অনুসন্ধানের শুরু বেশ কয়েক বছর আগে, ২০১৪ সালে শ্রীনাথ রাঘবনের ১৯৭১: আ গ্লোবাল হিস্টরি অব দ্য ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ বইটা পড়ার পর। সেই থেকে নির্ভরযোগ্য গবেষণাভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস খুঁজতে শুরু করি। রাঘবনের লেখার সূত্র ধরে ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত রিচার্ড সিসন ও লিও রোজের ওয়ার অ্যান্ড সিসেশন: পাকিস্তান, ইন্ডিয়া, অ্যান্ড দ্য ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ সংগ্রহ করি। হাতে পাই ২০১৩ সালে প্রকাশিত গ্যারি জে বাসের দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম। তারপর বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ এশিয়ার বাইরের লেখকদের লেখা বই সংগ্রহের চেষ্টা করি। তখনই প্রথম প্রকাশিত বইটির নাম জানার ও সংগ্রহের আকাঙ্ক্ষা জাগে।
‘ইতিহাস লেখে বিজয়ী,’ উইনস্টন চার্চিলের বিখ্যাত উক্তি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে তা ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। সেই ইতিহাস লিখছে তিন পক্ষ। বিজয়ী, বিজিত এবং তৃতীয় পক্ষ—শেষ পক্ষটিতে আবার দুই ভাগ। বিজয়ীদের পক্ষে কোনো গবেষক ব্যাপক অনুসন্ধানের মাধ্যমে সেই ইতিহাস রচনা করেননি। প্রত্যেকেই নিজেকে নিজের বিস্তীর্ণ বা সংকীর্ণ পরিধির মধ্যে আবদ্ধ রেখেছেন। নিজেদের অভিজ্ঞতা ও কৃতিত্বকে বড় করে, অন্যদের ভূমিকাকে ছোট করে দেখেছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস–সম্পর্কিত প্রথম বিদ্যায়তনিক বই সম্ভবত বাংলা দেশ: আ স্ট্রাগল অব নেশনহুড (তখন বাংলাদেশ দুই শব্দে লেখা হতো।) দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়জন অধ্যাপকের লেখা ছয়টি প্রবন্ধ রয়েছে বইটিতে। লেখকেরা হলেন পাকিস্তান স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আইয়ুব, কমনওয়েলথ স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক অনিরুধ গুপ্ত, আন্তর্জাতিক আইনের সহযোগী অধ্যাপক রহমতউল্লাহ খান, চায়নিজ স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক জি পি দেশপান্ডে, আমেরিকান স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক আর নারায়ণন এবং ডিপ্লোম্যাসির অধ্যাপক শিশির গুপ্ত। বইটির প্রকাশক বিকাশ পাবলিকেশনস এবং মুদ্রিত হয়েছিল দিল্লিতে। প্রকাশকাল ১৯৭১। কোন মাসে বইটি প্রকাশিত হয়েছিল, তা বইয়ে উল্লেখ করা হয়নি।
মুখবন্ধ থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে বইটির পরিকল্পনা করা হয়। তাতে বলা হয়েছে, ‘১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে পরিকল্পনা করে প্রকাশনার সময়সূচি ঠিক রাখার জন্য প্রবন্ধগুলো দ্রুততম সময়ে লিখে ফেলতে হয়।’ এই নিবন্ধের লেখক সম্প্রতি বিকাশের দিল্লি কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারাও জানাতে পারেনি, কোন মাসে বইটি প্রকাশিত হয়েছিল।
