দুর্নীতি
দুর্নীতি

ঘুষ চেয়েছিল ১৩ লাখ টাকা, কাজ হলো ১৪ হাজারে

ঘুষ ছাড়া সরকারি দপ্তরে কোনো কাজ হয় না। অথচ নানা সেবা পেতে সরকারি নানা কার্যালয়ে যেতেই হয়। একসময় বলা হতো সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন বাড়ালেই দুর্নীতি কমবে। তারপর বেতন বাড়ানো হলো। এখন বরং বেতন বা পদমর্যাদা অনুযায়ী ঘুষের হারও বেড়েছে। অবশ্য সরকারি কোনো ন্যায্য সেবা পেতে ঘুষ দেওয়াকে একটি নাম দিয়েছিলেন প্রয়াত সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। একে বলেছিলেন ‘স্পিড মানি’। এই স্পিড মানির পরিমাণ যে কত, তার উদাহরণ হচ্ছে সাবেক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা ও এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তার বিপুল সম্পদের বিবরণ।

কাজ পেতে ঘুষ যে কেবল সাধারণ মানুষকে দিতে হয় তা নয়, প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও বাদ যান না। আবার ঠিকঠাক তদবির করতে পারলে বিনা ঘুষেই কাজ সম্পন্ন হয়। অর্থাৎ ঘুষ ছাড়া কাজ করতে চাইলে প্রভাবশালীদের সঙ্গে সখ্য থাকা চাই।

কাজী হাবিবুল আউয়াল

কাজী হাবিবুল আউয়াল এখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। আগে ছিলেন জ্যেষ্ঠ সচিব। দীর্ঘ বছর আইন মন্ত্রণালয়ে ছিলেন। আইনসচিব হয়েছিলেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব পদের মেয়াদ শেষে ২০১৭ সালে অবসর নিয়েছিলেন। তিনি সম্প্রতি ‘বিচার ও প্রশাসন: ভেতর থেকে দেখা’ নামে একটি বই লিখেছেন। সেখানে তিনি নিজে কীভাবে দুর্নীতির মুখোমুখি হয়েছেন, তার বেশ কিছু ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা কেবল একটা কাজের অনুমতি দেওয়ার জন্যই ঘুষ চেয়েছিলেন ১৩ লাখ টাকা। অনুমোদন পাওয়ার পর কাজটি করার সময় কত টাকা ঘুষ দিতে হতো, সে প্রশ্ন তো আছেই। শেষ পর্যন্ত যেভাবে কাজটি হয়েছিল, সেই ঘটনাও চমকপ্রদ।

কাজী হাবিবুল আউয়াল লিখেছেন, ‘১৯৯২ সালে মিরপুরের খানিকটা ডোবা এলাকার জমিতে “বসতি” নামে একটি রিয়েল এস্টেট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান জমির উন্নয়ন করে প্লট করে বিক্রয় করছিল। আমার স্ত্রীর মাতা সেখানে ৪ কাঠার একটি প্লট খরিদ করেন। পরে প্লটটি তিনি আমার স্ত্রীকে হেবাসূত্রে দান করেন। প্রায় ২২/২৪ বছর পর আশপাশে কিছু ঘরবাড়ি উঠলে আমি এবং পার্শ্ববর্তী প্লটের মালিক জনৈক প্রকৌশলী হুমায়ুন সাহেব ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করলাম। ওনার এবং আমাদের প্লটকে একত্র করে ৮ কাঠার প্লট তৈরি করে তার ওপর “হাইপেরিয়ান” নামীয় ভূমি উন্নয়ন কোম্পানিকে দিয়ে ভবন নির্মাণের চুক্তি করা হলো। ২০১১ সালে চুক্তি হলো। ২০১৫ সালে ভবন নির্মিত হয়ে গেল। আমরা দুই ভূমি-মালিক প্রতিজন ৪টি করে এবং ডেভেলপার কোম্পানি ৮টি ফ্ল্যাটের মালিক হলেন। মালিক হওয়ার পর আমরা মালিক সমিতি গঠন করলাম। একজন সমিতির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। তিনি ছিলেন অডিট এবং অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত মহাপরিচালক।’

ঢালাই কাটার জন্য অনুমতি চাওয়া হলো। ১৩ লাখ টাকা দাবি করা হলো। কেবল অনুমতি প্রদানের জন্য। দাবিকৃত টাকার অঙ্কটি অনেক বড়।

এ পর্যন্ত ঘটনা ঠিকঠাকই ছিল। বিপত্তি দেখা দেয় পানির সরবরাহ নিয়ে। কাজী হাবিবুল আউয়াল লিখেছেন, ‘ভবনে পানির সরবরাহ অপর্যাপ্ত ছিল। অতিরিক্ত একটি পানির লাইন ভবনে নেওয়ার জন্য বিধি মোতাবেক উত্তর সিটি করপোরেশনের মিরপুর কার্যালয়ে টাকা-পয়সা জমা দিয়ে ডিমান্ড নোট ইস্যু করা হলো। অর্থাৎ সামনের সড়কের নিকটবর্তী একটি পয়েন্ট থেকে লাইন নিতে হবে।

