ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে সাত বছর আগের এই দিনে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছিল। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলায় পুলিশের ২ সদস্যসহ দেশি-বিদেশি ২০ জন নিহত হন। তাঁদের মধ্যে নয়জন ইতালীয়, সাতজন জাপানি, তিনজন বাংলাদেশি ও একজন ভারতীয় ছিলেন। হামলা চালিয়ে জঙ্গিরা যে নৃশংস কায়দায় মানুষ হত্যা করে, তাতে স্তম্ভিত হয়েছিল পুরো জাতি।
জঙ্গিদের হাতে জিম্মি অবস্থা থেকে মানুষজনকে মুক্ত করতে অভিযান চালাতে গিয়ে পুলিশের দুই কর্মকর্তা নিহত হন। তাঁরা হলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সহকারী কমিশনার রবিউল করিম ও বনানী থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিন খান।
পুলিশ ও র্যাবের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলছেন, ওই হামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অব্যাহত অভিযানে দেশে জঙ্গি তৎপরতা কমে এসেছে। এখন দেশে কোনো ধরনের হামলা চালানোর সক্ষমতা নেই জঙ্গিদের।
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে জঙ্গিরা রেস্তোরাঁয় প্রবেশের পরপরই ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ। প্রথম দফায় জিম্মি নাগরিকদের মুক্ত করতে অভিযান চালাতে গিয়ে পুলিশের দুই কর্মকর্তা নিহত হন। হামলার ভয়াবহতা ও পরিস্থিতি বিবেচনায় সেখানে পুলিশের পাশাপাশি র্যাব, বিজিবি, নৌবাহিনী ও সেনা কমান্ডো যুক্ত হয়। রাতভর জঙ্গিরা গুলি করে ও কুপিয়ে রেস্তোরাঁয় আসা অন্তঃসত্ত্বা নারী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, উন্নয়ন সহযোগী বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করে। সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানের মধ্য দিয়ে পরদিন সকালে শেষ হয় ১২ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর জিম্মিদশার।
অভিযানে সরাসরি হামলায় জড়িত পাঁচ জঙ্গি নিহত হন। তাঁরা হলেন রোহান ইমতিয়াজ, সামিউল মোবাশ্বির, নিবরাস ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ও খায়রুল ইসলাম। তাঁদের মধ্যে প্রথম তিনজন উচ্চ ও উচ্চমধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারের সন্তান।
হামলার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয় মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। হামলাকারী পাঁচজনকে তাদের ‘সৈনিক’ বলেও দাবি করে জঙ্গি সংগঠনটি। তবে সরকার আইএসের এই দাবিকে নাকচ করে দিয়ে বলেছে, দেশীয় জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবি এই হামলার জন্য দায়ী।
দুই বছরের বেশি সময় ধরে তদন্তের পর ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই এ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয় ডিএমপি কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। বিচারিক কার্যক্রম শুরুর এক বছরের মধ্যেই গত ২৭ নভেম্বর আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন আদালত। রায়ে মামলার আট আসামির সাতজনকে মৃত্যুদণ্ড ও একজনকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। এ ছাড়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেক আসামিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়।
জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। একটি নতুন জঙ্গি সংগঠন মাথাচাড়া দিতে চেয়েছিল। তাদেরও আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি।মো. আসাদুজ্জামান, সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান
দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, আবদুস সবুর খান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাদিসুর রহমান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ এবং মামুনুর রশিদ রিপন। এ ছাড়া ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে বেকসুর খালাস দেন আদালত।
প্রায় দেড় বছর আগের করা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দায়িত্ব দেওয়া হয় আত্মঘাতী পাঁচ জঙ্গিকে। জঙ্গিদের লক্ষ্য ছিল গুলশানের কোনো একটি জনাকীর্ণ স্থানে তারা হামলা করবে। যদিও লক্ষ্যবস্তু হিসেবে হোলি আর্টিজানকে বেছে নেওয়া হয় হামলার দুই সপ্তাহ আগে। আর হামলাকারী দলটি তাদের লক্ষ্যস্থল সম্পর্কে জানতে পারে হামলার মাত্র তিন-চার দিন আগে। আইনশৃঙ্খলা রক্সাকারী বাহিনীর দীর্ঘ অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে গুলশান হামলার ‘নীলনকশা’।
সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে জেএমবির একটি গ্রুপ বিদেশিদের ওপর হামলার সিদ্ধান্ত নেয় ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে। পরে ‘নব্য জেএমবি’ নামে পরিচিতি পাওয়া এ সংগঠনের কথিত শুরা কমিটি গাইবান্ধার সাঘাটায় বৈঠক করে এই সিদ্ধান্ত নেন। হামলার পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও বাস্তবায়নের সঙ্গে যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন, তাঁদের ১৩ জন পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছেন।
হোলি আর্টিজানসহ পরবর্তী জঙ্গিবিরোধী ১৫টি অভিযানে ৬৪ জঙ্গি নিহত হন। এঁদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ১১ জন।
