চট্টগ্রাম শহরের প্রায় সাড়ে ১২ একর জমির দখল-মালিকানা নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে সরকারের দুটি প্রতিষ্ঠান। একটি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, অন্যটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন বলছে, এটি সরকারি খাসজমি। সেখানে শিশুপার্ক ও খেলার মাঠ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। কিন্তু রাতের আঁধারে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে তাদের এ জমি দখলের চেষ্টা হয়েছে।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, ১৩৬ বছর ধরে এ জমি তাদের দখলে রয়েছে। উল্টো চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন তাদের জমি দখলের চেষ্টা করছে।
প্রাপ্ত নথি বিশ্লেষণে দেখা যায়, চট্টগ্রাম শহরের ফিরিঙ্গিবাজার এলাকায় কর্ণফুলী নদীর তীরে দুই দাগে প্রায় সাড়ে ১২ একর জমি আছে। এর মধ্যে ফিরিঙ্গিবাজার এলাকায় ছয় একর, বাকি সাড়ে ছয় একর আছে সুজাকাটগড় এলাকায়।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ উভয়ে এ জমি নিজেদের বলে দাবি করছে। এ নিয়ে তারা একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে তারা পরস্পরের বিষোদ্গার করেছে। এক পক্ষ আদালতে যাওয়ার ঘোষণা পর্যন্ত দিয়েছে।
নথি ঘেঁটে দেখা যায়, দুই দাগে ১২ দশমিক ৪৫ একর জায়গা নিজেদের দাবি করে ১২ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে চিঠি দেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান।
চিঠিতে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক বলেন, এ জায়গায় আগে দখলদারেরা অবৈধভাবে বালুর ব্যবসা করত। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন দখলদারদের উচ্ছেদ করে জায়গা নিয়ন্ত্রণে নেয়। উদ্ধার করা জায়গা সরকারের খাসজমি। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন যৌথ উদ্যোগে এ জায়গায় শিশুপার্ক ও খেলার মাঠ তৈরি করে সর্বসাধারণের ব্যবহারের উপযোগী করবে। এ কার্যক্রম চলমান। হঠাৎ ১১ জুলাই রাতের আঁধারে কতিপয় ব্যক্তি অবৈধভাবে এ জমিতে অনুপ্রবেশ করেন। তাঁরা জায়গাটি দখলের চেষ্টা করেন। সেখানে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাইনবোর্ড টাঙানোর চেষ্টা করেন। তবে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন এ জমি দখলের অপচেষ্টা রোধ করেছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে দেওয়া চিঠিতে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আরও লিখেছেন, চট্টগ্রাম মহানগরে খেলার মাঠ ও পার্কের সংকট রয়েছে। এ সংকট কাটিয়ে উঠতে জেলা প্রশাসন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন একসঙ্গে কাজ করছে।
শিশুপার্ক-খেলার মাঠ নির্মাণের কাজে অযাচিত ও অবৈধভাবে কোনো দপ্তর বা সংস্থা যাতে বাধা সৃষ্টি করতে না পারে, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশনা দিতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে অনুরোধ করেছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের চিঠির অনুলিপি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, নৌসচিব প্রমুখকে দেওয়া হয়েছে।
চিঠির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘জমি নিয়ে দুটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, জমিটি তাদের। আমাদের কাছে থাকা নথি বলছে, জমিটি জেলা প্রশাসনের। আমরা দুই পক্ষ বসে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করব।’
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী, জমি দখলের চেষ্টাকারী—চিঠিতে এমন কথা লেখার বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আমরা জানতাম না, রাতের আঁধারে সাইনবোর্ড টাঙানোর কাজটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ করেছে। এ ছাড়া চিঠিতে নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম আমরা উল্লেখ করিনি। তবে আমরা চাই, আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির সুরাহা হোক।’
পাল্টা হিসেবে ১৭ জুলাই নৌসচিবকে একটি চিঠি দেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। চিঠির অনুলিপি মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব প্রমুখকে দেওয়া হয়।
চিঠিতে বলা হয়, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ১২ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন জমিতে প্রবেশ করে সাইনবোর্ড স্থাপন করেন। গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দেন, যা অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ উল্লেখ করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারি দপ্তরে চিঠি দিয়েছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক, যা শিষ্টাচারবহির্ভূত। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি ঐতিহ্যবাহী সরকারি সংস্থা। দেশের প্রায় ৯২ শতাংশ আমদানি-রপ্তানি এ বন্দর দিয়ে হয়। রাষ্ট্রের সিংহভাগ রাজস্ব এ বন্দরের মাধ্যমে অর্জিত হয়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ বলায় সংস্থাটির সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুকের সই করা চিঠিতে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বলা হয়, এ জমির নিরঙ্কুশ মালিক তারা। ১৩৬ বছর ধরে এ জমি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দখলে রয়েছে। কোনো আলাপ-আলোচনা ছাড়াই ১২ জুলাই জেলা প্রশাসন জমির ভেতরে ঢুকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাইনবোর্ড ফেলে দেয়। প্রজাতন্ত্রের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার (ডিসি) কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ প্রত্যাশিত নয়।
চিঠির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৩ সাল থেকে এ জমিতে ঢাকার হাতিরঝিলের আদলে দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা করার কাজে হাত দিয়েছেন তাঁরা। এটি বন্দর কর্তৃপক্ষের জায়গা। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কোনো ধরনের আলোচনা না করেই এ জায়গা নিজেদের দখলে নিতে চাইছে। বিষয়টির সুরাহায় বন্দর কর্তৃপক্ষ আদালতের শরণাপন্ন হবে।