গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ফেসবুকে নারী রাজনীতিকেরা বেশি আক্রমণের শিকার হয়েছেন। আর তাঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগের চেয়ে ১০ গুণ আক্রমণের শিকার হয়েছেন বিএনপির নারী রাজনীতিকেরা। এর বাইরে সাংবাদিক, বিশ্লেষক, তারকারা নানা ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন।
কানাডাভিত্তিক প্রযুক্তি অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। গত ১১ জুন প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনটির শিরোনাম ‘ফ্রম হোমোফোবিয়া টু অ্যাসল্ট: দ্য জেন্ডারড ল্যান্ডসকেপ অব বাংলাদেশ’স পলিটিক্যাল ডিসইনফরমেশন’ (বিদ্বেষমূলক প্রচারণা থেকে আক্রমণ: বাংলাদেশের রাজনৈতিক অপতথ্যের লিঙ্গভিত্তিক চিত্র)।
গবেষণায় ২০২২ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে গত ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ফেসবুক পেজ ও গ্রুপের পাবলিক পোস্ট ও এগুলোর প্রতিক্রিয়া সংগ্রহ করা হয়। যেসব কনটেন্ট ভুল বা বানোয়াট, সেগুলো ভুল বা ভুয়া তথ্য এবং যেগুলো বিকৃত করা হয়েছে, সেসব অপতথ্য হিসেবে দেখা হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে নারীদের নিয়ে কীভাবে অপতথ্য তৈরি করা ও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তা ফেসবুকের ২৫ হাজার কনটেন্ট (আধেয়) বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে। এসব কনটেন্টে অন্তরঙ্গ ছবির অপব্যবহার, ডক্সিং (কারও পোস্ট করা ব্যক্তিগত তথ্য ভুয়া আইডি তৈরিসহ হীন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা), ট্রলিং, সম্মতি ছাড়া ডিপফেক ছবি তৈরি, উৎপাত, যৌন হয়রানির মাধ্যমে আক্রমণ করা হয়েছে। আবার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সাংবাদিক ও অধিকারকর্মীদের অপমান, অবমাননা ও হয়রানি করতে কনটেন্টে ব্যবহার করা হয়েছে লিঙ্গভিত্তিক বিভিন্ন শব্দ।
আক্রমণের শিকার হওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষ দশে থাকা নারীরা হলেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য রুমিন ফারহানা, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মেয়ে জাইমা রহমান, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তাঁর নাতনি (প্রয়াত আরাফাত রহমানের মেয়ে) জাফিয়া রহমান, ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নিপুন রায় চৌধুরী, জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ, আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য সংগীতশিল্পী মমতাজ বেগম, আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির বহিষ্কৃত সদস্য হেলেনা জাহাঙ্গীর, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহসম্পাদক নিলোফার চৌধুরী মনি।
এ ছাড়া বিশ্লেষকদের মধ্যে একমাত্র নারী হিসেবে মিনাহ ফারাহ বেশি আক্রমণের শিকার হয়েছেন। তিনি ক্ষমতাসীন দলের সমালোচক হিসেবে পরিচিত। অভিনয়শিল্পী মাহিয়া মাহিও বড় ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন। কিছুটা আক্রমণের শিকার হয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদও।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) এই সময়ে সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য বানানো হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। বিশ্বজুড়েই এর ভয়াবহ প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারি বাড়াতে আলাদা লোকবল তৈরি করে। ক্ষমতায় থাকার কারণে তারা সংগঠিত ছিল। অন্যদিকে বিএনপি ছিল দৌড়ের (মামলা, গ্রেপ্তার নিয়ে) ওপর। তারা এ ক্ষেত্রে খুব একটা সংগঠিত হতে পারেনি এবং আক্রমণের শিকার হয়েছে বেশি।—বদিউল আলম মজুমদার, সুজন সম্পাদক
টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের চিফ অব স্টাফ ও জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ফৌজিয়া আফরোজ প্রথম আলোকে বলেন, দেশে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ এমনিতে কম। রক্ষণশীল সংস্কৃতি ও সামাজিক আচরণ নারীকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে নিরুৎসাহিত করে। এর ওপর অপতথ্য ছড়ালে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ আরও সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। নির্বাচনী এলাকার প্রান্তিক মানুষের প্রযুক্তিজ্ঞান কম। তাঁরা খুব সহজে ভুয়া ও অপতথ্য বিশ্বাস করেন।
এর আগে ২০২২ সালে একশনএইডের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, অনলাইনে প্রতি ১০০ নারীর মধ্যে ৬৪ জন কোনো না কোনোভাবে হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।
