রকি ও রাখি আপন ভাইবোন। তারা ওয়ারিশসূত্রে একই জোতে ২০ শতক সম্পত্তির মালিক। পারিবারিক দ্বন্দ্বে বা মনোমালিন্যে রাখি (বোন) তার অংশ বহিরাগত কারও কাছে বিক্রি করে দিল। রকি (ভাই) সে সম্পত্তি কেনার জন্য যথেষ্ট সামর্থ্যবান এবং সেটা তার প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে রকি কি কোনো আইনি প্রতিকার পেতে পারে?
শিশির ও সুমন যৌথভাবে একটি পুকুরের মালিক। যে পুকুর সুমনের আয়ের অন্যতম উৎস। শিশির তার অংশ অন্য কারও কাছে বিক্রি করে দিলে সুমনের আয়ের ওপর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। সুমন পুকুরে শিশিরের প্রাপ্য অংশটুকু কিনতে ইচ্ছুক এবং সামর্থ্যবান। এমন পরিস্থিতিতে সুমনের আইনি প্রতিকার কী হবে?
এখানে উল্লেখিত সমস্যাগুলো ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্নভাবে আমাদের সামনে উদ্ভব হতে পারে। যদি এমন পরিস্থিতি আমাদের সামনে আসে, তাহলে তার আইনগত সমাধান কী, সে সম্পর্কে বলা হয়েছে দেওয়ানি আইনের ‘অগ্রক্রয়াধিকার’ বা ‘রাইট অব প্রিয়েমশন’ নামক তত্ত্বগত ধারণায়। আইনের চোখে ‘অগ্রক্রয়াধিকার’ একধরনের অধিকার হিসেবে স্বীকৃত, যা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একজন ব্যক্তি স্থাবর সম্পত্তি শুধু কেনাবেচার ক্ষেত্রে পেয়ে থাকেন। সহজভাবে সংজ্ঞায়িত করলে দাঁড়ায়, কোনো স্থাবর সম্পত্তি যদি বিক্রি হয়, তাহলে ওই সম্পত্তি কেনার ক্ষেত্রে কোন কোন ব্যক্তির অধিকার সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে, সেই বিধানই হচ্ছে ‘অগ্রক্রয়াধিকার’। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির ক্রয়–বিক্রয়ে প্রাপ্ত সুবিধা থেকে ক্রয়–বিক্রয়ের ফলে অসুবিধাকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে আইনি বিধান করা হয়েছে।
আমাদের উপমহাদেশে ‘অগ্রক্রয়’ নামক আইনি ধারণার উদ্ভব ঘটে মুসলিম শাসনামলে। পরে ইংরেজ শাসনামলে আইনি কাঠামোর ব্যাপক পরিবর্তন হলেও ‘অগ্রক্রয়’ নামক আইনি ধারণা অপরিবর্তিত থেকে যায়। বর্তমান দেওয়ানি আইনগুলোর মাঝে, কৃষিজমির ক্ষেত্রে ‘রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ এবং প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০’–এর ৯৬ ধারা, অকৃষিজমির ক্ষেত্রে ‘অকৃষি প্রজা স্বত্ব আইন, ১৯৪৯’–এর ২৪ ধারা, মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জন্য ‘মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরিয়ত) প্রয়োগ আইন, ১৯৩৭’ এবং অবিভক্ত বসতবাড়ির ক্ষেত্রে ‘বাঁটোয়ারা আইন, ১৮৯৩’–এর ৪ ধারা স্থাবর সম্পত্তির অগ্রক্রয় সম্পর্কে বর্ণনা করে। নিম্নে ‘অগ্রক্রয়’ মামলার তুলনামূলক আইনি দিক তুলে ধরা হলো।