মামলার তদন্ত এবং বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার জঙ্গিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার গুলশানে ইতালির নাগরিক সিজার তাবেলাকে হত্যা করা হয়। এরপর একের পর এক বিদেশি নাগরিক, খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী, হিন্দু পুরোহিত, শিয়া অনুসারীকে হত্যা, শিয়া ও আহমদিয়া মসজিদে হামলার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসে নব্য জেএমবি। এরই ধারাবাহিকতায় তারা রাজধানীতে বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার বোনারপাড়া এলাকায় একটি বাড়িতে নব্য জেএমবি শুরা কমিটির বৈঠক হয়। বৈঠকে নব্য জেএমবির প্রধান সংগঠক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরী ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় বড় ধরনের হামলার প্রস্তাব করেন। পরে হামলার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে শুরা কমিটি। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, হামলার মূল সমন্বয়ক হবেন তামিম চৌধুরী।
তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, হোলি আর্টিজানে হামলার পেছনে জঙ্গিদের তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমত, কূটনৈতিক এলাকায় হামলা করে নিজেদের সামর্থ্য জানান দেওয়া; দ্বিতীয়ত, বিদেশি হত্যা করে নৃশংসতার প্রকাশ ঘটানো এবং তৃতীয়ত দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পাওয়া।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রটি আরও জানায়, শুরা কমিটি হামলার প্রস্তাব অনুমোদন করার পর হামলার জন্য পাঁচজন ইসাবা (আক্রমণকারী) বাছাই করার জন্য নব্য জেএমবির তখনকার সামরিক কমান্ডার শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁর মতে, ঢাকার কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আক্রমণ করতে গেলে অবশ্যই ঢাকায় বসবাসরত কাউকে লাগবে। তখন নব্য জেএমবির ঢাকার সামরিক কমান্ডার আবু রায়হান ওরফে তারেক কথিত হিজরতে থাকা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোহান ইমতিয়াজ, স্কলাসটিকার ছাত্র সামিউল মোবাশ্বির, মোনাশ ইউনিভার্সিটির মালয়েশিয়া ক্যাম্পাসের ছাত্র নিবরাস ইসলামকে প্রস্তাব করেন।
এই পাঁচজনসহ বেশ কয়েকজন কথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়ে তখন ঝিনাইদহ, বগুড়া, গাইবান্ধা, পাবনায় জঙ্গিদের ভাড়া বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। বাড়ি ছাড়ার পর এসব তরুণকে বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় রেখে জঙ্গিবাদের বিষয়ে তাত্ত্বিক দীক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা হয়। গুলশান হামলায় জড়িত পাঁচজনকে দিয়েও বিভিন্ন সময় ঝিনাইদহ, টাঙ্গাইল ও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় হিন্দু পুরোহিত, ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টান, শিয়াসহ বেশ কয়েকজনকে হত্যা করানো হয়। এভাবে তাঁদের মানুষ খুনে অভ্যস্ত করা হয়। পরে তাঁদের বোঝানো হয়, জিহাদ করতে সিরিয়ায় যাওয়ার দরকার নেই। দেশেও অনেক কাজ আছে। ২০১৬ সালের মে মাসের শুরুতে গুলশান হামলার জন্য নির্বাচিত পাঁচজনকে মারজানের কাছে পাঠান কথিত সামরিক কমান্ডার খালিদ। মারজান তাঁদের নিয়ে যান গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার ফুলছড়ি চরে। সেখানে ক্যাম্প করে তাঁদের ২৮ দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেখানে মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ছিলেন প্রধান প্রশিক্ষক। তিনি একে-২২ রাইফেল ও পিস্তল চালানোর প্রশিক্ষণ দেন জঙ্গিদের।
হামলার জন্য অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংগ্রহ করতে নব্য জেএমবির রাশেদ ওরফে র্যাস ও সাগরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। রাশেদ চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে মে মাসে চারটি পিস্তল এনে ছোট মিজানকে দেন। তিনি আমের ঝুড়িতে করে এসব অস্ত্র ঢাকায় এনে বাশারুজ্জামানকে দেন। বাশারুজ্জামান অস্ত্রগুলো পৌঁছে দেন মারজানের কাছে। একইভাবে সাগর ও ছোট মিজান পাঁচটি একে-২২ রাইফেল একই সীমান্ত দিয়ে আনেন। ভারত থেকে এসব অস্ত্র সংগ্রহে সহায়তা করেন বড় মিজান। মে মাসে যশোরের চৌগাছা সীমান্ত দিয়ে হামলায় ব্যবহৃত বোমা আনেন সাগর। হামলা পরিচালনার জন্য ২৮ জুন তামিম বিদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা আনেন।
জঙ্গি হামলায় পুলিশের দুই সদস্যসহ দেশি-বিদেশি ২০ জন নিহত হন। তাঁরা হলেন ফারাজ হোসেন, অবিন্তা কবির, ইশরাত আখন্দ, সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল করিম, ওসি সালাহউদ্দিন খান, তারিশি জৈন, ক্লাউদিয় কাপেল্লি, ভিনচেনসো দালেস্ত্রো, মার্কো তোন্দাৎ, নাদিয়া বেনেদিত্তি, সিমোনা মন্তি, ক্রিস্তিয়ান রসি, মারিয়া রিবোলি, আদেলে পুলিজি, ক্লাউদিয়া দান্তোনা, ওকামুরা মাকাতো, কোয়ো ওগাসাওয়ারা, হাসিমাতো হিদেকো, তানাকা হিরোশি, সাকাই ইউকু, শিমুধুইরা রুই, কুরুসাকি নুবুহিরি।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। একটি নতুন জঙ্গি সংগঠন মাথাচাড়া দিতে চেয়েছিল। তাদেরও আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি।’