বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) আইন অনুসারে গণশুনানির মাধ্যমে দেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হয়। এটি সংশোধন করে দাম নির্ধারণ নিজেদের হাতে নিতে চায় সরকার। ইতিমধ্যে সংশোধনী অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। এখন রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির অপেক্ষা। এ নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম. তামিম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মহিউদ্দিন।
প্রথম আলো: গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এখন সরাসরি নির্বাহী আদেশে দাম বাড়াতে বিইআরসি আইন সংশোধন করা হচ্ছে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
ম. তামিম: সব দেশের সব সরকারেরই নিজের আইন ভঙ্গ করার একটা প্রবণতা থাকে। ১৯৯৬ সালে বিশ্বব্যাপী বিদ্যুৎ খাতে সংস্কার শুরু হয়। এ সংস্কারের মধ্যেই ছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা তৈরি করা। সরকারের কাজে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করাই নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কাজ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রচণ্ড চাপেই ২০০৩ সালে বিইআরসি আইন করা হয়। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে এটি কার্যকর হতে শুরু করে। এখন যা করা হচ্ছে, এটা পরিষ্কারভাবে পেছনের দিকে যাওয়া। এতে অদক্ষতা বাড়বে এবং জবাবদিহি কমে যাবে।
প্রথম আলো: বিইআরসি গঠনের ক্ষেত্রে আইএমএফের চাপ ছিল। এখন ভর্তুকি কমানো নিয়ে আইএমএফের শর্তের বিষয়টি আলোচনা হচ্ছে। এর সঙ্গে কি আইন সংশোধনের সম্পর্ক আছে?
ম. তামিম: দাম নির্ধারণের ক্ষমতা সরকারের হাতে নিয়ে নেওয়া আইএমএফের শর্তে নয়, এটা শতভাগ নিশ্চিত করেই বলা যায়। আইএমএফ কিন্তু ভর্তুকি তুলে দেওয়ার কথাও বলেনি। ওরা জানে, উচ্চমূল্যের কারণে সারা বিশ্বেই বর্তমানে জ্বালানিতে ভর্তুকি বাড়ছে। ওরা ভর্তুকি যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার কথা বলেছে। ভর্তুকি কমানোর সঙ্গে কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করার কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রথম আলো: তাহলে আইন সংশোধনের প্রয়োজন হলো কেন? সর্বশেষ গণশুনানির সময় বিদ্যুৎ খাতের অনিয়ম ও অদক্ষতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছিল, শুনানি ছাড়া দাম বাড়লে তো এসব সামনে আসবে না।
ম. তামিম: জ্বালানি খাতে বিপিসি সবচেয়ে অস্বচ্ছ প্রতিষ্ঠান, কোনো তথ্য পরিষ্কার করে না তারা। বিপিসির অস্বচ্ছতা আন্তর্জাতিক সংস্থাও জানে। এর আগে আন্তর্জাতিক সংস্থা দিয়ে বিপিসির হিসাব নিরীক্ষা করার কথা বলেছিল আইএমএফ। এতে সরকার ও বিপিসি রাজি হয়নি। বিইআরসি থাকার কারণেই গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিভিন্ন কোম্পানির অনিয়ম, অদক্ষতার বিষয়টি সামনে আসে। অনেক সময় এসব কোম্পানি মিথ্যাচার করে। অস্বচ্ছ তথ্য দিয়ে দাম বাড়াতে চায়। গণশুনানিতে ভোক্তাসহ বিভিন্ন পক্ষ এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ পায়।
প্রথম আলো: দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে কোম্পানি অনেক বেশি প্রস্তাব দিলেও তা যাচাই-বাছাই করে বিইআরসি। এতে কখনোই প্রস্তাব অনুসারে দাম বাড়ে না, সেই সুযোগ তো থাকবে না।
ম. তামিম: প্রস্তাব অনুসারে কখনোই বিইআরসি দাম বাড়ায় না। পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৬৬ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব এলেও বিইআরসি ২০ শতাংশ বাড়িয়েছে। গ্যাসের দাম ১১৭ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব এলেও বিইআরসি বাড়িয়েছে প্রায় ২৩ শতাংশ। এ ছাড়া দাম বাড়ানোর সময় বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দেয় বিইআরসি। সংস্থাগুলোকে সাশ্রয়ী ও দক্ষ হওয়ার পরামর্শ দেয়। কারিগরি ক্ষতি (সিস্টেম লস) কমিয়ে রাজস্ব ঘাটতি পূরণের নির্দেশনা দেয়। এ খাতে বিইআরসির যে নজরদারির ক্ষমতা, আইন সংশোধনের পর তা আর থাকবে না।
প্রথম আলো: সরকার বলছে, দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিইআরসি দীর্ঘ সময় নেয়। বিশেষ পরিস্থিতিতে এটি কমানোর জন্যই আইন সংশোধন করা হচ্ছে। এটা কতটা যৌক্তিক?