প্রকাশের মাস জানা না গেলেও প্রবন্ধগুলোর তথ্যসূত্র থেকে তা বের করা যায়। বিশেষ করে বইটি দ্রুত প্রকাশ করার তাগিদ ছিল জেনে। দেখা যায়, লেখকেরা গণমাধ্যমে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রকাশিত তথ্যও ব্যবহার করেছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য তাঁরা ব্যবহার করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। বইটিতে আমেরিকা, রাশিয়া ও চীনের ভূমিকা বিষয়ে দুটো প্রবন্ধের কোনোটিতে ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের ৯ থেকে ১১ তারিখে কিসিঞ্জারের গোপনে চীন সফরের কোনো উল্লেখ নেই। তার মানে বইটি ওই তারিখের আগেই প্রকাশিত হয়েছিল।
‘সোভিয়েত ও চীনা ঝুঁকি’ নামের প্রবন্ধটি লিখেছেন অধ্যাপক দেশপান্ডে। তিনি সংবাদপত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। তার শেষেরটি তিনি নিয়েছেন ৩০ এপ্রিল ১৯৭১-এর টাইমস অব ইন্ডিয়া থেকে। তাতে সোভিয়েত দৈনিক পত্রিকা ইজভেস্তিয়ার উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছিল। এ থেকে অনুমান করা যায়, অধ্যাপক দেশপান্ডে সম্ভবত মে মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই ১৪ পৃষ্ঠার প্রবন্ধটি লিখে ফেলেছিলেন।
অধ্যাপক আর নারায়ণন ‘মার্কিন প্রতিক্রিয়া’ নামের প্রবন্ধটিতে অনেক সংবাদপত্রের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। শেষ উদ্ধৃতি দিয়েছেন টাইমস অব ইন্ডিয়ার ২ মের সংখ্যা থেকে। এ ক্ষেত্রেও অনুমান করা যায় যে তিনি প্রবন্ধটি মে মাসের প্রথম দিকেই লিখে ফেলেছিলেন। তাই ধরে নেওয়া যায়, প্রবন্ধগুলো লেখার কাজও সেই সময় শেষ হয়েছিল। ছাপা ও বাঁধাইয়ের কাজ শেষ করতে হয়তো এক মাস লেগেছিল। ঢাকার একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পাণ্ডুলিপি পাওয়ার ১০ দিনের মধ্যে অক্ষরবিন্যাস, সম্পাদনা ও চূড়ান্ত শুদ্ধকরণের পর বই বাজারে দিতে পারে। সেই তুলনায় বইটি হয়তো জুন মাসের মাঝামাঝি প্রকাশিত হয়েছিল। কাছাকাছি সময়ে আরও দুটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বাংলাদেশে প্রকাশিত একটি অনুবাদের কথা উল্লেখ করতে হয়।
বার্থ অব আ নেশন: দ্য স্টোরি অব হাউ ই. পাকিস্তান টার্নড ইনটু বাংলাদেশ নামের বইটি বাংলাদেশে অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে একটি জাতির জন্ম: পূর্ব পাকিস্তান যেভাবে বাংলাদেশ হলো নামে। অনুবাদক আবদুল্লাহ জাহিদ। অনলাইন বই বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান রকমারি ডটকমে বইটি একটু পড়ে দেখার জন্য খুললে প্রথমেই দেখা যায় যে বইটিকে ‘নিঃসন্দেহে’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ বলে দাবি করা হয়েছে। (এই নিবন্ধ লেখকের সংগ্রহে বইটি নেই।) বইটির পরিচিতি পৃষ্ঠায়ও লেখা হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রথম গ্রন্থ’।
বইটি প্রসঙ্গে অনুবাদক লিখেছেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কোনো বই প্রকাশিত হয়েছিল কি না, তার খোঁজে ওয়ার্ল্ডক্যাট (বিশ্বের তাবৎ বইয়ের নাম ও তা কোথায় আছে তার তালিকা) ঘেঁটে বইটির সন্ধান পান। তারপর তিনি প্রথম আলোর উত্তর আমেরিকার সাংবাদিক ও পুস্তক সমালোচক আহমাদ মাযহারের সঙ্গে আলাপ করেন। তিনি বইটি সম্পর্কে লিখতে অনুরোধ করেন। সমগ্র প্রকাশনের জনাব শওকত আলী বইটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য প্রকাশ করতে চান। মূল বইটির প্রকাশক মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতি, কলকাতার পক্ষে ইন্দু গঙ্গোপাধ্যায় ও রণজিৎ দাশ গুপ্ত।