কোনো জমির ওয়ারিশসূত্রে সহ–অংশীদার, ক্রয়সূত্রে বা ব্যবহারসূত্রে একই সহ–অংশীদার এবং পার্শ্ববর্তী জমির মালিক তার পাশের জমি কেনার জন্য অগ্রক্রয়ের হকদার হন এবং এই সব ব্যক্তিই আদালতে অগ্রক্রয়ের দাবি করে মামলা করতে পারেন। তবে মামলার বহুতা রোধ করার জন্য ২০০৬ সালে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ এবং প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০–এর ৯৬ ধারায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়। যেখানে উক্ত আইনের ৯৬ ধারায় পরিবর্তন করে বলা হয় কৃষিজমির ক্ষেত্রে শুধু উত্তরাধিকারসূত্রে সহ-অংশীদার অগ্রক্রয়ের দাবিতে মামলা করতে পারবেন, অন্য কোনো ব্যক্তি পারবেন না।
আইন অনুসারে অগ্রক্রয়ের অধিকার দাবিতে মামলা করার সময় যিনি সম্পত্তি বিক্রি করলেন এবং যিনি সম্পত্তি কিনলেন, সেই সঙ্গে আরও যাঁরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উক্ত সম্পত্তি কেনার হকদার হন, তাঁদের সবাইকে পক্ষ করতে হয়। উপযুক্ত পক্ষকে মামলায় পক্ষ করা না হলে মামলাটি পক্ষ দোষে দুষ্ট হয়ে যায়।
কোনো স্থাবর সম্পত্তি যখন তৃতীয় কোনো আগন্তুক ব্যক্তির কাছে রেজিস্ট্রার দলিলমূলে বিক্রি করা হয়, ঠিক সেই সময় থেকে অগ্রক্রয়ের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মামলা করা যায়, তার আগে নয়। যখন একটি সম্পত্তির বিক্রির রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়, তখন রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ এবং প্রজাস্বত্ব আইনের ৮৯ ধারা এবং অকৃষি প্রজাস্বত্ব আইনের ২৩ ধারা অনুসারে এলটি বা ল্যান্ড ট্রান্সফার নোটিশ পাঠাতে হয়। উক্ত নোটিশ পাওয়ার পর বা উক্ত সম্পত্তি বিক্রয় সম্পর্কে অবহিত হওয়ার দুই মাসের মাঝে কৃষিজমি এবং চার মাসের মাঝে অকৃষিজমির অগ্রক্রয়ের মামলা দায়ের করতে হয়। যদি কোনোভাবে নোটিশ প্রদান করা না হয় বা বিক্রির বিষয়টি গোপন করা হয়, তাহলে কৃষিজমির রেজিস্ট্রেশনের তারিখ থেকে তিন বছর এবং অকৃষিজমির রেজিস্ট্রেশনের তারিখ থেকে ১২ বছরের মধ্যে অবশ্যই মামলা দায়ের করতে হবে। এই সময়ের পর মামলা দায়ের করা হলে তা তামদি দোষে দুষ্ট হবে অর্থাৎ মামলা খারিজ হবে।
জমির শ্রেণি যা–ই হোক না কেন, যদি মুসলিম আইনে অগ্রক্রয়ের অধিকার দাবিতে প্রতিকার প্রার্থনা করা হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে তামাদি মেয়াদ থাকবে এক বছর। মুসলিম আইনে আদালতে প্রতিকার প্রার্থনা করার আগে; সম্পত্তি বিক্রি হয়েছে এ খবর জানার সঙ্গে সঙ্গে ‘প্রথম দাবি’ বা ‘তলবে মসিবত’ উত্থাপন করতে হয়, অর্থাৎ অগ্রক্রয়ের দাবিদার সম্পত্তিটি কিনতে চান মর্মে ঘোষণা দিতে হবে। এরপর ‘দ্বিতীয় দাবি’ বা ‘তলবে ইশাদ’ প্রকাশ্যে উত্থাপন করতে হয়, অর্থাৎ দুজন সাক্ষীর সামনে প্রকাশ্যে সম্পত্তিটি ক্রয়ের ঘোষণা আবার দেওয়া। তারপর ‘তৃতীয় দাবি’ ‘তলবে তমলিক’ হিসেবে সরাসরি আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে।
