটি চিঠি দিয়েছে অধিদপ্তর। এরপর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সাকার মাছ থেকে দেশীয় প্রজাতির মাছ রক্ষায় করণীয়বিষয়ক একটি সভা করেছে।
এর আগে গত ৫ জুন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক সভায় মৎস্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সাকার মাছ ছড়িয়ে পড়া নিয়ে আলোচনা হয়। মাছটি যেন দেশে কোনো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে না পারে, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। সেই সভার পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৮ জুন মৎস্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক (মৎস্য চাষ) মো. খালেদ কনক একটি নির্দেশনা জারি করেন।
নির্দেশনায় বলা হয়, সাকার মাছ নিষিদ্ধ করার বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারির আগে সাকারসহ কোনো প্রকার বিদেশি মাছ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া আমদানি, হ্যাচারিতে প্রজনন, পোনা উৎপাদন, চাষ, বিক্রি ও পরিবহন করা যাবে না।
এরপর গত ২৭ জুলাই মন্ত্রণালয়ে সাকার মাছ আমদানি, প্রজনন, চাষ, বিক্রি, পরিবহন প্রভৃতি বিষয়ে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব দেয় অধিদপ্তর।
সাকার মাছ নিষিদ্ধ করতে মন্ত্রণালয়কে দেওয়া চিঠির বিষয়ে খালেদ কনক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা এবং আমাদের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে এটিকে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করেছি।’
মন্ত্রণালয়ের মৎস্য অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আবদুল কাইয়ূম বলেন, ‘চিঠির বিষয়টি আমরা অবহিত আছি। এটি নিয়ে আমরা একটি সভা করেছি। নিষিদ্ধ করার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে, আইনকানুন দেখছি।’
সাকার ফিশের আসল নাম সাকার মাউথ ক্যাটফিশ। এর বৈজ্ঞানিক নাম হিপোসটোমাস প্লেকাসটোমাস। আশির দশকে অ্যাকোয়ারিয়ামের শেওলা ও ময়লা পরিষ্কার করতে এই মাছ বিদেশ থেকে আনা হয়। এই মাছ দক্ষিণ আমেরিকায় ব্যাপকভাবে দেখা যায়। তবে কয়েক বছর ধরে তা ভারত, চীন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের জলাশয়ে দেখা যাচ্ছে।
সাকার মাছের পিঠের ওপরে বড় ও ধারালো পাখনা আছে। দুই পাশেও রয়েছে একই রকমের দুটি পাখনা। এর দাঁতও বেশ ধারালো। সাধারণত জলাশয়ের আগাছা, জলজ পোকামাকড় ও ছোট মাছ এদের প্রধান খাবার। যেসব পানিতে দূষণের কারণে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে, সেখানে অন্য মাছ বাঁচতে পারে না, তবে এই মাছ পারে। পানি ছাড়াও মাছটি ২৪ ঘণ্টা দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে।
মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সাকার মাছ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বা খারাপ পানিতে ও কম অক্সিজেনেও বাঁচতে পারে। পাশাপাশি এটি দ্রুত প্রজনন ঘটায়। এই মাছ যদি দেশের মানুষ খেত, তাহলে এত বাড়ত না। এভাবে যদি বাড়তে থাকে তাহলে অন্যান্য মাছের সঙ্গে সাকার মাছের জায়গা নিয়ে, খাবার নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হবে। এ জন্য সাকার মাছ কমাতে হবে।
উপপরিচালক খালেদ কনক বলেন, ‘সাকার মাছ এখন জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। সাকার অন্যান্য মাছের লার্ভা ও ডিম খেয়ে ফেলে। এর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে দেশীয় মাছ টিকে থাকতে পারছে না।’
সাকার মাছ নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মৎস্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক মো. শাহজাহান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাকার দেশীয় মাছের জন্য বড় প্রতিযোগী হয়ে যেতে পারে। এই মাছ খাওয়া যায় না।’
মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সাকার মাছ ধীরে ধীরে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। ঢাকার বুড়িগঙ্গা থেকে অধিকাংশ জেলা শহরে এটি ছড়িয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে বাকৃবির অধ্যাপক শাহজাহান বলেন, ‘যাঁরা অ্যাকোয়ারিয়ামের ব্যবসা করেন, তাঁরাই বিদেশ থেকে দেশে সাকার মাছ আনেন। অ্যাকোয়ারিয়ামের কাচের সঙ্গে লেগে থাকা ময়লা সাকার মাছ খেয়ে ফেলে। এতে কাচ পরিষ্কার থাকে। এ কারণেই তাঁরা এ মাছ আনেন। কিন্তু এটা কোনো না কোনোভাবে আমাদের প্রকৃতিতে চলে গেছে। অ্যাকোয়ারিয়াম থেকে এটা কীভাবে প্রকৃতিতে চলে গেল, তা সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় না।’
সাকার মাছ কীভাবে দেশে প্রবেশ করেছে, তা নির্দিষ্টভাবে বলতে পারে না মৎস্য অধিদপ্তরও। প্রতিষ্ঠানটির উপপরিচালক খালেদ কনক বলছেন, এটা নিশ্চিত যে মৎস্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে মাছটি দেশে প্রবেশ করেনি। তবে নির্দিষ্ট জায়গা থেকে এটি উন্মুক্ত জলাশয়ে প্রবেশ করেছে। তবে কীভাবে প্রবেশ করেছে, তা জানা যায়নি।
সাকার মাছ আমদানির অনুমোদন নেই। তাই অনুমোদন ছাড়াই এ মাছ দেশে প্রবেশ করেছে বলে মনে করেন মৎস্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক খালেদ কনক। তিনি বলেন, অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের নথি পর্যবেক্ষণ করে এই মাছ কাউকে আমদানির অনুমতি দেওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া দেশের যেসব আন্তনদী (যেসব নদী ভারত ও মিয়ানমার থেকে দেশে প্রবেশ করেছে) রয়েছে, সেগুলোতে এই মাছ আগে পাওয়া যায়নি। সেগুলোতে পেলেও বলা যেত, আন্তনদী দিয়ে প্রবেশ করেছে।
মৎস্য অধিদপ্তর যদি অনুমোদন না দেয়, তাহলে সাকার দেশে কীভাবে এল—সেই প্রশ্ন রেখে বাকৃবি অধ্যাপক শাহজাহান বলছেন, তারা (মৎস্য অধিদপ্তর) এটা দেখবে না? তিনি বলেন, ‘দায়িত্বশীল কর্মকর্তার দেখার কথা আমদানির সময় দেশে কী মাছ প্রবেশ করছে। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর তাদের দায়িত্ব পালনে শতভাগ ব্যর্থ হয়েছে।’ তারা মুখে যা বলে, বাস্তবে সেই কার্যক্রম নেই বলেও মনে করেন তিনি।
সাকার মাছের দ্রুত ছড়িয়ে পড়া, নিয়ন্ত্রণ ও বিকল্প ব্যবহার নিয়ে গবেষণা করছে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। সংস্থাটির মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, দেশের তিন-চারটি জায়গা থেকে নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে সাকার মাছের মধ্যে ভারী ধাতব পদার্থ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘এখন আমরা সারা দেশ থেকে নমুনা এনে পরীক্ষা করা হচ্ছে। তিন-চার জায়গার নমুনা নাকি সারা দেশেই সাকার মাছের মধ্যে ভারী পদার্থ রয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হবে। যদি গবেষণায় দেখা যায়, অন্যান্য জায়গার সাকার মাছে ভারী পদার্থ নেই, তাহলে এই মাছ মানুষের খেতে সমস্যা থাকবে না।’
ভারী পদার্থ না থাকলে সাকার মাছ দিয়ে মাছ ও হাঁস-মুরগির খাদ্য তৈরি করা যাবে বলেও জানান ইয়াহিয়া মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘গবেষণার ফল এলে আমরা তখন সরকারকে বলব, যে এই মাছ মানুষের খাওয়ার এবং মাছ ও হাঁস-মুরগির খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের উপযোগী কি না। তবে তাৎক্ষণিকভাবে পরামর্শ হচ্ছে, যেহেতু এটা বাড়ছে বেশি, সে জন্য যেখানেই পাওয়া যাবে, ধরে মেরে ফেলতে হবে।’
ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ আরও বলেন, ‘পুকুর প্রস্তুতের সময় তা শুকিয়ে সব সাকার ধরে মেরে ফেলতে হবে। বন্যা বেশি হওয়ায় পুকুরের চারপাশে জাল দিয়ে রাখতে হবে যেন সাকার পুকুরে প্রবেশ করতে ও বের হতে না পারে। তবে পুকুর থেকে সরালেও নদ-নদী ও খাল-বিল থেকে এ মাছ সরানো কঠিন হবে। সে ক্ষেত্রে সরকার ঘোষণা দিতে পারে, সাকার ধরে দিলে ১০ টাকা করে দেওয়া হবে। তাহলে হয়তো এটা করা সম্ভব।’
উন্মুক্ত জলাশয়ে চলে যাওয়া সাকার মাছ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন উল্লেখ করে বাকৃবি অধ্যাপক শাহজাহান বলেন, ‘যাঁরা অ্যাকোয়ারিয়ামে সাকার মাছ চাষ করেন, তাঁরা যেন এটাকে আর প্রকৃতিতে না ছাড়েন।’