কিন্তু এর মধ্যে সামনের সড়কটি নতুনভাবে সংস্কার করে ঢালাই করে ফেলা হলো। সিটি করপোরেশনের বিধি অনুযায়ী ঢালাই কেটে লাইন নিতে হলে আবার নতুন করে অনুমতি লাগবে। ঢালাই কাটা, সংযোগ গ্রহণ করা এবং ঢালাই আগের মতো পুনর্নির্মাণ করে দেওয়ার দায়িত্ব সংযোগ গ্রহণকারী প্লট-ওনার গ্রাহকদের করতে হবে। অর্থাৎ এ কাজে সিটি করপোরেশনের কোনো অর্থ ব্যয় হবে না। সকল ব্যয় আমাদেরই বহন করতে হবে।’

এরপরই কাজী হাবিবুল আউয়ালের অভিজ্ঞতা হলো ভিন্ন ঘটনার। তিনি লিখেছেন, ‘ঢালাই কাটার জন্য অনুমতি চাওয়া হলো। ১৩ লাখ টাকা দাবি করা হলো। কেবল অনুমতি প্রদানের জন্য। দাবিকৃত টাকার অঙ্কটি অনেক বড়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে পরিচিত কাউকে পেলাম না। তত দিনে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবের পদ থেকে আমি অবসর গ্রহণ করেছি। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে গিয়ে প্রধান নির্বাহী জনাব মুস্তাফিজুর রহমানকে পেলাম। তিনি সরকারের অতিরিক্ত সচিব।

দেশ এখনো দুর্নীতির গভীর পঙ্কিলে নিমজ্জিত হয়ে আছে। সেখান থেকে উঠে আসার সম্ভাবনা এখনো দূর অন্ত। দুর্নীতিকে দমন করতে হলে কঠোর রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন হবে। আবার প্রশ্ন হচ্ছে, বিদ্যমান ব্যবস্থায় রাজনীতি কি দুর্নীতিকে বাদ দিয়ে বাঁচতে পারবে।’
কাজী হাবিবুল আউয়াল

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে তিনি আমার অধীনে যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। অত্যন্ত সজ্জন একজন ব্যক্তি। ১৩ লাখ টাকার সমস্যাটির কথা ওকে জানিয়ে আমাদের অসহায়ত্বের কথা বললে তিনি তৎক্ষণাৎ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহীর সঙ্গে কথা বললেন। এরপর আমাকে বললেন, কাগজপত্র নিয়ে আমার পক্ষ থেকে কাউকে উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। তাই হলো। আমাদের সমিতির সভাপতি বলা মতে সেখানে গিয়ে সাক্ষাৎ করলেন। কাজ হলো। অনুমতির জন্য কেবল ১৪ হাজার টাকা সরকারি ফি চালান মাধ্যমে দিতে হয়েছিল। ১৩ লাখ টাকা আর দিতে হলো না।’

পুরো ঘটনা জানিয়ে এর উপসংহারও টেনেছেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। সবশেষে তিনি লিখেছেন, ‘একটি বাংলা আধ্যাত্মিক গানের কয়েকটি কলির কথা মনে পড়ল। “আগে চলে অলি আল্লাহ/ পিছে চলে মালগাড়ি/ বাবা ভান্ডারি/ লাইন ছাড়া চলে না রেলগাড়ি।” আরেকটি প্রবচন মনে পড়ল “ঠেলার নাম বাবাজি”। এগুলো কেবল আমার দুর্গতির গল্প বা কাহিনি নয়। শত শত নয়, হাজার হাজার নয়, দেশে লাখ লাখ মানুষ সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বৈধ সুযোগ-সুবিধা নিতে গিয়ে এ ধরনের উটকো ঝামেলা ও ভোগান্তির মুখোমুখি হচ্ছেন। এগুলোকে কেউ বলেন অফিস খরচ, কেউ বলেন স্পিড মানি, আবার কেউ কেউ বলেন চা-পানির খরচ। আবার আইনের ভাষায় বলা হয় উৎকোচ গ্রহণ ও প্রদান অর্থাৎ দুর্নীতি।

দেশ এখনো দুর্নীতির গভীর পঙ্কিলে নিমজ্জিত হয়ে আছে। সেখান থেকে উঠে আসার সম্ভাবনা এখনো দূর অন্ত। দুর্নীতিকে দমন করতে হলে কঠোর রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন হবে। আবার প্রশ্ন হচ্ছে, বিদ্যমান ব্যবস্থায় রাজনীতি কি দুর্নীতিকে বাদ দিয়ে বাঁচতে পারবে।’