বিদ্যুৎ ও গ্যাসে বছরে মাথাপিছু ভর্তুকি তিন হাজার টাকা

বিদ্যুৎ খাতে বছরে ৩২ হাজার কোটি ও গ্যাসে ২০ হাজার কোটি টাকা সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ-গ্যাসে বছরে মাথাপিছু ভর্তুকি দিতে হচ্ছে তিন হাজার টাকা। এ অবস্থার কারণ খুঁজতে হবে। কারা চুক্তি করেছে, কেন করেছে, কেন তাঁরা এটা চাপিয়ে দিয়েছেন—ব্যবসায়ীদেরও অনুশোচনা করা উচিত।

‘অনুমেয় জ্বালানি মূল্য ও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। আজ শনিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) মিলনায়তনে ডিসিসিআই এই সেমিনারের আয়োজন করে।

জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, গ্যাস সরবরাহে ১০০ কোটি ঘনফুটের বেশি ঘাটতি আছে। ভোলায় ছয় থেকে সাত কোটি ঘনফুট গ্যাস উদ্বৃত্ত আছে। আগে একটি কোম্পানিকে এই গ্যাস সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এখন উন্মুক্ত হচ্ছে, যে কেউ চাইলে গ্যাস কিনতে পারবে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, আগের সরকার দরজা-জানালা বন্ধ করে রেখেছিল। একটা দম বন্ধের পরিস্থিতি ছিল। এখন সব দরজা জানালা খুলে দেওয়া হয়েছে।

প্রতিযোগিতার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এখন যে কেউ ব্যবসা করতে পারবেন। নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ধাপে ধাপে দরপত্র আহ্বান করা হচ্ছে।

বেসরকারি খাতে দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎকেন্দ্র আইপিপি থেকে সরকার সরে আসছে উল্লেখ করে ফাওজুল কবির খান বলেন, মার্চেন্ট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করে ব্যবসায়ীরা নিজেদের নির্ধারিত দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করবে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) দামটা জানিয়ে দেবে তারা। এসব কেন্দ্র থেকে ১০-২০ শতাংশ সরকার কিনে নিতে পারে।

ভূতত্ত্ববিদ বদরুল ইমাম বলেন, দেশে গ্যাসের অভাব নেই; বরং সম্ভাবনা অনেক। তাই জ্বালানির জন্য হাহাকারের কোনো অর্থ হয় না। দেশের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে অনুসন্ধান করা হয়নি। আমদানির দিকে ঝোঁক বেশি। এই দেশে গ্যাস না থাকাটাই অস্বাভাবিক। তাই বাংলাদেশে জ্বালানি–সংকট হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমদানি না করে বরং গ্যাস রপ্তানির দিকে যেতে পারে বাংলাদেশ।

সেমিনারে মূল নিবন্ধ উপস্থাপন করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম। তিনি বলেন, জ্বালানি–সংকট উত্তরণের পথ হলো দেশে গ্যাসের অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানো। আমদানি করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন। বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের যে অবস্থা, তাতে আগামী পাঁচ বছর বর্তমান হারে উৎপাদন ধরে রাখা কঠিন।

নিবন্ধে বলা হয়, আসলে জ্বালানির মূল্য আগে থেকে পূর্বাভাস করা সম্ভব নয়। কিছু অনুমান করা যেতে পারে। ৫ বা ১০ বছরের যেসব অনুমান করা হয়, সেটি কখনোই ঠিক হয় না। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ হয়তো ১২ টাকার মধ্যেই থাকবে। জ্বালানি তেলের দাম সামনে আরও কমে যাবে। এতে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম কমবে। কম দামে এলএনজি কিনে মজুত করে রাখতে হবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের পরিকল্পনা পাঁচ বছরের বেশি হওয়া উচিত নয় বলেও মত দেওয়া হয় এতে।

নিবন্ধে বলা হয়, শীতে চাহিদা কমায় চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হয়। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে কেন্দ্রভাড়া দিতে হয়। এসব কেন্দ্র বাতিলের চিন্তা করা যেতে পারে। শীতের সময় তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকে। গরমের সময় এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিবর্তে সৌরবিদ্যুৎ থেকে চাহিদা মেটানো যায়। এ ছাড়া শীত ও গ্রীষ্মে অফিসের আলাদা সূচি করা যেতে পারে। এতে জ্বালানি সাশ্রয় হবে।

নিবন্ধে আদানির সঙ্গে চুক্তি পর্যালোচনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ভারত থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যে বিদ্যুৎ আসছে, তা সাশ্রয়ী; কিন্তু আদানির সঙ্গে চুক্তিটি অস্বাভাবিক। রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়া আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি হওয়ার কথা নয়। এটি পর্যালোচনা করে অন্তত কয়লার দাম কমানো উচিত।

বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের খরচ নির্ভর করে ডলারের ওপর। ডলারের দাম বাড়লে খরচ বাড়বেই। ডলারের দাম কমার তেমন সম্ভাবনা নেই। তাই বাংলাদেশ জ্বালানির উচ্চ দামের মধ্যে বসবাস করবে। আবার গ্যাস সরবরাহের অভাবে উৎপাদন ধরে রাখতে না পারলে শিল্প খাতে ডলার আয় কমে যাবে।
সেমিনারে ব্যবসায়ীরা বলেন, গত সরকারের সময় অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা না করেই বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে পেছনের সময় থেকে কার্যকর করা হয়েছে। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারির শেষে দাম বাড়িয়ে তা ফেব্রুয়ারি থেকেই কার্যকর করা হয়েছে। গ্যাসের দাম বাড়িয়েও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়নি। নতুন সরকারের কাছেও জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত করার দাবি তাদের। একই সঙ্গে দাম বাড়িয়ে আর ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ যেন না হয়; সেটিই তাদের আহ্বান।

সেমিনারে সূচনা বক্তব্য দেন ডিসিসিআই সভাপতি আশরাফ আহমেদ। তাঁর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তৃতা করেন কনফিডেন্স গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ইমরান করিম, বাংলাদেশ সোলার অ্যান্ড রিনিউঅ্যাবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. নূরুল আকতার, বিএসআরএমের হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স সৌমিত্র কুমার মুৎসুদ্দি প্রমুখ।

নিবন্ধে সংকট উত্তরণে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, বাপেক্সের পাশাপাশি অন্য কোম্পানিকে স্থলভাগের গ্যাস অনুসন্ধানে যুক্ত করা যেতে পারে। এ ছাড়া সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য এলএনজি রূপান্তরের নতুন টার্মিনালের ব্যবস্থা করা, গ্যাসের আবাসিক গ্রাহকদের মিটার সরবরাহ, আদানির চুক্তি পর্যালোচনা ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের সুপারিশ করা হয়।