‘অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশ: মুক্তচিন্তা ও বাক্‌স্বাধীনতা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা। ‘সংবিধানবিষয়ক সিরিজ আলোচনার’ অংশ হিসেবে এ সভার আয়োজন করে ডেইলি স্টার। ঢাকা, ১৬ নভেম্বর
‘অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশ: মুক্তচিন্তা ও বাক্‌স্বাধীনতা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা। ‘সংবিধানবিষয়ক সিরিজ আলোচনার’ অংশ হিসেবে এ সভার আয়োজন করে ডেইলি স্টার। ঢাকা, ১৬ নভেম্বর

আলোচনা সভায় বিশিষ্টজনেরা

মতপ্রকাশের বিষয়টি যেন তথ্যভিত্তিক হয়

সৃজনশীলতার পূর্বশর্ত হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা। মতপ্রকাশ করতে না পারলে সৃজনশীল চর্চার পরিবেশ নষ্ট হয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আইন করে মুক্তচিন্তাকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। বিগত সময়ে বাক্‌স্বাধীনতা ও মৌলিক চিন্তা মুমূর্ষু অবস্থায় ছিল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশে মতপ্রকাশের সুযোগ ফিরে এসেছে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, মতপ্রকাশের বিষয়টি যেন তথ্যভিত্তিক হয়।

‘অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশ: মুক্তচিন্তা ও বাক্‌স্বাধীনতা’ শীর্ষক এক সভায় বিশিষ্টজনদের আলোচনায় এসব বিষয় উঠে এসেছে। শনিবার সকালে রাজধানীর ফার্মগেটে দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ‘সংবিধানবিষয়ক সিরিজ আলোচনার’ অংশ হিসেবে এ সভার আয়োজন করে ডেইলি স্টার।

আলোচনার শুরুতেই কথা বলেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম। তিনি বলেন, ‘আপনি যখন স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে পারছেন, তখনই আপনার নিজের যে সৃজনশীলতা, সেটির চর্চার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। অতীত সরকার ও বর্তমান সরকারের দিকে তাকালে দেখব, এখন অন্যতম অর্জন হচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। একজন সাংবাদিক হিসেবে বলব, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৫ বছরে আমরা সত্যিকার অর্থে স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতা করতে পারিনি।’

মতপ্রকাশ করতে না পারলে সৃজনশীলতার চর্চার পরিবেশ নষ্ট হয় উল্লেখ করে মাহ্‌ফুজ আনাম বলেন, ব্যক্তিগত পর্যায়ে একজন লেখক, একজন ফটোগ্রাফার, কার্টুনিস্ট, গায়ক, আর্টিস্ট—তাঁরা সৃজনশীলতা প্রকাশ করেন। এই সৃজনশীলতার একদম মুখ্য বিষয় হচ্ছে মতপ্রকাশ ও চিন্তার স্বাধীনতা। তবে মতপ্রকাশ যেন তথ্যভিত্তিক হয়, তার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।

ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম বলেন, ‘আমরা যখন ক্ষমতার বাইরে থাকি, খন মতপ্রকাশ নিয়ে আমাদের অনেক আকাঙ্ক্ষা, অনেক দাবি। আবার ক্ষমতায় যাই, তখন সেই মতপ্রকাশ হয় ভিন্ন কিছু। একটা মত প্রকাশ হলে আপনি খুশি হবেন, আবার আরেকটি মত প্রকাশ হলে আপনি বেজার হবেন। খুশি বা বেজার হওয়ার অধিকার আপনার আছে। কিন্তু বেজার হয়ে আপনি তাঁর (যিনি ভিন্নমত প্রকাশ করছেন) ওপর আক্রমণ চালাচ্ছেন, সেটি করা যাবে না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে যেটি আসে পরমতসহিষ্ণুতা। এটা কীভাবে করা যায়, সেটি নিয়ে চিন্তা করতে হবে।’

অতীত সরকার ও বর্তমান সরকারের দিকে তাকালে দেখব, এখন অন্যতম অর্জন হচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা।
মাহ্‌ফুজ আনাম, সম্পাদক, দ্য ডেইলি স্টার

এ সভায় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম বলেন, বিচার–বিশ্লেষণ, ভিত্তিসহ একটা মতপ্রকাশ করা বা দায়িত্ব নিয়ে মন্তব্য করা এক বিষয়। আর যা ইচ্ছা তাই বলে দেওয়া, সেটা আরেকটি বিষয়। সমাজ ও দলের মধ্যে গণতন্ত্র না থাকাতে ভিন্নমত নিয়ে একত্রে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, বিচিত্র মত-পথ ও মতাদর্শের মানুষ কীভাবে নিজেদের মত-পথ ও মতাদর্শ অক্ষুণ্ণ রেখে একসঙ্গে কাজ করতে পারে, তার বাস্তব উদাহরণ দেখা গেছে শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানে।

