মুক্তিযুদ্ধ

যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী

একাত্তরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি হিসেবে ভারত সরকারের উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন মঈদুল হাসান। পরবর্তী সময়ে তিনি লিখেছেন মূলধারা ’৭১ এবং উপধারা একাত্তর, মার্চ-এপ্রিল নামে দুটি বই। বিভিন্ন দেশে অবমুক্ত হওয়া মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র ঘেঁটে ও তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি লিখছেন আরও একটি বই। তাঁর প্রকাশিতব্য সেই বইয়ের চতুর্দশ অধ্যায়ের শেষ কিস্তি প্রকাশিত হলো আজ।

যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা
ছবি: আনন্দবাজার পত্রিকার সৌজন্যে

ওয়াশিংটনে ৯ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি আলেকজান্ডার হেগ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিনের মনোভাব–সংক্রান্ত এক গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে পাঠান। এ প্রতিবেদনের প্রথম সংস্করণ এশীয় সফর শুরুর আগে কিসিঞ্জার দেখে গিয়েছিলেন। সম্ভবত সময়ের অভাবে নিক্সনকে সে সম্পর্কে তিনি অবহিত করে যেতে পারেননি।

নিক্সনকে পাঠানো হেগের ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে জুন মাসে মস্কোতে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসিগিনের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের সাক্ষাতের কথা উল্লেখ রয়েছে। এ সময় কোসিগিন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে ভারতের তত্ত্বাবধানে সংগঠিত পূর্ব পাকিস্তানের গেরিলা বিদ্রোহীদের তৎপরতাকে সাহায্য করার জন্য কিছু হালকা অস্ত্র সরবরাহ করা হবে।

এ প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে যে চীন যদি পূর্ব পাকিস্তানে গোলযোগের কারণে ভারতের বিরুদ্ধে কোনো তৎপরতা শুরু করে, তবে সে ক্ষেত্রেও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে নিরাপত্তা সহায়তার নিশ্চয়তা দিতে সম্মত হতে পারে, যদি সেই মর্মে ভারত লিখিতভাবে সে রকম অনুরোধ জানায়। একই ধরনের প্রতিবেদন এর আগে আরও দুবার যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল কতৃ৴ক উত্থাপিত হয়েছিল।

মঈদুল হাসান

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘প্রতিবেদনগুলো কিছুটা বিস্ময়কর, কেননা সোভিয়েতরা দক্ষিণ এশিয়াকে স্থিতিশীল রাখার মধে৵ তাদের স্বার্থ নিহিত বলে এযাবৎ গণ্য করত। ...তারা মনে হয় এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে বিভক্ত পাকিস্তান এমনভাবে আর টিকে থাকতে পারে না এবং তারা সম্ভবত দক্ষিণ এশিয়ার “নতুন বাস্তবতার” পক্ষাবলম্বন করতে চলেছে। ...এই প্রতিবেদনের সর্বাপেক্ষা উদ্বেগজনক বিষয়টি হলো, সত্যিই কোসিগিন যদি চীনের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে, তবে ভারত পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারে কম দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধে৵ থাকবে। ভারত একসঙ্গে পাকিস্তানের দুই সীমান্ত এবং চীনের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে যুদ্ধ চালানোর সক্ষমতার কথা যতই সাহসের সঙ্গে বলুক, ভারতীয়রা এখনো ১৯৬২ সালের পরাজয়ের গ্লানি বহন করে চলে।’ (সূত্র: FRUS: ভলিউম ১১, দলিল ৯৮)

এবার আরেকটি ব্যতিক্রম ঘটে যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন প্রতিবেদনটি নিজে দেখে কিসিঞ্জারের উদ্দেশে নির্দেশ লেখেন, ‘ব্যাপারটি যদি সত্যি হয়, কিটিংকে (ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ বি কিটিং) আদেশ দেওয়া হোক এর জোরালো প্রতিবাদ জানাতে (প্রথমে অবশ্য ব্যক্তিগত পর্যায়ে)।’ প্রতিবেদনের মার্জিনে নিক্সন আরও লেখেন, “তাদের সাবধান করে দেওয়া হোক তারা যদি এভাবে হস্তক্ষেপ করে চলে তবে আর এন (রিচার্ড নিক্সন) তাঁর নিজস্ব উদ্যোগে ভারতকে দেওয়া সব সাহায৵ বন্ধ করে দেবে।”’ (সূত্র: প্রাগুক্ত)।

কিসিঞ্জারের বার্তা

১৫ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে সমগ্র বিশ্ববাসীকে চমকিত করে জানানো হয়, প্রেসিডেন্ট নিক্সনের প্রতিনিধি হিসেবে হেনরি কিসিঞ্জারের গোপন চীন সফরের কথা এবং দীর্ঘ ২৩ বছরের ব্যবধানে এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত। বিস্ময় ও প্রশংসার বৈশ্বিক আবহাওয়ার মধ্যে কিসিঞ্জার তাঁর প্রেসিডেন্ট প্রদত্ত ম্যান্ডেট বাস্তবায়িত করার কাজে হাত দেন, যা একই সঙ্গে চীনের প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাশা বহুলাংশেই পূরণ করে।

১৭ জুলাই কিসিঞ্জার ওয়াশিংটনে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত লক্ষ্মীকান্ত ঝাকে আলোচনার জন্য আহ্বান করেন। মাত্র ১০ দিন আগে দিল্লিতে চীনের সামরিক চাপের বিরুদ্ধে দেওয়া প্রতিশ্রুতি সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলে দিয়ে কিসিঞ্জার বলেন, ভারত ও পাকিস্তান যদি কোনোক্রমে সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে এবং চীন যদি পাকিস্তানের পক্ষে সক্রিয় হয়ে ওঠে, তবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ১৯৬৩ সালে সম্পাদিত ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সামরিক চুক্তি সত্ত্বেও চীনের বিরুদ্ধে প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে অপারগ থাকবে।

কিসিঞ্জারের এই বার্তা ছিল ইন্দিরা গান্ধীর জন্য কেবল নিদারুণ আশাভঙ্গের নয়, অধিকন্তু আসন্ন অপরিসীম বিপদেরও। দুঃসংবাদটি আসার সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ গ্রহণের জন্য পররাষ্ট্রসচিব ছাড়াও তিনি মস্কো থেকে সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রদূত ডি পি ধর এবং সরকারি দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণের নোটিশ দেওয়া পি এন হাকসারকে আহ্বান করেন। এদের মধ্যে হাকসার উদ্ভূত সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে ভারতের গৃহীত কৌশল কি হওয়া অবশ্যক, সে সম্পর্কে কোনো অস্পষ্টতা ইতিপূর্বে কখনো রাখেননি। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে নিরাপত্তাবিষয়ক চুক্তি সম্পাদনের আবশ্যকতাকে কেন্দ্র করেই ইন্দিরা গান্ধী ও হাকসারের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। ইন্দিরা গান্ধী তাঁর মত পরিবর্তন করে শিগগিরই এই চুক্তি সম্পাদনে ডি পি ধরকে মস্কো পাঠান।

ইতিমধে৵ ভারতের উচ্চতর ক্ষমতাকেন্দ্রে হাকসারের অবসর গ্রহণের বিষয় নিয়ে সংগোপনে আলোচনা শুরু হয়। একপর্যায়ে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ হিসেবে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ১৫ জুলাই লিখিতভাবে জানান যে তিনি অনুভব করেন, চলমান নাজুক পরিস্থিতিতে হাকসারের বিচক্ষণ দিকনিদের্শনার প্রভূত প্রয়োজন রয়েছে এবং সে কারণে যে পদেই হোক তাকে সরকারের কোনো দায়িত্বে নিযুক্ত রাখা দরকার। (সূত্র: জয়রাম রমেশ: ইন্টারওয়াইন্ড লাইভস: পি এন হাকসার অ্যান্ড ইন্দিরা গান্ধী, পৃ ২১৬, প্রকাশকাল, ২০১৮)।

কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন ঘটেনি। সেপ্টেম্বরে হাকসারের অবসরপূর্ব ছুটি গ্রহণের সময় এগিয়ে আসতে থাকে। তা সত্ত্বেও তিনি পূর্ণমাত্রায় তৎপর হয়ে শরণার্থী সংকট সমাধানের জন্য কোনো বৃহৎ শক্তির সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল না থেকে ভারত সরকারকে সব বিষয়ে উদ্যোগী করে তুলতে সচেষ্ট হন, যাতে তারা ক্রমবর্ধমান শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় সক্ষম হয়। জুলাই মাসের বাকি দিনগুলোয় সেগুলো নির্দিষ্ট রূপ পেতে শুরু করে একে একে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে ইন্দিরা গান্ধীর দ্বিধাদ্বন্দ্ব পরিস্থিতির চাপে দূর হওয়ার পর ভারত–সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের আলোচনার জন্য পুনরায় ডি পি ধর নিযুক্ত হন। তাঁর কুশল উদ্যোগ দেশরক্ষা বিষয়ে সহযোগিতা লাভের নতুন কয়েকটি দিক উন্মোচিত হয়, সেগুলো অচিরেই ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।

দ্বিতীয়ত শরণার্থীদের শিগগিরই ফেরত পাঠানোর পথ উন্মুক্ত করার জন্য বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের দ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধি এবং যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহের আবশ্যকতা তৈরি হয়। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ট্রেনিং দেওয়ার পর তাদের অস্ত্র দেওয়ার প্রশ্নে দুই মাস ধরে যে গড়িমসি চলছিল, তার অবসান ঘটতে শুরু করে ভূরাজনৈতিক অবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে।

মুক্তিযুদ্ধের নতুন মাত্রা

৬ জুলাই কিসিঞ্জার ভারত সফরে আসার মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে উপমহাদেশের বাইরের তিনটি শক্তি—যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন—শিগগিরই পাকিস্তানের আঞ্চলিক বিরোধ, মুক্তিসংগ্রামীদের তৎপরতা এবং সম্ভাব্য পাকিস্তান-ভারত সামরিক সংঘাত নিয়ে নিজেদের ভূমিকা এমনভাবে যুক্ত করে ফেলেন, যার ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্ব অভাবিতভাবেই এক নতুন মাত্রায় পৌঁছায়।

বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার কারোরই কোনো ধারণা ছিল না, দিল্লিতে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বিরোধ মীমাংসার কোনো কথাবার্তা কিসিঞ্জারের সঙ্গে হয়েছে কি না, অথবা পাকিস্তান সফরকালে প্রসঙ্গটি আলোচিত হয়েছে কি না; আর তার গোপন চীন সফরের কথা ছিল সবারই অজানা। একমাত্র ভারতের দক্ষিণপন্থী পত্রপত্রিকা কিসিঞ্জারের সফরকে নিয়ে আশাবাদী কিছু মন্তব্য ছাড়া কোনো তথ্যই এ সময় জানা যেত না।

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সেক্টর কমান্ডারদের সম্মেলন নিয়ে কোনো অজ্ঞাত স্থানে এমনই ব্যস্ত ছিলেন যে এ বিষয়ে তাঁর অভিমত জানার কোনো সুযোগ আমার ছিল না। কিসিঞ্জারের দিল্লি ও ইসলামাবাদ সফরের পর পরিস্থিতির তারতম৵ জানার জন৵ ঔৎসুক৵ আমার যথেষ্ট ছিল, কিন্তু কোনো সূত্রই এ ব্যাপারে সহায়ক হয়নি।

একটি ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটে কিসিঞ্জারের দিল্লি সফরের এক সপ্তাহ পরে। ১৩ জুলাই হাকসারের বার্তা বহনকারী একজন আমার কাছে জানতে চান, ইতিপূর্বে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য যে বহুদলীয় ফ্রন্ট গঠনের কথা হয়েছিল, বাস্তবে তার অগ্রগতি কতটা ঘটেছে, তা হাকসার দ্রুত জানতে চেয়েছেন! (শেষ)