২৫ হাজারের মধ্যে ১ হাজার ৪০০ কনটেন্ট বেশি লিঙ্গভিত্তিক আক্রমণাত্মক ছিল বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। এসব পোস্টের ৭০ শতাংশই যৌনতাবিষয়ক। যেমন কনটেন্টে ‘যৌনকর্মী’ শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। প্রায় ১৯ শতাংশ ছিল ব্যক্তির ধর্মবিশ্বাস, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বা ব্যক্তির যৌন–সম্পর্কিত বিশ্বাসের ওপর। ১০ শতাংশ ছিল আচরণগত আক্রমণ। যেমন ‘মদপান’, ‘গভীর রাতে পার্টি করা’ ইত্যাদি শব্দসংশ্লিষ্ট। পোস্টগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সংঘবদ্ধভাবে ভুয়া তথ্য ও অপতথ্য ছড়াতে ৩০০ পোস্ট হুবহু বিভিন্ন পেজ ও গ্রুপে পোস্ট করা হয়েছে।
পুরুষের চেয়ে নারীর প্রতি আক্রমণের মাত্রা ছিল অনেক বেশি। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত নারীর প্রতি আক্রমণের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি ছিল। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত কম থাকলেও নির্বাচনের আগের মাসে ডিসেম্বরে আক্রমণের মাত্রা আবার বেড়ে যায়। গত জানুয়ারিতে আবার নিচে নেমে আসে।
গবেষণায় বলা হয়, ৫১ ব্যক্তি, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, বিশ্লেষক ও অধিকারকর্মী জেন্ডার সংবেদনশীল নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৮৮৭ বার।
আওয়ামী লীগের তুলনায় বেশি আক্রমণের শিকার হয়েছেন বিএনপির নেতারা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা।
তারেক রহমানকে নিয়ে ২০০ পোস্ট দেখা হয়েছে, যা মোট কনটেন্ট পর্যালোচনার ১৫ শতাংশ। খালেদা জিয়ার দুই নাতনি রাজনীতিতে সক্রিয় না হলেও তাঁদের বিরুদ্ধে ১৫০টির বেশি পোস্ট দেখা গেছে। তাঁরা তারেক রহমান ও খালেদা জিয়ার সঙ্গে ৪১৩টি আক্রমণের শিকার হয়েছেন, যা মোট পর্যালোচনা করা পোস্টের ২৮ শতাংশ। এ ছাড়া শামা ওবায়েদ ও রুমিন ফারহানা ৩৪৫টি আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ৪৫টি জেন্ডার আক্রমণের শিকার হয়েছেন। তবে ২২৩টি ঘটনায় তাঁকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
সাংবাদিক ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিশ্লেষকেরা ৩২৩টি আক্রমণের ঘটনার শিকার হয়েছেন।
বিএনপির নেতারা বেশি আক্রমণের শিকার হওয়া প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) এই সময়ে সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য বানানো হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। বিশ্বজুড়েই এর ভয়াবহ প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারি বাড়াতে আলাদা লোকবল তৈরি করে। ক্ষমতায় থাকার কারণে তারা সংগঠিত ছিল। অন্যদিকে বিএনপি ছিল দৌড়ের (মামলা, গ্রেপ্তার নিয়ে) ওপর। তারা এ ক্ষেত্রে খুব একটা সংগঠিত হতে পারেনি এবং আক্রমণের শিকার হয়েছে বেশি।
বদিউল আলম আরও বলেন, আইন প্রয়োগেরও দুর্বলতা আছে। দেখা যায়, ক্ষমতাসীনেরা বিরোধী পক্ষের ওপর আইন প্রয়োগের সুযোগ পায় বেশি। আর সামাজিক প্রেক্ষাপটে এ দেশে খুব সহজে নারীরা সহিংসতার লক্ষ্যে পরিণত হয়।
অসত্যভাবে বিভিন্ন পোস্টকে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বলে উল্লেখ করে ছড়িয়েছে সাত শতাধিক পেজ। ১৩৭টি পেজ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে দাবি করেছে। যদিও সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো এ নিয়ে স্পষ্ট কিছু জানায়নি। দেখা গেছে, একটি কনটেন্ট পোস্ট করার সেকেন্ডের মধ্যেই কিছু গ্রুপ ও পেজ তা শেয়ার করেছে। ভুয়া অভিযোগগুলো প্রতিষ্ঠিত করতে তারা আবার সেগুলো আপলোড করেছে। ফ্যাক্ট চেকাররা দেখেছেন, বেশির ভাগ পেজ ও গ্রুপের শেয়ার করা এসব কনটেন্ট শাসক দলের পক্ষে গেছে।
টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের গবেষকেরা বলেছেন, নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে ফেসবুকের নীতি থাকা সত্ত্বেও এ ধরনের কনটেন্ট যথেষ্ট দ্রুত সরিয়ে ফেলা হয় না। এর একটা বড় কারণ, ফেসবুকের নীতি সাধারণ ও বহুপরিচিত ব্যক্তিদের আলাদাভাবে সংজ্ঞায়িত করে। রাজনীতিবিদ বা জনপ্রতিনিধিদের বহুপরিচিত ব্যক্তি হিসেবে ধরা হয়। ফেসবুক মনে করে, এ ধরনের ব্যক্তিদের সমালোচনা করা বাক্স্বাধীনতার অংশ। এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষকে এক করে দেখা হয়।
ফৌজিয়া আফরোজ বলেন, কিছু অশ্লীল শব্দের ক্ষেত্রে প্রতিটি অক্ষরের পর স্টার, হ্যাশ, স্ল্যাশ চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে। এভাবে লেখা শব্দ ফেসবুকের অ্যালগরিদম সহিংসতা বলে শনাক্ত করতে পারে না। তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘটা সহিংসতার বিষয়গুলো আরও গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। নতুন আইন না বানিয়ে যেসব আইন আছে, সেগুলো কতটুকু নারীবান্ধব, তা বিশ্লেষণ করা উচিৎ। প্রতিটি আইনে নারীর প্রতি সহিংসতা ঠেকানো নিয়ে কিছু থাকে, কিন্তু সেগুলোর প্রয়োগ দুর্বল।পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে।