অক্সিজেন কারখানায় দুর্ঘটনা

সীতাকুণ্ডে ভয়াবহ বিস্ফোরণ, নিহত ৬

বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে কারখানার আশপাশের অন্তত এক বর্গকিলোমিটার এলাকা। গুরুতর আহত ২৫।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত অক্সিজেন প্ল্যান্টে হতাহতদের উদ্ধারে নামেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ও স্থানীয় ব্যক্তিরা। শনিবার সন্ধ্যা ছয়টায়
ছবি: সৌরভ দাশ

বছর না ঘুরতেই আবারও ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে। এবারের ঘটনাটি সীতাকুণ্ড উপজেলার কদমরসুল এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে সীমা অক্সিজেন লিমিটেড নামের একটি কারখানায়। শিল্পে ব্যবহৃত অক্সিজেন উৎপাদনের এই কারখানায় গতকাল শনিবার বিকেলে বিকট শব্দে হঠাৎ বিস্ফোরণে ছয়জন নিহত হয়েছেন। গুরুতর আহত হয়েছেন ২৫ জন।

বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে কারখানার আশপাশের অন্তত এক বর্গকিলোমিটার এলাকা। বিচ্ছিন্ন লোহার টুকরা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। বিস্ফোরণস্থল থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূর পর্যন্ত উড়ে যায় লোহার পাত।

এর আগে গত বছরের ৪ জুন রাতে সীতাকুণ্ডের কেশবপুরে বিএম ডিপোতে আগুন থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণে নিহত হন ৫০ জন। এই কারখানা থেকে সীমা অক্সিজেন কারখানার দূরত্ব পৌনে এক কিলোমিটার। বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণের পর সীতাকুণ্ডের ভারী শিল্প এলাকায় অগ্নিনিরাপত্তাসহ কর্মসহায়ক পরিবেশ নিশ্চিতে তদারকি শুরু করেছিল ফায়ার সার্ভিস। এরপরও সেখানকার বিভিন্ন কারখানায় ছোটখাটো দুর্ঘটনা লেগেই আছে। মৃত্যুও হচ্ছে। ফলে কারখানা নিরাপদ করার কার্যক্রম কতটা এগিয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

যেভাবে বিস্ফোরণ

সীতাকুণ্ডের সীমা অক্সিজেন কারখানায় দিনে মোট তিন পালায় অক্সিজেন উৎপাদন করা হয়। গতকাল বিকেলের পালার অক্সিজেন রিফুয়েলিংয়ের (সিলিন্ডারে অক্সিজেন ভরা) কাজ চলছিল। এ সময় হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এই কারখানায় তিন পালায় মোট ১৫০ জন শ্রমিক কাজ করেন। প্রতি পালায় কাজ করেন ৫০ জন। রিফুয়েলিংয়ের কাজে থাকেন চার-পাঁচজন, বাকিরা অন্য কাজ করেন।

সিলিন্ডারে অক্সিজেন ভরার সময় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করছে ফায়ার সার্ভিস। বিস্ফোরণের পর অন্যদের সঙ্গে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে যান চট্টগ্রাম শহরের আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের কর্মীরাও। সেখানে এই স্টেশনের সহকারী পরিচালক আবদুল মালেক সাংবাদিকদের বলেন, বিস্ফোরণের অনেক কারণ থাকতে পারে। তদন্তে বোঝা যাবে। তবে সিলিন্ডার থেকে বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করছেন তাঁরা।

আবদুল মালেক বলেন, বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটে (শনিবার) বিস্ফোরণের সংবাদ পান তাঁরা।। প্রথমে সীতাকুণ্ডের কুমিরা ফায়ার স্টেশনের দুটি গাড়ি গিয়ে দ্রুত উদ্ধারকাজ শুরু করে। এরপর একে একে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি স্টেশনের ১০টি গাড়ি ঘটনাস্থলে চলে আসে। সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। রাত আটটার পর উদ্ধারকাজের আপাতত সমাপ্তি টানা হয়। রোববার সকাল থেকে আবার উদ্ধারকাজ চালানো হবে।

কেঁপে ওঠে এক কিলোমিটার এলাকা

অক্সিজেন কারখানায় বিস্ফোরণের বিকট শব্দে প্রায় এক বর্গকিলোমিটার এলাকা কেঁপে ওঠে। কারখানার আশপাশের এলাকার বেশ কিছু ভবনের জানালার কাচ ভেঙে গেছে। বিস্ফোরণের শব্দে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। কারখানা থেকে আধা কিলোমিটার দূরে উড়ে আসা লোহার পাত বিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন দুজন।