ম. তামিম: আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে দাম বাড়াতে ৯০ দিন সময় লেগে যাওয়া ও সরকারের ভর্তুকির বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে। এ দুটো কাজই কিন্তু বিইআরসির মাধ্যমে করা সম্ভব। ৯০ দিনের বিষয়টি আইনে বলা নেই। এটা বিইআরসির প্রবিধানমালায় বলা হয়েছে। চাইলেই এটা সংশোধন করে সময় কমিয়ে আনা যায়। মূল্য সমন্বয়ের ক্ষেত্র বিইআরসির যে প্রক্রিয়া, তা এক মাসের মধ্যেও শেষ করা যায়। এমনকি স্বয়ংক্রিয় মূল্য সমন্বয়ও করা সম্ভব। তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) মূল্য প্রতি মাসে সমন্বয় করছে বিইআরসি।
ভারত বা অন্যান্য দেশে স্বয়ংক্রিয় মূল্য সমন্বয়ের ক্ষেত্রে যে সূত্র আছে, তা বিইআরসি অনুসরণ করতে পারে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম কোথাও হুট করে বাড়ে না, এটি শুনানির মাধ্যমেই হয়। বিইআরসিকে এড়ালে সরকারের দায়দায়িত্ব বেড়ে যাবে। আগে দাম বৃদ্ধি নিয়ে বিইআরসির ওপর দায় চাপাতে পারত সরকার। সরকারি সিদ্ধান্তের বাইরে বিইআরসি যে খুব বেশি কিছু করতে পারে, বিষয়টা তেমন নয়। তবে শুনানির মাধ্যমে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হওয়ায় বিইআরসি একধরনের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছে। ৯০ দিনের যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। আসলে ইচ্ছেমতো দাম বাড়াতেই সরকার ক্ষমতা নিয়ে নিতে চায়।
প্রথম আলো: জ্বালানি তেলের দাম সরকার নিজেই সমন্বয় করে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম তারা সমন্বয় করলে বিইআরসির কাজ কী হবে? আর বিশেষ পরিস্থিতি কীভাবে নির্ধারণ হবে?
ম. তামিম: এটা ঠিক, কমিশনের অন্যান্য অনেক কাজ আছে। জনবলের অভাবে সব কাজ হয়তো করতে পারে না। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাছ থেকে লাইসেন্স নেয়। তবে মূল কাজটা হচ্ছে দাম নির্ধারণ। সরকার বলছে, এটি পুরোপুরি নিয়ে যাচ্ছে না। শুধু বিশেষ সময়ে দাম নির্ধারণ করবে সরকার। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে বিইআরসির ক্ষমতা খর্ব করা হচ্ছে। বিশেষ পরিস্থিতির কোনো ব্যাখ্যা নেই। সরকার যেটাকে বিশেষ পরিস্থিতি বলবে, সেটাই বিশেষ পরিস্থিতি হয়ে যাবে। ওইটা আসলেই বিশেষ পরিস্থিতি কি না, তা যাচাই করার তো সুযোগ নেই। এতে সরকার যখন খুশি তখন দাম বাড়াতে পারবে।
প্রথম আলো: জানুয়ারিতে সংসদ অধিবেশন বসার কথা। সরকার ওই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চায় না। তাই রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে আইন সংশোধন করতে চায়, এত তাড়াহুড়া কেন?
ম. তামিম: আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া আছে। এটা যাচাই-বাছাই করে সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে ধাপে ধাপে করা যেত। এটি না করে সরকার এককভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তাড়াহুড়া করে দ্রুততার সঙ্গে অধ্যাদেশ জারি করার কোনো যৌক্তিকতা দেখছি না।
প্রথম আলো: নির্বাহী আদেশে জ্বালানি তেলের রেকর্ড দাম বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়েছে। এখন একইভাবে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে ভোক্তার জন্য কতটা সহনীয় হবে?
ম. তামিম: ক্যাপটিভ (শিল্পে উৎপাদিত নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র) থাকায় রপ্তানিমুখী শিল্পে (তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাত) হয়তো বড় প্রভাব পড়বে না। সবার অবশ্য ক্যাপটিভ নেই। তবে দেশীয় উৎপাদন শিল্পে খরচ বেড়ে যাবে। তেল, চিনির প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে বিদ্যুতের ব্যবহার বেশি। এর আগে সাবানের দাম একলাফে অনেক বেড়ে গেছে। এ ধরনের সব পণ্যের দাম বাড়তে থাকবে। এতে নিত্যপণ্যের বাজারে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। এটা জ্বালানি তেলের মতো সঙ্গে সঙ্গে হবে না, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রভাব ধীরে ধীরে পড়বে।