ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে চুপ করে বসেছিলেন মা আয়েশা খাতুন। এ সময় একজন মুঠোফোনে মো. শাহজাহানের ছবি দেখান তাঁকে। তখন মুঠোফোনে চুমু দিয়ে আয়েশা খাতুন চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠে বলেন, ‘ও শাহজাহান, আমাকে ফাঁকি দিয়ে তুই কই চলে গেলিরে বাবা!’
মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত আয়েশা খাতুন ঢাকা মেডিকেলের মর্গের সামনে বসে ছিলেন। কিছুক্ষণ পরপর তিনি চিৎকার দিয়ে প্রশ্ন করছিলেন, ‘আমার ছেলে তো কোনো রাজনীতি করত না। ফুটপাতে ব্যবসা করত। আমার নিরীহ ছেলেকে মারল কে?’
মঙ্গলবার দুপুর থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতা–কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় সেখানে মারধরের শিকার হয়ে দুই যুবকের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের একজন ২৫ বছর বয়সী মো. শাহজাহান। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার পর তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সন্ধ্যার দিকে শাহজাহানকে সিটি কলেজের সামনের রাস্তায় আহত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। সেখান থেকে তাঁকে উদ্ধার করে পাশের পপুলার মেডিকেল ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নেওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে শাহজাহানকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়।
ঢাকা মেডিকেলে আনতে আনতে শাহজাহানের মৃত্যু হয়। তখনো তাঁর পরিচয় জানা ছিল না। ঘণ্টাখানেক পরে মা আয়েশা খাতুন এসে ছেলের লাশ শনাক্ত করেন।
অনেক কষ্ট করে শাহজাহানকে বড় করে তোলার কথা জানিয়ে বিলাপ করে আয়েশা খাতুন বলেন, ‘এত কষ্ট করে শাহজাহানকে বড় করে তুললাম, বিয়ে করালাম, আজ গুলি করে আমার ছেলেকে মেরে ফেলা হলো। আমি ছেলে হত্যার বিচার চাই।’
শাহজাহানের বয়স যখন দুই বছর, তখন স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয় আয়েশা খাতুনের। দুই বছরের ছোট্ট শাহজাহানসহ চার সন্তান নিয়ে আয়েশার জীবনসংগ্রাম শুরু হয়। বুটিকের কাজ করে যে আয় করতেন, তা দিয়ে সন্তানদের মুখে আহার তুলে দিতেন এই মা। এভাবে কষ্ট করে সন্তানদের বড় করে তোলেন তিনি। আয়েশার বড় ছেলে শাওন। কয়েক বছর আগে বড় ছেলেকে বিয়ে দেন। এরপর মেজ ছেলে শাওনীলও বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছেন। আর ছোট ছেলে শাহজাহানকে দুই বছর আগে বিয়ে করান মা আয়েশা। শাহজাহান স্ত্রী ফাতিহা খাতুনকে নিয়ে কামরাঙ্গীরচরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন। পাশেই একটি বাসায় থাকেন তাঁর মা।
আয়েশা খাতুন জানান, নিউমার্কেটের বলাকা সিনেমা হলের সামনের ফুটপাতে পাপোশ বিক্রি করতেন শাহজাহান। মাস কয়েক আগে ফুটপাত থেকে তাঁদের উঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর তিনি বেকার হয়ে পড়েন। তার পর থেকে ছোটখাটো নানা কাজ করে সংসার চালিয়ে আসছিলেন। সকালে তিনি কাজের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হন। আয়েশা খাতুন বেলা ১টার দিকে ফোনে ছেলের খোঁজ নেন। তখন শাহজাহান তাঁর মাকে বলেন, তিনি দ্রুত বাসায় ফিরে আসবেন। মিনিট দুয়েক কথা বলার পর মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন শাহজাহান।
আয়েশা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার এক নাতি অসুস্থ। তাকে নিয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালে আছি। সকালে না খেয়ে শাহজাহান বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।’
শাহজাহানের স্ত্রী ফাতিহা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সকালে না খেয়ে বেরিয়ে যান আমার স্বামী। এরপর টিভিতে গন্ডগোল হওয়ার খবর শুনি। দুপুর ১২টায় স্বামীকে ফোন করি। আবার বেলা ৩টায় তাঁকে ফোন করি। আমি বারবার জিজ্ঞাসা করি, “তুমি কোথায়? তখন সে বারবার বলছিল, আমি নিরাপদে আছি। বাসায় ফিরে আসছি।”’
এরপর সন্ধ্যায় আয়েশা খাতুনের মুঠোফোনে কল আসে শাহজাহানের মুঠোফোন থেকে। আয়েশা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফোন পেয়ে আমি বলি, ও শাহজাহান। তখন অন্য একজন বলেন, শাহজাহানের মাথায় গুলি লেগেছে। সে পপুলার মেডিকেলে। এরপর শুনলাম, আমার ছেলেকে গুলি করে মেরেছে।’
স্বামীহারা ফাতিহা খাতুন মর্গের সামনে বিলাপ করছিলেন। তিনি বারবার বলছিলেন, ‘এই বয়সে আমি বিধবা হয়ে গেলাম। যাঁদের কারণে আমার স্বামীর প্রাণ গেছে, আমি তাঁদের বিচার চাই।’