অগ্রক্রয়ের অধিকার দাবিতে মামলা দায়ের করতে হয় এখতিয়ারসম্পন্ন দেওয়ানি আদালতে। এবং কোন আদালতে উক্ত মামলা দায়ের হবে, তা দেওয়ানি আদালত আইন, ১৮৮৭ এবং দেওয়ানি কার্যবিধি, ১৯০৮ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
সম্পত্তিতে কী ধরনের উন্নয়ন সাধিত হলো, সে বিষয়ে প্রশ্ন থাকলে কোনো পক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সঠিক মান নির্ণয়ের জন্য আদালত নিজে এ বিষয়ে অনুসন্ধান করতে পারেন। কৃষি বা অকৃষিজমির ক্ষেত্রে অবশ্যই উপযুক্ত অর্থ আদালতে জমা দিয়েই মামলা দায়ের করতে হবে। অন্যথায় আদালত উক্ত মামলা বিচারের জন্য গ্রহণ করবেন না। এর বাইরে মুসলিম আইনে আরজি দাখিলের মাধ্যমে অগ্রক্রয়ের অধিকার আদায়ে মামলা দায়ের করা যায়। যেখানে কোর্ট ফি ছাড়া অন্য কোনো প্রকার অর্থ জমা দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। যেখানে আদালতের সিদ্ধান্ত আসার পর সব ধরনের দেনা–পাওনা পরিশোধ করতে হয়। তবে এ ক্ষেত্রে যিনি সম্পত্তি বিক্রয় করেছিলেন এবং যিনি অগ্রক্রয়ের মামলা আদালতে দায়ের করছেন, তাঁদের সবাইকে মুসলিম ধর্মের হতে হবে।
অগ্রক্রয়ের মামলা দায়ের যথেষ্ট খরচসাপেক্ষ বিষয়। অগ্রক্রয়ের মামলা দায়েরের সময় যে বিক্রির বিপক্ষে মামলা দায়ের হচ্ছে, সেই বিক্রির রেজিস্টার্ড দলিলে যে পরিমাণ বিক্রয়মূল্য থাকবে, তা আদালতে জমা দিতে হবে। মামলাটি কৃষিজমির ক্ষেত্রে হলে বিক্রয়মূল্যের সঙ্গে উক্ত মূল্যমানের ওপর ২৫ শতাংশ হারে ক্ষতিপূরণ এবং বিক্রয় দলিল রেজিস্ট্রেশনের তারিখ থেকে মামলা দায়েরের তারিখ পর্যন্ত বিক্রয়মূল্যের ওপর আরও ৮% হারে সরল সুদ আলাদতে প্রদান করতে হবে। সম্পত্তির প্রকৃতি যদি অকৃষিজমি হয়, তাহলে রেজিস্টার্ড দলিলে যে মূল্য, তার সঙ্গে অতিরিক্ত হিসেবে দলিল মূল্যের ৫ শতাংশ ক্ষতিপূরণ আদালতে জমা দিতে হবে। সেই সঙ্গে দলিল রেজিস্ট্রেশনের পর জমির যদি কোনো উন্নয়ন হয়ে থাকে, তাহলে উন্নয়নের ওপর অতিরিক্ত হিসেবে আরও ৬.২৫% সুদ হিসাব করে আদালতে জমা প্রদান করতে হবে।
আগ্রক্রয়ের অধিকার দাবিতে যে মামলা দায়ের করা হয়, তার সবকিছু ঠিক থাকলে যিনি মামলা দায়ের করেন, তাঁর জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে শতভাগ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, আমাদের দেশের মানুষ সম্পত্তি রেজিস্ট্রেশনের খরচ কমানোর জন্য দলিলে সম্পত্তির সঠিক মূল্যমান দেখান না। এটা একটি অন্যায় এবং ‘অগ্রক্রয়াধিকার’ মামলায় অগ্রক্রয়ের দাবিদার এ ধরনের কম মূল্যমানে সম্পাদিত দলিলের ব্যাপক সুবিধা পেয়ে থাকেন।