ঘটনাস্থলের এক কিলোমিটারের মধ্যে ‘ইনফিনিয়া’ নামে একটি তৈরি পোশাক কারখানা আছে। ওই কারখানার জানালার বেশির ভাগ কাচ ভেঙে গেছে। কারখানার শ্রমিক রোকেয়া বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিকট শব্দে ভয় পেয়ে যাই। অল্পের জন্য ভাঙা কাচ গায়ে লাগেনি।’

বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত অক্সিজেন পরিবহনের একটি ট্রাক। শনিবার সন্ধ্যা সাতটায় সীতাকুণ্ডের কদমরসুল এলাকায়

স্থানীয় বাসিন্দা রিদওয়ানুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বিস্ফোরণের পর কদমরসুল এলাকায় ঘন কালো ধোঁয়া ওপরের দিকে উঠতে দেখেন।

গতকাল সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, বিস্ফোরণের কারখানা ভবনের ছাউনি উড়ে গেছে। টিন আর লোহার পাতের টুকরা ছড়িয়ে আছে আশপাশে। ভবনের লোহার খুঁটিগুলোও হেলে পড়েছে। সিলিন্ডারবাহী দুটি ট্রাকের একটির সামনের অংশ পুড়ে যায়। অন্যটির দরজা-জানালার কাচ উড়ে গেছে। কারখানা এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে গ্যাস সিলিন্ডার। ধসে পড়েছে কারখানার দেয়াল।

কারখানায় কী হতো

সীমা অক্সিজেন কারখানায় শিল্পে ব্যবহারের অক্সিজেন উৎপাদিত হয়। ১৯৯৭ সালে এই কারখানা চালু হয়। দিনে ৪০০-৪৫০ সিলিন্ডার অক্সিজেন উৎপাদিত হতো এই কারখানায়। এটি সীমা গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। গ্রুপটির রড তৈরির কারখানা এবং জাহাজভাঙা কারখানার ব্যবসা রয়েছে।

মূলত জাহাজভাঙার লোহা কাটার কাজে এই অক্সিজেন ব্যবহৃত হয়। কারখানায় উৎপাদিত অক্সিজেন বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করা হয়।

বিস্ফোরণের পর গত রাতে কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন উদ্দিনের সঙ্গে মুঠোফোনে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করেছে প্রথম আলো। তবে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে সীমা গ্রুপের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছেন, কারখানায় নিয়মিত সিলিন্ডার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হতো। তবে কী কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা এখনো নিশ্চিত নন তাঁরা।

তদন্ত কমিটি

কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনায় সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। গতকাল সন্ধ্যায় এই কমিটি গঠন করা হয়।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। কমিটিকে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রধান থাকবেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। আর কমিটির সদস্য হিসেবে থাকবেন সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা; ফায়ার সার্ভিস, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং বিস্ফোরক পরিদপ্তরের একজন করে প্রতিনিধি।

কারও পা থেঁতলে গেছে, কারও মাথায় আঘাত

দুর্ঘটনার পর বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে আহত শ্রমিকদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা শুরু হয়। গত রাত নয়টা পর্যন্ত একে একে ২০ জনকে অ্যাম্বুলেন্স ও মিনিট্রাকে করে হাসপাতালে আনা হয়। আহত ব্যক্তিদের কারও পা থেঁতলে গেছে, কারও মাথায় আঘাত, কারও চোখে গুরুতর জখম রয়েছে।

বিস্ফোরণে নিহত ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন সীতাকুণ্ড উপজেলার জাহানাবাদ এলাকার শামছুল আলম (৫৬), ভাটিয়ারী বিএমএ গেট এলাকার মো. ফরিদ (৩৬), নেত্রকোনা জেলার কমলাকান্দা উপজেলার রতন লকরেট (৪৫), নোয়াখালীর আবদুল কাদের ও লক্ষ্মীপুরের মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন। এই পাঁচজনের মধ্যে শামছুল আলম ও সালাহউদ্দিন কারখানার কর্মী নন। ঘটনার সময় তাঁরা ছিলেন কারখানা থেকে আধা কিলোমিটার দূরে। নিহত আরেকজনের পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ছয়জনের লাশ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মর্গে রাখা হয়েছে।

নিহত মোহাম্মদ ফরিদের স্ত্রী রাশেদা আক্তার তাঁর স্বামীকে খুঁজে পান মর্গে। তখন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায়। স্বামীর লাশ দেখে মাটিতে লুটিয়ে বিলাপ করতে থাকেন তিনি। রাশেদা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের সংসারে তিন মেয়ে। সবাই ছোট। ফরিদের একার আয়েই চলত সংসার। ট্রাকচালকের সহকারীর কাজ করে ১৩ থেকে ১৫ হাজার টাকা পেতেন। এখন মেয়েদের কে দেখবে, সংসার কে চালাবে।