বিগত কয়েকটা সরকারের আমলে বাক্‌স্বাধীনতা ও মৌলিক চিন্তা মুমূর্ষু অবস্থায় ছিল বলে সভায় উল্লেখ করেন আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন। তিনি বলেন, ভয়ের সংস্কৃতি ডিএনএর ভেতর ঢুকে আছে। এখান থেকে বের হতে হবে। নতুন চিন্তা করতে হবে।

একটি রাষ্ট্রর চরিত্রের ওপর বাক্‌স্বাধীনতা নির্ভর করে বলে মনে করেন গীতিকার শহীদুল্লাহ ফরায়জী। তিনি বলেন, একটি রাষ্ট্রের চরিত্র গণতান্ত্রিক কি না, রাষ্ট্র গণমুখী কি না, রাষ্ট্র নৈতিকতামুখী কি না, বাস্তবতামুখী কি না—এসবের ওপর বাক্‌স্বাধীনতা নির্ভর করে। তিনি বলেন, অতীতে দেখা গেছে, যাঁরা ক্ষমতায় যান, তাঁরা সংবিধান-আইনকে তুচ্ছ করেন। সংবিধানকে শাসক দল মনে করে তাদের হাতের খেলনা। শাসকের বাড়াবাড়িকে, শাসকের ক্ষমতার সীমা অতিক্রমের পথকে বন্ধ করা না গেলে কোনো স্বাধীনতা কাজে লাগবে না।

বাক্‌স্বাধীনতার বিষয়ে দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের (ইউপিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহরুখ মহিউদ্দিন বলেন, যাঁরা ভিন্নমত পোষণ করেন, তাঁদের সঙ্গে মিশতে হবে, পারস্পরিক আদান-প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। পরিবার থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়েও অন্যের মতকে সহ্য করার চর্চা করতে হবে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এ চর্চা থাকতে হবে।

‘কালাকানুন বাতিল করতে হবে’

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর মতপ্রকাশের জন্য কাউকে মামলা বা পুলিশি হয়রানির শিকার হতে হয়নি বলে সভায় উল্লেখ করেন লেখক মশিউল আলম। তাঁর মতে, মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে যে স্বাধীনতা এখন রয়েছে, সেটিকে স্থায়ী রূপ দিতে হলে কতগুলো আইনি সুরক্ষা দরকার। প্রথমত, সাইবার নিরাপত্তা আইনের মতো যেসব কালাকানুন রয়েছে, সেগুলো বাতিল করতে হবে। দ্বিতীয়ত, স্বাধীন মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক হাতিয়ার হতে পারে, এমন কোনো ধরনের আইন প্রণয়ন করা যাবে না।

অনুষ্ঠানে কবি সাখাওয়াত টিপু বলেন, এমন একটা মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, যেখানে প্রত্যেক মানুষ নিজের অধিকারের কথা বলবে সহিঞ্চু উপায়ে, অন্যের জায়গা খর্ব না করে।

বিচার-বিশ্লেষণ, ভিত্তিসহ একটা মতপ্রকাশ করা বা দায়িত্ব নিয়ে মন্তব্য করা এক বিষয়। আর যা ইচ্ছা তাই বলে দেওয়া, সেটা আরেকটি বিষয়।
মোহাম্মদ আজম, মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি

ভিন্নমত প্রকাশের কারণে এখন সরকারি দমন-পীড়ন নেই। তবে অনেকে ব্যক্তিগত আক্রমণের মুখে পড়ছেন বলে উল্লেখ করেন ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের যুক্ত থাকা লুৎফুন্নাহার। ওই সময় আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় তাঁকে কারাগারে যেতে হয়েছিল। তিনি বলেন, ভিন্নমত নেওয়ার ক্ষেত্রে সহনশীলতার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। অনেকে হিংস্রভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, বিষয়টি ফ্যাসিবাদের মতো কারও কারও মস্তিষ্কে ঢুকে গেছে।

অনুষ্ঠানে সঞ্চালক ছিলেন আইনজীবী আরিফ খান। তিনি বলেন, মুক্তচিন্তা ও বাক্‌স্বাধীনতার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ রয়েছে। প্রথমত, বাক্‌স্বাধীনতার যে অধিকার, সেটির স্বীকৃতি থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, এই অধিকারের সুরক্ষা থাকতে হবে। তৃতীয়ত, স্বীকৃতি ও সুরক্ষার যে কাঠামো তৈরি করা হয়েছে, সেটি চলমান রাখতে হবে। বাক্‌স্বাধীনতার ওপর কোনো আঘাত এলে সেই আঘাতকে রুখে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সামাজিক সম্প্রীতি বা সমর্থনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাকির সবুর ও মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খোরশেদ আলম, গবেষক–শিক্ষক খান মো. রবিউল আলম, সাংবাদিক মাশরুর শাকিল, ইমরান মাহফুজ, আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন প্রমুখ।