মালয়েশিয়ায় যেতে সব প্রক্রিয়া শেষে চূড়ান্ত ছাড়পত্র নিয়েও যেতে পারেননি ১৬ হাজার ৯৭০ কর্মী। এর মধ্যে একটি অংশ উড়োজাহাজের টিকিট সংগ্রহ করতে পারেনি। আর আরেকটি অংশ মালয়েশিয়া থেকে নিয়োগকর্তার চূড়ান্ত সম্মতি পায়নি। বিমানবন্দর থেকে তাদের গ্রহণ করার নিশ্চয়তা পাঠায়নি নিয়োগকর্তা।
কর্মীদের মালয়েশিয়ায় যেতে সর্বশেষ সময় ছিল ৩১ মে। এটি এক সপ্তাহ বাড়ানোর জন্য সপ্তাহখানেক আগে মালয়েশিয়া সরকারকে অনুরোধ করছিল প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এতে কোনো সাড়া আসেনি। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী গতকাল রোববার বলেছেন, সরকার এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আগামী বুধবার মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হবে।
১ জুন থেকে বন্ধ হয়ে গেছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। আপাতত নতুন করে কোনো কর্মী যেতে পারবেন না দেশটিতে। তবে বন্ধের কারণে অনেকেই যেতে পারেননি। বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) থেকে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৬৪২ কর্মীর ছাড়পত্র নিয়েছে। এর মধ্যে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৬৭২ কর্মী মালয়েশিয়ায় গেছেন। বাকিরা যেতে পারেননি।
মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো নিয়ে চক্র গঠন করে ব্যাপক অনিয়ম ও হাজার হাজার কোটি টাকার বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। এ বাণিজ্যের সঙ্গে চারজন সংসদ সদস্যের (এমপি) সংশ্লিষ্টতা আছে। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘তদন্ত কমিটির মাধ্যমে সবকিছু তদন্ত হবে। এমপি জানি না, চিনি না, রিক্রুটিং এজেন্সি চিনি। দায়ী হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) থেকে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৬৪২ কর্মীর ছাড়পত্র নিয়েছে। এর মধ্যে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৬৭২ কর্মী মালয়েশিয়ায় গেছেন। বাকিরা যেতে পারেননি।
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এমন কথা বলেন প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘সিন্ডিকেটে (চক্র) বিশ্বাস করি না। যে দেশ কর্মী নেবে, তারা যদি তাদের পছন্দের রিক্রুটিং এজেন্সি দিয়ে কর্মী নিতে চায়, সেটা তাদের বিষয়। সরকার চায়, সবার মাধ্যমে কর্মীরা বিদেশে যাক।’ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুলবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
শেষ দিকে কর্মীদের ছাড়পত্র অনুমোদনের বিষয়ে জানতে চাইলে শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, যখন ছাড়পত্র চাওয়া হয়েছে, তখনই দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কর্মীদের উড়োজাহাজের টিকিট নিশ্চিত করতে বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ বিমানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ২৩টি বিশেষ ফ্লাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রবাসী মন্ত্রণালয় কোনো গাফিলতি করেনি।
তদন্ত কমিটির মাধ্যমে সবকিছু তদন্ত হবে। এমপি জানি না, চিনি না, রিক্রুটিং এজেন্সি চিনি। দায়ী হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবেপ্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে দুর্নীতি, অনিয়ম খুঁজে বের করে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। অতিরিক্ত সচিব (কর্মসংস্থান) নূর মো. মাহবুবুল হককে প্রধান করে গঠিত ছয় সদস্যের কমিটিকে আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতেও কাজ করবে এ কমিটি। এ ছাড়া যে কেউ চাইলে এ তদন্ত কমিটির কাছে অভিযোগ করতে পারবেন। সরকার নির্ধারিত ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকার বেশি টাকা নেওয়া হলে তা জানাতে পারবেন কর্মী। ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতিতে করণীয় ঠিক করতে সুপারিশ করবে তদন্ত কমিটি।
সংবাদ সম্মেলনে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. রুহুল আমিন বলেন, মালয়েশিয়া যেসব কোম্পানিকে কালোতালিকাভুক্ত করেছে, তাদের নামে কর্মী পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হয়নি। ছাড়পত্র পেয়েও যাঁরা যেতে পারেননি, তাঁদের টাকা রিক্রুটিং এজেন্সি ফেরত দেবে। বায়রা এটার দায়িত্ব নিয়েছে। আর যদি কর্মীদের টাকা ফেরত দেওয়া না হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মালয়েশিয়ায় গিয়ে কাজ না পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সচিব বলেন, কর্মীদের নিতে দেশটির বিমানবন্দরে আসেন নিয়োগকর্তা। গত কয়েক মাসে কোনো কর্মীকে না নিতে আসার ঘটনা ঘটেনি। আগে যে পাঁচ হাজার কর্মী কাজ পাননি, তাঁদের কাজের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশ থেকে কর্মী নেয় মালয়েশিয়া। অন্য সব দেশের সব এজেন্সি কর্মী পাঠানোর সুযোগ পায়। শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট এজেন্সিকে অনুমোদন দেয় মালয়েশিয়া। আর এ এজেন্সি চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড নেই দেশটির।
টানা চার বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালে চালু হয় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এরপর ১০০ এজেন্সি নিয়ে একটি চক্র গঠন করে একটি গোষ্ঠী। কর্মীপ্রতি ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকার সর্বোচ্চ খরচ নির্ধারণ করে দিলেও গড়ে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দিতে হয়েছে কর্মীকে। অনেক কর্মী দেশটিতে গিয়ে কাজ পাননি। এ নিয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে চাপ আসে মালয়েশিয়ার ওপর। তারা বিদেশি কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া নতুন করে ঠিক করার কথা বলে বন্ধ করে দেয় শ্রমবাজার। তবে আবারও চক্র গঠনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশ থেকে কর্মী নেয় মালয়েশিয়া। অন্য সব দেশের সব এজেন্সি কর্মী পাঠানোর সুযোগ পায়। শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট এজেন্সিকে অনুমোদন দেয় মালয়েশিয়া। আর এ এজেন্সি চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড নেই দেশটির। সুযোগটি নিয়েছে মালয়েশিয়ার কর্মী নিয়োগের ফরেন ওয়ার্কার্স সেন্ট্রাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (এফডব্লিউসিএমএস) সফটওয়্যার মাইগ্রামের মালিক প্রতিষ্ঠান বেস্টিনেট। এটির মালিকানায় রয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমিনুল ইসলাম বিন আবদুল নূর। তিনি মালয়েশিয়ার নাগরিক, আমিন নূর নামে পরিচিত। মালয়েশিয়া থেকে আমিন নূর কর্মী পাঠানোর পুরো বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বেস্টিনেটের সঙ্গে মালয়েশিয়ার সরকারের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে ৩১ মে। এই বিতর্কিত কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি নবায়ন না করতেই কর্মী নেওয়া বন্ধ করেছে দেশটি। তবে এখন আবার বেস্টিনেটের সঙ্গেই চুক্তির মেয়াদ তিন বছর বাড়তে পারে। এটি হলে আবারও শ্রমবাজার চালুর পর নতুন করে চক্র তৈরি হতে পারে।
সবার জন্য সুযোগ উন্মুক্ত না রেখে মালয়েশিয়াকে এজেন্সি বাছাইয়ের সুযোগ দিলে আবারও চক্র হবে, এবারও তা–ই করা হবে কি না—প্রথম আলোর এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী গতকাল সংবাদ সম্মেলনে নির্দিষ্ট করে কোনো উত্তর দেননি।