বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) লোকসান বাড়ছে। এতে সরকারকে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ বাড়াতে হচ্ছে। অবশ্য এত ভর্তুকি দিতে নারাজ অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। তারা বিদ্যুৎ বিভাগকে চিঠি দিয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে বলেছে। পাশাপাশি একই চিঠিতে বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসিয়ে রেখে যে ভাড়া বা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়, তা কমাতে বলেছে।
অর্থ বিভাগ গত রোববার বিদ্যুৎ বিভাগকে চিঠিটি দেয়। ভর্তুকি অনুমোদনসংক্রান্ত এ চিঠির একটি শর্তে বলা হয়, বিদ্যুতের বিক্রয় মূল্য সমন্বয় এবং ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ যৌক্তিকভাবে হ্রাস করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সমন্বয় মানেই হলো বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি। অর্থ বিভাগ ভর্তুকি ছাড়ের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর শর্তই দিয়েছে।
অর্থ বিভাগ এমন একটি সময়ে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে বলল, যখন নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মানুষ ব্যাপক চাপে রয়েছে। বাজারে চাল, আটা, ডাল, তেল, চিনি, ডিম, মুরগি, সবজিসহ প্রায় সব পণ্যের দাম বেশ চড়া। বেড়েছে সাবান, টুথপেস্ট, রান্নার গ্যাসসহ (তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজি) প্রায় সব নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম। কয়েক মাসের মধ্যে মার্কিন ডলারের দাম ৮৬ থেকে বেড়ে ১০৭ টাকায় উঠে যাওয়ায় আমদানি করা সব পণ্যের দাম বাড়তির দিকে।
ভর্তুকি কমাতে গত আগস্টে ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রল ও অকটেনের দাম এক লাফে লিটারে ৩৪ থেকে ৪৬ টাকা বাড়িয়ে দেয় জ্বালানি বিভাগ। পরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে লিটারে ৫ টাকা কমানো হয়। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নিয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) একটি প্রস্তাবের বিপরীতে গণশুনানি শেষ করে রেখেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। কিন্তু তারা নতুন দাম এখনো ঘোষণা করেনি ‘নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায়’।
এমনই পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর শর্ত দিল অর্থ বিভাগ। জানতে চাইলে বিদ্যুৎসচিব হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত অর্থ বিভাগের চিঠি তাঁর কাছে পৌঁছায়নি। তাই আপাতত মন্তব্য করতে পারছেন না।
সরকার যে ব্যয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, বিক্রি করে তার চেয়ে কম দামে। পিডিবি বলছে, গত অর্থবছরে (২০২১-২২) প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রি করে গড়ে তারা পেয়েছে ৫ টাকা ৯ পয়সার মতো, যেখানে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৯ টাকা। বাকি টাকা ভর্তুকি হিসেবে দেয় অর্থ বিভাগ। এর উদ্দেশ্য হলো, পণ্যের উৎপাদন খরচ ও মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় কমিয়ে রাখা।
অর্থ বিভাগ রোববার বিদ্যুৎ বিভাগকে চিঠি দিয়েছে পিডিবির গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের ভর্তুকি অনুমোদন করে। এই দুই মাসের ভর্তুকি হিসেবে ছাড় করা হয়েছে প্রায় ৪ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা। সঙ্গে দেওয়া হয়েছে সাতটি শর্ত। শর্তের মধ্যে বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয় ও ভাড়া বাবদ ব্যয় কমানো ছাড়া রয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাসভিত্তিক আর্থিক ক্ষতির বিবরণী পরবর্তী মাসের প্রথম সপ্তাহে অর্থ বিভাগে পাঠাতে হবে, সুষ্ঠু ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার স্বার্থে পিডিবির অধীনে থাকা প্রতিষ্ঠান ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের তাৎক্ষণিক তথ্যনির্ভর সফটওয়্যার দ্রুত বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নিতে হবে।
আর্থিক শৃঙ্খলা ও জাতীয় বাজেট ব্যবস্থাপনার স্বার্থে বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি নবায়ন বা নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিষয়টি বিবেচনার জন্য অর্থ বিভাগে পাঠানোর শর্তও রয়েছে চিঠিতে।
দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২১ হাজার ৭১২ মেগাওয়াট (কারখানার নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র বা ক্যাপটিভ ছাড়া)। যদিও এত বেশি বিদ্যুতের চাহিদা নেই। এখন দেশে ১২ হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে যে কেন্দ্রগুলো বসিয়ে রাখা হয়, সেগুলোকে ভাড়া দিতে হয়।
বিদ্যুৎ বিভাগ গত জুলাই মাসে সংসদীয় কমিটিকে জানিয়েছিল, গত মার্চ পর্যন্ত আগের ৯ মাসে বিদ্যুৎকেন্দ্রকে সরকার কেন্দ্র ভাড়া বা ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে প্রায় ১৬ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে (২০২০-২১) এ খাতে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকার কিছু বেশি।
অপরিকল্পিতভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও উচ্চ হারে কেন্দ্র ভাড়া ধরে চুক্তি করার কারণে এই বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে বলে সমালোচনা রয়েছে। অন্যদিকে উচ্চ মূল্যের ডিজেল, ফার্নেস তেল ও আমদানি করা ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করায় ব্যয় অনেক বেশি পড়ে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
পিডিবি পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম গড়ে ৬৬ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল, যা নিয়ে গত ১৮ মে শুনানি করেছে বিইআরসি। সেখানে দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া প্রায় শেষ করে এনেছে বিইআরসি। পাইকারির পর বাড়বে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম।
বিইআরসি ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে শুনানির আদেশ ঘোষণা করবে, এমন আইনি বাধ্যবাধকতা আছে। এ হিসাবে আগামী ১৩ অক্টোবর তাদের সময় শেষ হচ্ছে। বিইআরসির দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, বিদ্যুৎ খাতে সরকারি ভর্তুকির পরিমাণ জানতে দুই দফায় বিদ্যুৎ বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে ১৭ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ ভর্তুকি ধরে ২০ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে বলে হিসাব করেছে বিইআরসি।
সূত্র জানিয়েছে, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বিইআরসি সরকারের উচ্চপর্যায়ের সংকেতের অপেক্ষায় আছে।
বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরকার এখন ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য পরিকল্পিত লোডশেডিং করছে। এতে মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে না, কিন্তু কেন্দ্র ভাড়া ঠিকই দেওয়া হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে।
লোডশেডিংয়ের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমায় দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করে গত ১৩ জুলাই বিইআরসিতে একটি চিঠি দিয়েছে ক্যাব। চিঠিতে পুনরায় শুনানি না করে আগের দাম বহাল রাখার দাবি জানিয়েছে তারা।
ক্যাব বলছে, গত জুনে গড়ে ২৩ শতাংশ বাড়ানো হয় গ্যাসের দাম। আগস্টে বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম। এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে নিত্যপণ্য ও সেবার দাম আরেক দফা বাড়বে।
ক্যাবের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, মূল্য সমন্বয়ের কথা বলে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে বলেছে অর্থ বিভাগ। এভাবে পিডিবির ঘাটতি সমন্বয় হবে না। তবে কেন্দ্র ভাড়ার কারণে বিদ্যুৎ খাতে ঘাটতি বৃদ্ধির বিষয়টি অর্থ বিভাগ চিঠির মাধ্যমে স্বীকার করে নিয়েছে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া ও এ খাতের কোম্পানিগুলোর মুনাফা যৌক্তিক করা হলে মূল্য সমন্বয় দরকার হবে না।