প্রায় ৯ বছর আগে বিয়ে হয় পুষ্প আক্তারের (২৪)। তাঁর ছয় বছরের একটি ছেলে আছে। করোনা মহামারি শুরু হওয়ার ঠিক আগে কিশোরগঞ্জে বাবার বাড়িতে স্বামী-সন্তানসহ বেড়াতে যান। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে পুষ্পর স্বামী নিজের বাড়ি বরিশালে ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।
এমনই এক অবস্থায় শিশুসন্তানকে নিয়ে ‘অথই সাগর’-এ পড়েন পুষ্প। নিরুপায় হয়ে জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩-এ ফোন করে কেঁদে ফেলেন তিনি। হেল্পলাইন থেকে পরামর্শ পেয়ে পুষ্প এখন স্বামীর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিয়েছেন।
আজ ১২ এপ্রিল জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩-এর পাঁচ বছর পূর্তি হয়েছে। ২০১৮ সালে ‘সরকারি তথ্য ও সেবা সব সময়’ স্লোগান নিয়ে চালু হয়েছিল ৩৩৩। পাঁচ বছরের এ যাত্রায় পুষ্পর মতো অনেকেই নানা ধরনের সেবা নিয়েছেন। ভবিষ্যতে সেবার পরিধি আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে এই কর্তৃপক্ষের।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের আওতায় ও ইউএনডিপির সহায়তায় পরিচালিত এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) প্রোগ্রামের কল সেন্টারভিত্তিক সেবা ৩৩৩ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে পুষ্পর কথা জানা যায়।
এটুআইয়ের আইসিটি সলিউশনের ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট দিদার-ই-কিবরিয়া প্রথম আলোকে জানান, আনুমানিক ২০ দিন আগে তাঁদের কাছে পুষ্পর কল আসে। নারী ও শিশু নির্যাতন-সম্পর্কিত সহায়তা-সংক্রান্ত কল হলে তাঁরা সাধারণত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু পুষ্পর আকুতি শুনে তাঁরা তৎক্ষণাৎ সহায়তা দেওয়ার কথা ভাবেন।
এ বিষয়ে পুষ্প প্রথম আলোকে বলেন, স্বামী না জানিয়ে বিয়ে করেছেন, ভরণপোষণ দিচ্ছেন না, যোগাযোগ করলে হুমকি দিচ্ছিলেন। তাই ৩৩৩-এ ফোন করে সহায়তা চান। ৩৩৩-এ ফোন করার পর কিশোরগঞ্জ লিগ্যাল এইডের সঙ্গে পুষ্পকে যুক্ত করে দেওয়া হয়। পরে স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি।
জানা গেছে, জাতীয় হেল্পলাইনে বেশি কল এসেছে সিলেট, নোয়াখালী, ঢাকা, যশোর ও সাতক্ষীরা জেলা থেকে। অন্যদিকে বরিশাল, বাগেরহাট, বরগুনা, ভোলা, বান্দরবান থেকে কলের সংখ্যা খুবই কম। এ পর্যন্ত যত কল এসেছে, তাতে নারীর চেয়ে পুরুষ সেবাগ্রহীতার সংখ্যা বেশি।
জানতে চাইলে দিদার-ই-কিবরিয়া প্রথম আলোকে বলেন, প্রচারণা ও প্রশাসনের ভূমিকার কারণে কিছু জেলা থেকে বেশি কল এসেছে। আবার যেসব জেলা থেকে কল কম এসেছে তার একটি কারণ, ৩৩৩ সম্পর্কে প্রচারণা কম এবং না জানা।
ফরম পূরণ, ভাতা, বাল্যবিবাহ, ভূমি, খাদ্য, স্বাস্থ্য সহায়তায় সরকারি সেবা-সংক্রান্ত তথ্যসহ নানা বিষয়ে ৩৩৩-তে এখন পর্যন্ত ৮ কোটি ৪০ লাখ কল এসেছে। এর মধ্যে ৪ কোটির বেশি কল গ্রহণ করে সেবা প্রদান করা হয়েছে। ৪ কোটি কলের মধ্যে খাদ্য ও ত্রাণসহায়তাসংক্রান্ত ১ কোটি ৬৪ লাখ, স্বাস্থ্যজিজ্ঞাসা ১ কোটি, ওষুধ ও নিত্যপণ্য ক্রয় ৯৮ লাখ ৪৫ হাজার, সরকারি তথ্যসহায়তা ২৩ লাখ ২৮ হাজার, ভূমিসেবা ২২ লাখ, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে ২০ লাখ, ডিজিটাল কমার্স-সংক্রান্ত কল ‘একশপ’ ১২ লাখ ৭৩ হাজার, সাইবার নিরাপত্তা সহায়তা ১০ লাখ ৬২ হাজার, নারী ও শিশু সহায়তা ৬ লাখ ৬০ হাজার, প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহায়তা ৪ লাখ ৪৮ হাজার, সামাজিক সমস্যা প্রতিরোধ ৩৯ হাজার এবং বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ-সংক্রান্ত কল ছিল প্রায় সাড়ে ৯ হাজার।
আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগে ২০১৭ সালের মার্চে দেশের ২৪টি জেলায় ৩৩৩-এর পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চালু হয়। শুরুতে সরকারি তথ্যসহায়তাভিত্তিক কল সেন্টার হিসেবেই এটি চলছিল। পরে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা-সংক্রান্ত সেবা এতে যুক্ত হয়। করোনা মহামারিতে ৩৩৩-এর বড় ভূমিকা দেখা যায়। ওই সময় সাহায্য চেয়ে দিনে লাখের ওপর কল গ্রহণ করতে হয়েছে। সরকারি খাদ্যসহায়তা ও স্বাস্থ্যসেবাসংক্রান্ত সেবার চাহিদাই তখন শীর্ষে ছিল। এর আওতায় প্রায় ২৫ লাখ পরিবারকে খাদ্যসহায়তা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে ৩৩৩ কর্তৃপক্ষ।
প্রতিদিন গড়ে এখন ২৫ হাজার কল আসে ৩৩৩ নম্বরে। এর মধ্যে ৮ থেকে ১০ হাজার কলের সেবা সরাসরি ৩৩৩ থেকেই দেওয়া হয়। বাকিগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রতিদিন ভূমিসংক্রান্ত সেবার জন্য প্রায় আড়াই হাজার কল আসে।
৩৩৩-এ সরাসরি চাওয়া সেবার ৫০ শতাংশই সরকারি কর্মকর্তাদের নম্বর চেয়ে আসে। এটুআই জানিয়েছে, ৩৩৩-এর একটি চ্যাটবট তৈরি করা হচ্ছে; যেখানে প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষ বা কর্মকর্তার নম্বর দেওয়া হবে।
এটুআই জানিয়েছে, ৩৩৩ কল সেন্টারে ৬০ জন কর্মী কাজ করছেন। ২৪ ঘণ্টাই এখান থেকে বিনা মূল্যে সেবা দেওয়া হয়। দিদার-ই-কিবরিয়া জানান, কোনো সেবাগ্রহীতা প্রথমবার ফোন করলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁর পরিচয় থেকে যায়। একই গ্রাহক-পরবর্তী সময়ে ফোন করলে পুনরায় তাঁর পরিচয় জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন হয় না। এ ছাড়া জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ৩৩৩-এর চুক্তি করা আছে। ফলে গ্রাহকের পরিচয়ও শনাক্ত করা সম্ভব হয়।
এটুআইয়ের প্রকল্প পরিচালক দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, দেশে এখন সরকারের অনেক কল সেন্টার রয়েছে। এত কল সেন্টারের নম্বর মানুষের পক্ষে মনে রাখা সম্ভব নয়। তাই সব কটি সমন্বয় করার পরিকল্পনা রয়েছে। সেখানে হয়তো দুটি কেন্দ্রীয় কল সেন্টার থাকবে।
এটুআই এখনো প্রকল্পভিত্তিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। প্রকল্প শেষ হয়ে গেলে এ কল সেন্টারের ভবিষ্যৎ কী হবে, জানতে চাইলে মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, এটুআই এজেন্সি হতে যাচ্ছে। তখন ৩৩৩ কার্যক্রমও স্থায়িত্ব পাবে ও চাহিদা বুঝে টেকসই পরিকল্পনা নেওয়া হবে।