সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রচারে তথ্য ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পর এবার মাঠে নামছে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি অধিদপ্তর। তারা দেশের ৪৯২টি উপজেলায় একটি করে এলইডি ডিসপ্লে বসাতে চায়। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩২ কোটি টাকা।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি অধিদপ্তর তাদের প্রকল্প প্রস্তাবটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) উপস্থাপনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। একই বিষয়বস্তু, একই কৌশলে তিনটি মন্ত্রণালয় আলাদাভাবে প্রচার করলে ব্যয় যেমন বাড়বে, তেমনি কাজেরও সমন্বয় থাকবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
টানা তিন মেয়াদে সরকারের সব অর্জন এলইডি ডিসপ্লের মাধ্যমে জনসাধারণকে জানাতে চায় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি অধিদপ্তর। এ মাসে একনেক সভায় এই প্রকল্প উঠতে পারে।
পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ইতিমধ্যে দেশজুড়ে প্রচার করেছে তথ্য মন্ত্রণালয়। ‘গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে প্রচার কার্যক্রম শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্পের আওতায় মন্ত্রণালয় ২০১৮ সাল থেকে ভ্রাম্যমাণ এলইডির মাধ্যমে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রচার করে। এ প্রকল্প শেষ হয় গত জুনে। এতে ব্যয় হয়েছে ১০৭ কোটি টাকা। তথ্য মন্ত্রণালয় নতুন করে উন্নয়ন প্রচারের জন্য আরেকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নেওয়ার সময় এখন নয়। সরকার এখন অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে সরকারের সাবধান হওয়া উচিত।অধ্যাপক মইনুল ইসলাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক
আলাদাভাবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রদর্শন’ প্রকল্পের আওতায় ২০২০ সাল থেকে এলইডি ডিসপ্লের মাধ্যমে ১৯ জেলায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রচার করছে। আগামী বছরের জুনে এই প্রকল্প শেষ হবে। এতে ব্যয় হচ্ছে ২১ কোটি টাকা।
সব মিলিয়ে তিন মন্ত্রণালয়ের তিন প্রকল্পে সরকারের উন্নয়ন প্রচারে ২৬০ কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে। এর বাইরে বিটিভি, বাংলাদেশ বেতারে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রচার করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নেওয়ার সময় এখন নয়। সরকার এখন অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে সরকারের সাবধান হওয়া উচিত।
অধ্যাপক মইনুল বলেন, সরকার তার রাজনৈতিক প্রচার চালাতে এলইডি ডিসপ্লে বসাচ্ছে। কিন্তু কাজটি করছে কয়েকটি মন্ত্রণালয়। এতে কাজে সমন্বয় থাকবে না। সরকারি অর্থের অপচয়ের সুযোগ থাকছে।
তবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রদর্শন’ প্রকল্পের পরিচালক কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি অধিদপ্তরের সঙ্গে আমাদের প্রকল্পের সমন্বয় রাখতে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। তারা যেখানে এলইডি ডিসপ্লে বসাবে, সেখানে আমরা বসাব না।’
সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রচারের জন্য একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তবে চলমান বৈশ্বিক সংকটের কারণে প্রকল্পটি এখনো অনুমোদন পায়নি।মোস্তফা কামাল, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি অধিদপ্তর বলছে, তারা দেশের প্রতিটি উপজেলায় একটি করে এলইডি ডিসপ্লে বসাবে। এতে সরকারের মেগা প্রকল্পের তথ্য জনসাধারণকে দেখানো হবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন তথ্য প্রদর্শন করা হবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের গত ১৩ বছরের অর্জন, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রধানমন্ত্রীর দশটি উদ্যোগ প্রদর্শন করা হবে। উপজেলা পর্যায়ে উন্মুক্ত মাঠ অথবা জনসমাগম হয়, এমন জায়গায় এলইডি ডিসপ্লে বসানো হবে।
জানতে চাইলে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রচারের জন্য একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তবে চলমান বৈশ্বিক সংকটের কারণে প্রকল্পটি এখনো অনুমোদন পায়নি।
এলইডি ডিসপ্লেতে কী কী দেখানো হবে, সে জন্য কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলাদা কমিটি করা হবে। আইসিটি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কেন্দ্রীয় কমিটি, জেলা প্রশাসক জেলা কমিটির ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উপজেলা কমিটির আহ্বায়ক থাকবেন। এলইডি ডিসপ্লেতে সরকারের উন্নয়ন প্রচারের ফাঁকে ফাঁকে বিজ্ঞাপন প্রচারের ব্যবস্থা থাকবে।
পিকআপ ভ্যানে করে ঘুরে ঘুরে প্রান্তিক মানুষকে সরকারের ১৩ বছরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানানো হয়েছে। এটি প্রচারের কৌশল। এর মাধ্যমে সরকার তাদের জন্য কী করেছে, মানুষ তা জানতে পেরেছে।জাকির হোসেন, প্রকল্প পরিচালক
জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে এখন আগের মতো প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারের উন্নয়ন প্রচারের জন্য এই উদ্যোগ কি না জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, নিশ্চয়ই। সরকারের অনেক অর্জন আছে, যা মানুষকে জানানো দরকার।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রকল্প শেষ হওয়ার পর এলইডি ডিসপ্লেগুলোর কী হবে, প্রকল্পে তার উল্লেখ নেই। ফলে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রদর্শন’ প্রকল্পের আওতায় দেশের ১৯ জেলায় এলইডি ডিসপ্লে বসানোর কথা রয়েছে। এতে খরচ হবে ২১ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের আওতায় ইতিমধ্যে পরিকল্পনা কমিশন চত্বরে দুটি এলইডি ডিসপ্লে বসানো হয়েছে, যাতে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রচার হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিকল্পনা কমিশনের চারপাশে বিলবোর্ডের মাধ্যমে সরকারের উন্নয়নচিত্র তুল ধরা হচ্ছে।
প্রকল্পের আওতায় গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠকে বসার কথা জানিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। ওই বৈঠকে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কীভাবে একটি এলাকার চিত্র বদলে দিয়েছে, তার বিশ্লেষণ থাকবে।
সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রচারে ২০১৮ সালে ১০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে প্রচার কার্যক্রম শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্প হাতে নেয় তথ্য মন্ত্রণালয়। গত জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়।
এ প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে পিকআপ ভ্যানে করে ভ্রাম্যমাণ এলইডি ডিসপ্লে দিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রচার করা হয়েছে।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক জাকির হোসেন প্রথম আলোকে জানান, পিকআপ ভ্যানে করে ঘুরে ঘুরে প্রান্তিক মানুষকে সরকারের ১৩ বছরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানানো হয়েছে। এটি প্রচারের কৌশল। এর মাধ্যমে সরকার তাদের জন্য কী করেছে, মানুষ তা জানতে পেরেছে।