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের প্রথম বই হিসেবে আবদুল্লাহ জাহিদের দাবি টেকে না। কারণ, ভাষাসৈনিক গাজীউল হকের একটি বইও ১৯৭১ সালের আগস্ট/সেপ্টেম্বর (ভাদ্র ১৩৭৮) প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর বইটির নাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। প্রকাশক কলকাতার ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশিং কো. প্রাইভেট লিমিটেড। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ঘটনা যোগ করে বইটির পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৩৭৯ সনের বৈশাখ মাসে। পরিবর্ধিত বইটির বাংলাদেশি সংস্করণের ‘প্রাসঙ্গিক’ নামে মুখবন্ধে হক লিখেছেন, মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী একই নামে আরেকটি বই লেখেন। তার প্রকাশনা উৎসবে গাজীউল হক বক্তৃতায় দাবি করেন, তাঁর নিজের লিখিত বইটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে প্রকাশিত প্রথম বই। জনাব হক ওই দাবি করার কারণ সম্ভবত দিল্লি থেকে বাংলা দেশ: আ স্ট্রাগল ফর নেশনহুড প্রকাশিত হওয়ার খবর তিনি জানতেন না।
জনাব হকের বইটির একটি ইংরেজি সংস্করণ একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে। বইটির শেষে সংযুক্তি অংশে দেওয়া প্রধান প্রধান ঘটনার কালপঞ্জিতে শেষ তারিখটি ৬ ডিসেম্বর, ঘটনা ‘ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে’। তার আগের ভুক্তি ১৭ এপ্রিলের। ইংরেজি বইটির পরিচিতি লিখেছিলেন জিল্লুর রহমান এমএনএ, যিনি পরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। যা হোক, গাজীউল হক ও আবদুল্লাহ জাহিদ কারও দাবিই টেকে না।
কয়েক অনুচ্ছেদ আগে আরও দুটি বই সম্বন্ধে লিখব বলেছি। তার প্রথমটি জামনাদাস আখতার লিখিত দ্য সাগা অব বাংলা দেশ। দিল্লির ওরিয়েন্টাল পাবলিশার্স বইটি প্রকাশ করে। লেখক সম্ভবত টাইমস অব ইন্ডিয়ার সাংবাদিক ছিলেন। তিনি বইটির মুখবন্ধ লিখেছিলেন ১৫ জুন ১৯৭১ তারিখে। শেষ ১৩ জুনের হিন্দুস্তান টাইমস থেকে তথ্য ব্যবহার করেছেন। সেই হিসেবে দ্রুততম সময়ে প্রকাশ করা হলে বইটি জুনের শেষ সপ্তাহ বা জুলাই মাসের প্রথম দিকে প্রকাশিত হয়েছিল।
বাংলা দেশ: আ স্ট্রাগল ফর নেশনহুড ও দ্য সাগা অব বাংলা দেশ বই দুটো সিসন ও রোজের ওয়ার অ্যান্ড সিসেশন বইয়ের গ্রন্থপঞ্জিতে অন্তর্ভুক্ত। প্রথমটিতে বিষয়বস্তু পরিবেশনের কাঠামো পরে মুক্তিযুদ্ধের গবেষণানির্ভর ভালো বইগুলোর লেখকেরাও অনুসরণ করেছেন বলা যায়। সিসন ও রোজও ওই কাঠামো অনুসরণ করেছেন।
প্রায় একই সময়ে দ্য ইনস্টিটিউট অব কনস্টিটিউশনাল অ্যান্ড পার্লামেন্টারি স্টাডিজের তরফে দিল্লির ন্যাশনাল পাবলিশিং হাউস বাংলা দেশ: ব্যাকগ্রাউন্ড অ্যান্ড পার্সপেকটিভ নামে একটি বই প্রকাশ করে। এটি ইনস্টিটিউট আয়োজিত রিকগনিশন অব বাংলা দেশ—লিগ্যাল, পলিটিক্যাল অ্যান্ড মরাল ইস্যুজ (বাংলা দেশের স্বীকৃতি—আইনি, রাজনৈতিক ও নৈতিক বিষয়) শীর্ষক সিম্পোজিয়ামে বিভিন্নজনের বক্তৃতা ও পরিবেশিত প্রবন্ধের সংকলন। ওয়ার্ল্ডক্যাট থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালেই বইটির চারটি সংস্করণ বের হয়েছিল। প্রকাশনার সঠিক মাস এখনো জানতে না পারলেও অনুমান করা যায়। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সিম্পোজিয়ামে পড়া ১২টি নিবন্ধ বইটিতে সংকলিত হয়েছে। মুখবন্ধে বলা হয়েছে, সেটাকে বইয়ের রূপ দেওয়ার জন্য ড. সুভাষ সি কাশ্যপের লেখা ‘বাংলা দেশ—ভূমিকা ও প্রেক্ষাপট’ নামে ৭০ পৃষ্ঠার একটি প্রবন্ধ জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
বইটির দুটো প্রবন্ধের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। একটি লিখেছেন ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদালি করিম (এম সি) চাগলা এবং অন্যটি সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভেঙ্গালিল কৃষ্ণন (ভি কে) কৃষ্ণ মেনন। মি চাগলা লিখেছেন বাংলাদেশ ও বিশ্ববিবেক প্রসঙ্গে। আর মি কৃষ্ণমেনন লিখেছেন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে।
ভারত সরকার বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে ‘ধীরে চলো’ নীতি মেনে চলছিল। তার মূল কারণ, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মুখ্য সচিব পি এন হাকসার মনে করতেন, স্বীকৃতি দেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় ভূখণ্ড প্রবাসী সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। কিন্তু সরকারের বাইরে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রচণ্ড চাপ ছিল। গান্ধীবাদী নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ (জে পি) তা আরও বাড়িয়ে দেন এম সি চাগলার আইনি বিশ্লেষণ পেয়ে। মি. চাগলা জানিয়েছিলেন, স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আইনে কোনো বাধা ছিল না। কৃষ্ণমেননও স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আইনকে কোনো বাধা মনে করেননি। এরপর জে পিকে বিশ্বজনমত গঠনের জন্য বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
যা হোক, মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ড. কাশ্যপ তাঁর প্রবন্ধে ১৫ মে ১৯৭১ তারিখে মিসেস গান্ধীর দেওয়া ভাষণের উল্লেখ করেছেন। আর ইনস্টিটিউটের নির্বাহী সভাপতি এল এম সিংভি মুখবন্ধ লিখেছেন মে মাসে। তা থেকে অনুমান করা যায়, বইয়ের সব লেখা গুছিয়ে প্রেসে পাঠানো ও ছেপে বের করতে অন্তত জুলাই মাস পর্যন্ত লেগে গিয়েছিল। সে হিসেবে এই বই ওই বিষয়ে তৃতীয় প্রকাশনা বলে ধরে নেওয়া যায়।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিষয়ে প্রকাশনার সুলুক সন্ধান জানেন বর্তমানে নিউইয়র্কে অধ্যয়নরত গবেষক মোহাম্মদ সাজ্জাদুর রহমান। তাঁর সঙ্গে আলাপে আরও কয়েকটি বই সম্বন্ধে জানা গেল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হচ্ছে প্রাণ
চোপরা সম্পাদিত দ্য চ্যালেঞ্জ অব বাংলা দেশ আ স্পেশাল ডিবেট। মুম্বাইয়ের পপুলার প্রকাশন বইটি ১৯৭১ সালে প্রকাশ করে। বইটিতে ১৯৭১ সালের ৪ জুন সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি
নিবন্ধের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা হয়েছে। অনুমান করা যায়, বইটি জুলাই বা আগস্ট মাসে প্রকাশিত হয়েছিল।