মামলা নিষ্পত্তির পর আদালত, কৃষিজমির ক্ষেত্রে ‘আগন্তুক’ বা প্রথম ক্রেতাকে নতুন করে জমি ৬০ দিনের মধ্যে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে হস্তান্তরের আদেশ দিয়ে থাকেন। যদি উক্ত ক্রেতা নতুন করে রেজিস্ট্রেশন করে দিতে অস্বীকৃতি জানান, তাহলে আদালত সংশ্লিষ্ট সাবরেজিস্ট্রারকে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করার আদেশ দান করবেন, যা পালনে সাবরেজিস্ট্রার বাধ্য থাকবেন। আদালতের নির্দেশে এমন ধরনের সম্পত্তির রেজিস্ট্রেশনে কোনো প্রকার রেজিস্ট্রেশন ফি সরকারকে প্রদান করতে হয় না। সম্পত্তি যদি অকৃষি হয়, তাহলে নতুন করে রেজিস্ট্রেশনের প্রয়োজন নেই। আদালতের প্রদান করা ডিক্রিই মালিকানার প্রমাণ হিসবে সব জায়গায় গ্রহণযোগ্য হয়।
আদালতের সিদ্ধান্তে যদি কেউ অসন্তুষ্ট হন, তাহলে আদালতের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে দেওয়ানি আপিল আদালতে আপিল দায়ের করা যায়। আপিল আদালতের সিদ্ধান্তেও যদি কোনো পক্ষ অসন্তুষ্ট হয় বা কোনো আইনগত ত্রুটি লক্ষণীয় হয়, তাহলে সে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ১৯০৮ সালের দেওয়ানি কার্যবিধির ১১৫ ধারা অনুযায়ী রিভিশন দায়ের করা যাবে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে অগ্রক্রয়ের মামলা দায়ের করা যায় না। এগুলোর মধ্যে আছে ধর্মীয় বা দাতব্য প্রতিষ্ঠানে সম্পত্তি দান বা ওয়াকফ করা হলে, সম্পত্তি যদি কোনোভাবে বিনিময় হয়, স্বামী বা স্ত্রী যদি একে অন্যকে দান বা হেবা করেন বা অন্য কোনোভাবে ‘হেবা-বিল-এওয়াজ’ করে যদি সম্পত্তি হস্তান্তর করা হয়, সেই ক্ষেত্রগুলোতে অগ্রক্রয়ের দাবি উত্থাপন করা যাবে না। সেই সঙ্গে যৌথ মালিকানার এমন কোনো সম্পত্তি যা বাঁটোয়ারা দলিলের মাধ্যমে নতুন খতিয়ানভুক্ত হয়েছে সে ক্ষেত্রেও অগ্রক্রয়ের অধিকার দাবিতে মামলা করা চলবে না। অগ্রক্রয় বা প্রিয়েমশনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে একই জোতজমার অন্তর্ভুক্ত ওয়ারিশি সম্পত্তি বা ক্রয়সূত্রে বা ব্যবহারসূত্রে বা পার্শ্ববর্তী মালিকের সম্পত্তি বাইরের কোনো ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে শরিক বা ওয়ারিশ বা প্রতিবেশীদের মাঝে যেন কোনো প্রকার সমস্যা সৃষ্টি না হয়, সেই দিকে লক্ষ রাখা। ‘অগ্রক্রয়াধিকার’ ধারণা মানুষকে এই বার্তা দিয়ে যায়, তারা যেন আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখে।
মো. সাজিদুর রহমান আইনজীবী