সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক এবং ইউটিউব ও টিকটক দুই সপ্তাহ পর বাংলাদেশে সচল হয়েছে। আজ বুধবার বেলা দুইটার পর এসব মাধ্যম চালু হয়। এর আগে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক সাংবাদিকদের বলেন, ‘আজ বিকেল থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো খুলে দেওয়া হবে।’
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কার্যালয়ে সকাল ৯টা থেকে সামাজিক মাধ্যমগুলোর মালিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ। পরে তিনি বলেন, ‘যেসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে কিছুটা সময়ের জন্য সাময়িকভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করেছিলাম, সার্বিক বিবেচনায় আজকে তা প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।’
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ শুরু হলে ১৭ জুলাই রাত থেকে দেশে মোবাইল ইন্টারনেট এবং ১৮ জুলাই রাতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়। পাঁচ দিন পর ২৩ জুলাই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ সীমিত পরিসরে চালু করা হয়। ১০ দিন পর ২৮ জুলাই চালু হয় মোবাইল ইন্টারনেট। কিন্তু বন্ধ ছিল মেটার প্ল্যাটফর্ম ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইনস্টাগ্রাম। এ ছাড়া টিকটকও বন্ধ রাখা হয়। অন্যদিকে ব্রডব্যান্ড সংযোগে ইউটিউব চালু থাকলেও মোবাইল ডেটায় তা বন্ধ ছিল।
সরকার বলছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সাম্প্রতিক ঘটনায় দায়িত্বশীল আচরণ করেনি। তাই বিটিআরসি থেকে তাদের গত ২৭ জুলাই সশরীর হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে চিঠি দেওয়া হয়। আজ প্রতিমন্ত্রী জানান, ইউটিউব ই-মেইলে ব্যাখ্যা দিয়েছে। ফেসবুকের প্রতিনিধি অনলাইনে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। টিকটকের প্রতিনিধি সশরীর হাজির হন।
প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ বলেন, ফেসবুক-ইউটিউবে গুজব ছড়িয়ে দেওয়ার ফলে প্রাণহানি ও ক্ষতির পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এর দায় তারা কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। মাধ্যমগুলো বাংলাদেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং সরকার ও জনগণের সম্পদ রক্ষার জন্য সরকারকে সহযোগিতা করবে বলে তিনি প্রত্যাশা করেন।
সংঘর্ষের সময় ১৬ থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত যেসব আধেয় বা কনটেন্ট অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে, সেগুলোর ব্যাপারে সরকার বৈঠকে অসন্তোষ প্রকাশ করে। প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ জানান, প্ল্যাটফর্মগুলো ভবিষ্যতে আরও সতর্কতার সঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে তাঁদের আশ্বস্ত করেছে। তারা স্বীকার করেছে যে ১৪ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত যতটা সাড়া দেওয়ার কথা ছিল, তারা তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। পাশাপাশি নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়েছে।
ফেসবুক থেকে বাংলাদেশের জন্য নিয়োগ দেওয়া তথ্য যাচাইকারী বা ফ্যাক্ট চেকাররা নিরপেক্ষ নন বলে উল্লেখ করে জুনাইদ আহ্মেদ বলেন, তাঁদের অতীত ও বর্তমান কর্মকাণ্ড সরকারবিরোধী, দেশবিরোধী। ফেসবুককে এমন ফ্যাক্ট চেকার নিয়োগ দিতে বলা হয়েছে, যাদের দেশের ইতিহাস, মূল্যবোধ ও আইন সম্পর্কে ধারণা রয়েছে।
প্রতিমন্ত্রীর অভিযোগ, ফেসবুক বাংলা ভাষায় আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা—এই শব্দগুলো দিলে রিচ (ব্যবহারকারীদের সামনে নেওয়া) কমিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে দিলে সেগুলোর রিচ বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সাজাপ্রাপ্ত ও পলাতক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান এবং নির্বাহী আদেশে কারামুক্ত থাকা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ফেসবুক পেজ থেকে পোস্ট দেওয়ার বিষয়টি নিয়েও মেটাকে জানানো হয়েছে।
জুনাইদ আহ্মেদ বলেন, মাধ্যমগুলোকে সরকারের তৈরি শীর্ষ ৫০ জন অপপ্রচারকারীর তালিকা দেওয়া হয়েছে, যাঁরা দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্তে জড়িত।
সবচেয়ে বেশি আধেয় সরিয়েছে টিকটক
কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ চলাকালে সরকার ফেসবুক, টিকটক ও ইউটিউবের কাছে আধেয় সরানোর অনুরোধ করেছিল। আজ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ জানান, ১৬ থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত ফেসবুক সরকারের অনুরোধের বিপরীতে ১৩ শতাংশ এবং ২৫ থেকে ২৭ জুলাই পর্যন্ত ৭ শতাংশের কিছু বেশি আধেয় সরিয়েছে। ইউটিউব ১৭ থেকে ২৬ জুলাই পর্যন্ত সরিয়েছে প্রায় ২১ শতাংশ আধেয়। টিকটক সরিয়েছে প্রায় ৬৮ শতাংশ।
টিকটকের কার্যক্রমে সরকার সন্তুষ্ট উল্লেখ করে জুনাইদ আহ্মেদ বলেন, টিকটক ৭ লাখের মতো আধেয় সরিয়েছে এবং সরকারের ৩৫০টির মতো অনুরোধে সাড়া দিয়েছে। গত ১৮ জুলাই সরকারের শতভাগ অনুরোধই তারা রেখেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে জুনাইদ আহ্মেদ বলেন, টিকটক চীনের প্রতিষ্ঠান নয়। প্রতিষ্ঠানটি থেকেই তাঁদের এ তথ্য জানানো হয়েছে।
তবে সিএনবিসি, বিবিসি ও ফোর্বস–এর প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চীনের টেক জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান বাইটড্যান্সের একটি প্ল্যাটফর্ম টিকটক। আজ বুধবার প্রকাশিত সিএনবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টিকটকের চীনা মালিকানা ও সম্পর্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে তদন্ত করা হয়েছে। চলতি বছরের মার্চে যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ করতে দেশটির কংগ্রেসে একটি বিল পাস হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার অনেক বছর ধরেই চেষ্টা করছে ফেসবুক যাতে তাদের সব অনুরোধে সাড়া দেয়। সরকারবিরোধী আধেয় সরিয়ে দেয়। অবশ্য ফেসবুক তাতে সাড়া দিচ্ছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ফেসবুক তাদের নীতির সঙ্গে না মিললে আধেয় সরিয়ে নেয়। তবে তারা নির্দিষ্ট কোনো দেশের জন্য কাজ করে না। তাদের দায়বদ্ধতা বিশ্বের কাছে। ফেসবুকের আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে হয়। তবে তাদেরও ঘাটতি থাকতে পারে। তিনি আরও বলেন, ইন্টারনেট ও ফেসবুক বন্ধ থাকায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা শুধু আর্থিক ক্ষতিই নয়, দেশের মর্যাদাও ক্ষুণ্ন হয়েছে।