সম্পাদক প্রাণ চোপরা কলকাতা ও নয়াদিল্লি থেকে প্রকাশিত দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার সাবেক সম্পাদক। বইটির নিবন্ধগুলোর লেখক শিশির গুপ্ত, মোহাম্মদ আইয়ুব, কর্নেল (অব.) আর রামা রাও ও ব্রিগেডিয়ার (অব.) রথি সোয়াহনি, দিল্লি স্কুল অব ইকোনমিকসের রিডার ড. অর্জুন সেনগুপ্ত, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি ও চায়নিজ স্টাডিজের অধ্যাপক ড. ভি পি দত্ত, পশ্চিম পাকিস্তান বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক দেওয়ান বরেন্দ্রনাথ। বইটির পরিশিষ্টে তিনজন মার্কিন অর্থনীতিবিদের বিবৃতি যুক্ত হয়েছিল।
সাজ্জাদুর রহমান আরেকটি বইয়ের খবর দিয়েছেন। সেটার প্রকাশনার তারিখ ১২ জুলাই ১৯৭১। দ্য ব্ল্যাক বুক অব জেনোসাইড ইন বাংলা দেশ নামের বইটি ঠিক ইতিহাস নয়। প্রামাণ্য বইটির বিষয়বস্তু সংগ্রহ ও সম্পাদনা করেছেন জগ মোহন। প্রকাশক নয়াদিল্লির গীতা বুক সেন্টার। বইটি পাকিস্তানি যুদ্ধবাজদের অভিযুক্ত করে একটি আদালতে বিচারের কাঠামোতে লেখা হয়েছে। অনেকটা সত্য ঘটনা অবলম্বনে ১৯৬৯ সালের রাজনৈতিক ঘটনার বিচার ট্রায়াল অব দ্য শিকাগো সেভেন চলচ্চিত্রের মতো।
তাই ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশিত একটি জাতির জন্ম বইটিকে ‘নিঃসন্দেহে’ প্রথম বই বলা যায় না। তার আরও একটি কারণ, মুক্তধারা থেকে প্রকাশিত বই রক্তাক্ত বাংলা। গুডরিডস তালিকায় মুক্তধারার বই রক্তাক্ত বাংলা প্রকাশের তারিখ দেওয়া হয়েছে ১ আগস্ট ১৯৭১। ওই মাসেই বার্থ অব আ নেশন বইটি প্রকাশের সুনির্দিষ্ট তারিখ এই নিবন্ধলেখক জানতে পারেননি। কাকতালীয়ভাবে তা ১ আগস্টেই প্রকাশিত হয়ে না থাকলে, বইটি তৃতীয় প্রকাশনা হিসেবেও গণ্য হতে পারে না।
দ্য ডেইলি স্টার–এর ৬ মে ২০২১ তারিখের অনলাইন সংস্করণে ‘দ্য বুকস দ্যাট ওয়েন্ট টু ওয়ার’ শিরোনামের নিবন্ধে শামসুদ্দোজা সাজেন লিখেছেন, বিভিন্ন লেখকের লেখার সংকলন রক্তাক্ত বাংলা সম্পাদনা করেছিলেন আনিসুজ্জামান (পরে জাতীয় অধ্যাপক)। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আজিজুর রহমান মল্লিক বইটির মুখবন্ধ লিখেছিলেন।
মোহাম্মদ আইয়ুব ও অন্যান্যের লেখা বাংলা দেশ: আ স্ট্রাগল ফর নেশনহুড এবং আরও দুটি বই সম্বন্ধে চ্যাথাম হাউস প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স সাময়িকীতে পিটার লিওন একটি নিবন্ধ লেখেন। ১০০ বছর ধরে গবেষণাভিত্তিক নিবন্ধ প্রকাশ করার জন্য সাময়িকীটি বিখ্যাত। ১ জুলাই ১৯৭২ প্রকাশিত সংখ্যায় ওই নিবন্ধে লিওন তিনটি বইয়ের তুলনায় বাংলা দেশ: আ স্ট্রাগল ফর নেশনহুড বইটিকে সেরা ও অন্য দুটির চেয়ে অনেক বেশি ভালো (... বাই ফার দ্য বেস্ট) বলে উল্লেখ করেছেন।
ওপরের আলোচনা থেকে যুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিষয়ে প্রকাশিত কয়েকটি বইয়ের কালক্রমিক তালিকা নিচে দেওয়া হলো:
বাংলা দেশ: এ স্ট্রাগল ফর নেশনহুড, জুন ১৯৭১
বাংলা দেশ: আ স্ট্রাগল ফর নেশনহুড, জুন ১৯৭১
দ্য সাগা অব বাংলা দেশ, জুন/জুলাই ১৯৭১
বাংলা দেশ: ব্যাকগ্রাউন্ড অ্যান্ড পার্সপেকটিভ, জুলাই ১৯৭১
দ্য চ্যালেঞ্জ অব বাংলা দেশ: আ স্পেশাল ডিবেট, জুলাই/আগস্ট ১৯৭১
দ্য ব্ল্যাক বুক অব জেনোসাইড ইন বাংলা দেশ, জুলাই/আগস্ট ১৯৭১
রক্তাক্ত বাংলা, আগস্ট ১৯৭১
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, আগস্ট ১৯৭১
বার্থ অব আ নেশন: দ্য স্টোরি অব হাউ ইস্ট পাকিস্তান টার্নড ইনটু বাংলাদেশ, আগস্ট ১৯৭১
এই তালিকা নিয়ে কারও কাছে কোনো নতুন প্রশ্ন কিংবা তথ্য বা প্রমাণ থাকলে, তা আমাদের জানালে অত্যন্ত বাধিত হব।
কাজী জাওয়াদ: সাংবাদিক।