এদের বয়স চার থেকে সাত বছরের মধ্যে। মা–বাবাকে হারিয়ে বড় হচ্ছে ছোটমণি নিবাসে
এদের বয়স চার থেকে সাত বছরের মধ্যে। মা–বাবাকে হারিয়ে বড় হচ্ছে ছোটমণি নিবাসে

৬ ছোটমণি নিবাস

পরিবার জোটেনি ৩৯% শিশুর

আপনজনেরা ফেলে গেছেন, ছোটমণি নিবাসে এমন শিশু বেশি। কেউ দত্তক না নিলে তাদের ভাগ্যে পরিবার জোটে না।

ঢাকার নবাবগঞ্জে সড়কের পাশ থেকে তিন বছর আগে সদ্য ভূমিষ্ঠ নবজাতকটি উদ্ধার করা হয়। হাসপাতাল ঘুরে তার ঠাঁই হয় রাজধানীর আজিমপুর ছোটমণি নিবাসে। কারা, কেন শিশুটিকে এভাবে ফেলে গিয়েছিল, সেটি জানা যায়নি। আশার কথা, সে এ মাসের শুরুতে নতুন পরিবার পেয়েছে। এক নিঃসন্তান দম্পতি তাকে নিয়ে গেছে।

এই শিশু পরিবার পেলেও ছোটমণি নিবাসের অনেক শিশুর আর নিজ পরিবারে ফেরা হয় না, নতুন পরিবারও ভাগ্যে জোটে না। ১৯ ডিসেম্বর ছোটমণি নিবাসে গিয়ে জানা যায়, এ মাসের শুরুতে সেখানে ২৯টি শিশু ছিল। তার মধ্যে ৯৮ শতাংশই ফেলে যাওয়া শিশু। ২৯ শিশুর মধ্যে ৪টির দত্তক হয়েছে। আরও ৪টির দত্তকের প্রক্রিয়া চলেছে।

নিবাসের কর্মীরা বলেন, দুটি শিশুর প্রকৃত অভিভাবক রয়েছে। তাদের পরিবারে ফেরার সম্ভাবনা রয়েছে। একটি শিশু প্রতিবন্ধী, তাকে দত্তক দেওয়া হবে না। বাকি ১৮ শিশুর দত্তক হয়নি। নবজাত থেকে সাত বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা ছোটমণি নিবাসে থাকতে পারে। এরপর প্রতিবন্ধীসহ দত্তক না হওয়া শিশুদের সরকারি শিশু পরিবার, এসওএস শিশুপল্লি ও প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনে স্থানান্তর করা হয়।

সমাজসেবা অধিদপ্তর রাজধানীর আজিমপুর, চট্টগ্রামের রউফাবাদ, রাজশাহীর গ্রেটার রোড, সিলেটের বাগবাড়ী, খুলনার মহেশ্বরপাশা ও বরিশালের আগৈলঝাড়ায় মোট ছয়টি ছোটমণি নিবাস পরিচালনা করে। ৬০০ আসনের এসব নিবাসে এখন ১৩৫ শিশু রয়েছে। ঠাঁই পাওয়া শিশুদের ছোটমণি নিবাসের নিবন্ধন খাতায় ‘শিশু ভর্তি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ বছরে ৬টি ছোটমণি নিবাসে ৪০৫ শিশুকে দত্তক, প্রকৃত অভিভাবকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তরের মাধ্যমে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৮ শতাংশ শিশুকে দত্তক ও ২২ শতাংশ শিশুকে প্রকৃত অভিভাবককে দেওয়া হয়েছে এবং ৩৯ শতাংশ শিশুকে অন্য প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর করা হয়েছে। অর্থাৎ ৩৯ শতাংশ শিশু কোনো পরিবার পায়নি।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারপারসন মো. মাহবুবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, দারিদ্র্যের কারণে ও বিয়ে–বহির্ভূত সম্পর্কে জন্ম নেওয়া শিশুদের ফেলে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। ছোটমণি নিবাসে শিশুদের যাঁরা লালনপালন করেন, তাঁরাও দরিদ্র পরিবারের। শিশুদের প্রতি তাঁদের সংবেদনশীল আচরণ করার মতো প্রশিক্ষণও নেই।

অভিযোগ প্রসঙ্গে সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, নিবাসে শিশুদের লালনপালনে প্রশিক্ষিত খালাম্মা, আয়া, মেট্রন কাম নার্সসহ খণ্ডকালীন জনবল রাখা হয়েছে। পুষ্টিবিদদের পরামর্শ অনুযায়ী খাবার দেওয়া হয়। যত্নের ঘাটতি নেই।

সাড়ে ৩ বছরে ১৩৪ নবজাতক উদ্ধার

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম গত জুন পর্যন্ত পত্রিকার তথ্য সংকলন করে জানিয়েছে, ২০১৯ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সাড়ে ৩ বছরে ১৩৪টি নবজাতক উদ্ধার করা হয়। এদের মধ্যে ৪৪ নবজাতককে জীবিত ও ৯০টিকে মৃত পাওয়া যায়। এ বছরের প্রথম ৬ মাসে ১০ নবজাতককে জীবিত ও ১৪টিকে মৃত উদ্ধার করা হয়।

ঠাঁই অন্যের কোলে

গত নভেম্বরে স্ত্রীকে বাঁচাতে এক চিকিৎসক একটি শিশুর জন্য আজিমপুর ছোটমণি নিবাসে ছুটে আসেন। তাঁর নবজাতক সন্তানের মৃত্যুর পর স্ত্রী পাগলপ্রায়। তিনি যেদিন আসেন, তার দুই দিন আগে সড়কের পাশে ফেলে যাওয়া একটি নবজাতককে উদ্ধার করে নিবাসে আনা হয়। আদালতের নির্দেশে দুই দিনের মধ্যে দত্তকপ্রক্রিয়া শেষ করে শিশুটিকে নিয়ে যান ওই চিকিৎসক।

সচ্ছল দম্পতি না হলে শিশু দত্তক পাওয়া যায় না। ১৯ ডিসেম্বর নিবাসে এসেছিলেন আসলাম হোসেন ও ফাতেমা আক্তার দম্পতি। আসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ছোটখাটো ব্যবসা করেন। দত্তক না পেয়ে ওই দিন নিরাশ হয়েই তাঁদের ফিরতে হয়।

ছোটমণি নিবাসের উপ–তত্ত্বাবধায়ক জুবলী বেগম প্রথম আলোকে বলেন, এই শিশুদের বড় করতে সামাজিক কিছু ঝক্কি থাকে। তাই তাদের দায়িত্ব নেওয়ার মতো যথেষ্ট আর্থিক ও সামাজিক সক্ষমতা আছে, এমন ব্যক্তিদের কাছে শিশু দত্তক দেওয়া হয়।

পরিবারের ছায়া দিতে হবে

নিজের পরিবারে একটি শিশু যেভাবে বড় হয়, নিবাসের এসব শিশুকে সেভাবে যত্ন করা জরুরি বলে জানান জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সামাজিক প্রেক্ষাপটে এসব শিশু নিজেদের সামাজিকভাবে বিচ্যুত মনে করে। এটা তাদের ব্যক্তিত্ব গঠন ও আচরণে প্রভাব ফেলে। তাই, সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে তাদের যথাযথ যত্ন নিশ্চিত করতে হবে।