‘যেদিন থেকে আমার মেয়ে কারাগারে, সেদিন থেকে আমাদের অশান্তি শুরু। এখন মেয়েকে কারাগারে রেখে আমরা কীভাবে ঈদ উদ্যাপন করব? কখনো ভাবিনি, এভাবে মেয়ের দিন কাটবে কারাগারে,’ কথাগুলো বলছিলেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কারাবন্দী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরার মা ফাতেমা খাতুন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী খাদিজাতুল কুবরা আট মাস ধরে কারাগারে আছেন। আর দুই ছেলে–মেয়েকে নিয়ে মিরপুরের বাসায় আছেন ফাতেমা খাতুন। খাদিজাতুল কুবরার বাবা থাকেন বিদেশে।
ফাতেমা খাতুন প্রথম আলোকে জানান, খাদিজাদের ছোটবেলা থেকেই ঈদের কেনাকাটার জন্য তাদের বাবা টাকা পাঠাতেন। সেই টাকায় খাদিজা বিভিন্ন বিপণিবিতান ঘুরে ঘুরে নিজের পছন্দের জামাকাপড় কিনত। এবারও তার বাবা খাদিজাদের কেনাকাটার জন্য টাকা পাঠিয়েছেন। সেই টাকা দিয়ে ঈদের পোশাক কিনে দুই সপ্তাহ আগে কারাগারে খাদিজাকে দিয়ে এসেছেন তিনি। খাদিজাতুল কুবরা বর্তমানে কাশিমপুর মহিলা কারাগারে আছেন।
ঈদের আগে মেয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা তুলে ধরে ফাতেমা খাতুন গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মেয়ে পড়াশোনায় সব সময় ভালো। অনেক স্বপ্ন নিয়ে সে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু আমার মেয়ের সব স্বপ্ন নষ্ট হতে চলেছে। সে চেয়েছিল ভালো ফলাফল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে। কিন্তু আট মাস ধরে মেয়ে আমার জেল খেটে চলেছে। আর কত দিন তাকে জেল খাটতে হবে, জানি না।’
অনলাইনে সরকারবিরোধী বক্তব্য প্রচার এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অভিযোগে ২০২০ সালের অক্টোবরে খাদিজাতুল কুবরা এবং অবসরপ্রাপ্ত মেজর দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রাজধানীর কলাবাগান ও নিউমার্কেট থানায় আলাদা দুটি মামলা করে পুলিশ।
একটি মামলার বাদী নিউমার্কেট থানার উপপরিদর্শক (এসআই) খাইরুল ইসলাম এবং অন্যটির কলাবাগান থানার এসআই আরিফ হোসেন। দুই বাদীই দায়িত্ব পালনকালে মুঠোফোনে ইউটিউবে ঘুরতে ঘুরতে খাদিজাতুল কুবরা ও মেজর (অব.) দেলোয়ার হোসেনের ভিডিও দেখতে পান। তারপর দুজনই নিজ নিজ থানায় বাদী হয়ে মামলা করেন।
নিউমার্কেট থানার মামলায় এসআই খাইরুল ইসলাম বলেন, ২০২০ সালের ১১ অক্টোবর সকাল ৬টা ২৫ মিনিটের সময় মুঠোফোনে মেজর (অব.) দেলোয়ারের ইউটিউব চ্যানেলে একটি ভিডিও দেখতে পান। ‘হিউম্যানিটি ফর বাংলাদেশ’ শিরোনামের ভিডিওর সঞ্চালক খাদিজাতুল কুবরার উপস্থাপনায় দেলোয়ার হোসেন তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশের বৈধ গণতান্ত্রিক সরকার উৎখাতের বিভিন্ন নির্দেশনা দেন।
মামলায় অভিযোগ আনা হয়, খাদিজাতুল কুবরা ও দেলোয়ার ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেশের বৈধ সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মনগড়া, বানোয়াট, মিথ্যা, মানহানিকর অপপ্রচার চালিয়ে আসছিলেন। আসামিরা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা, বিদ্বেষ সৃষ্টির অপচেষ্টাসহ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের প্রয়াস চালাচ্ছেন।
আর কলাবাগান থানার মামলায় এসআই আরিফ হোসেন বলেন, ২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর রাত ৯টা ১৫ মিনিটে মুঠোফোনে ইউটিউব দেখার সময় দেলোয়ার হোসেনের ইউটিউব চ্যানেল দেখতে পান। ওই দিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে তিনি থানায় মামলা করেন। দুই মামলার অভিযোগের ভাষ্য প্রায় একই রকম।
গত বছরের মে মাসে পুলিশ দুই মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়। সেই অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল খাদিজাতুল কুবরার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। পরে গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর খাদিজাতুল কুবরাকে গ্রেপ্তার করে নিউমার্কেট থানা-পুলিশ। এরপর থেকে কারাগারে আছেন তিনি।
ওই মামলায় বিচারিক আদালতে দুই দফায় ওই শিক্ষার্থীর জামিন আবেদন নাকচ হয়। পরে গত ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্ট তাঁর জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন। তবে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের দেওয়া জামিন আদেশ স্থগিত করেন চেম্বার বিচারপতি।
খাদিজাতুল কুবরার আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থীর জামিন দেন হাইকোর্ট। তবে চেম্বার বিচারপতি ওই আদেশ স্থগিত করেন। এ নিয়ে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি হবে।
মামলায় অভিযোগ আনা হয়, ‘খাদিজাতুল কুবরা ও দেলোয়ার ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেশের বৈধ সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মনগড়া, বানোয়াট, মিথ্যা, মানহানিকর অপপ্রচার চালিয়ে আসছিলেন। আসামিরা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা, বিদ্বেষ সৃষ্টির অপচেষ্টাসহ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের প্রয়াস চালাচ্ছেন।’
‘স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সুযোগ দেওয়া হোক’
খাদিজাদের গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জে। তবে তাঁর বেড়ে ওঠা ঢাকায়। খাদিজার বড় বোন সিরাজুম মুনিরা। তিনি স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী। তাঁর ছোট ভাই মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। খাদিজার বড় বোন সিরাজুম মুনিরা জানালেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় তাঁর ছোট বোন কারাগারে যাওয়ার পর থেকে মা–বাবা সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা করেন। আর ঈদের আগে বোন কারাগারে থাকায় মা–বাবা আরও বেশি দুশ্চিন্তা করছেন। মেয়ের কথা মনে উঠলে মা কেবল কান্নাকাটি করেন। সিরাজুম মুনিরা বলেন, ‘মা কেবলই বলে চলেছেন, খাদিজাকে কারাগারে রেখে কীভাবে ঈদ উদ্যাপন করব?’
সিরাজুম মুনিরা জানান, ঈদের দিন খাদিজার সঙ্গে দেখা করার জন্য মা কারাগারে যাবেন। তাঁর পছন্দের খাবার রান্না করে নিয়ে যাবেন।
তিনি বলেন, ‘আমার বোন কারাগারে যাওয়ার পর আদালত থেকে কারাগার, কারাগার থেকে আইনজীবীর চেম্বারে দৌড়াচ্ছি। জানি না, আর কত দিন আমাদের এভাবে দৌড়াতে হবে। সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ করি, আমার বোনের শিক্ষাজীবন নষ্ট হচ্ছে। আমাদের একটাই চাওয়া, আমার বোনকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সুযোগ দেওয়া হোক।’