প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে

হুদা ও নূর বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে

হাবিলদার (অব.) মো. কুদ্দুস সিকদার ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে কর্তব্যরত ছিলেন। তিনি ওই রাতে ঘাতকদের নৃশংসতার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। সেই ভয়ংকর অমানিশার মুহূর্ত তাঁদের বয়ানে অবিকল তুলে ধরা হলো।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
 ছবি: জহিরুল হক

আমি একজন হাবিলদার (অব.) নং-১২৫১০৮৭। ১৯৬০ সনের ১৭ই মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সিপাহী পদে যোগদান করি। যোগদানের পর তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের ক্যাম্বেলপুরে ট্রেনিং প্রাপ্ত হই। অতঃপর ৮ মিডিয়াম রেজিমেন্ট আর্টিলারীতে আমার পোস্টিং হয়। আমি পাকিস্তানের বিভিন্ন সেনাছাউনীতে চাকুরী করি। বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলাম। যুদ্ধের পরে ১৯৭৩ সনে ২৭শে সেপ্টেম্বর পাকিস্তান হইতে বাংলাদেশে ফেরত আসি তারপর ২ মাসের ছুটিতে বাড়ীতে যাই। ছুটি ভোগ করার পর ওয়ান ফিল্ড আর্টিলারী রেজিমেন্টে আমার পোস্টিং হয়। তখন লে. কমা. আলী আনছার কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। মেজর শরিফুল হক ডালিম সেকেন্ড কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। মেজর এ বি এম ইলিয়াছ, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা, ক্যাপ্টেন আবুল বাশার, সুবেদার মেজর আবদুল ওয়াহাব জোয়ারদার ঐ ওয়ান ফিল্ড আর্টিলারী অফিসার ছিলেন। ঐ ওয়ান ফিল্ড আর্টিলারী কুমিল্লায় ছিল।

১৯৭৫ সনে প্রথম দিকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে মেজর শরিফুল হক ডালিমকে চাকুরী হইতে অব্যাহতি দেওয়া হয়। চাকুরী যাবার পর মেজর শরিফুল হক ডালিমকে ঐ আর্টিলারীতে দেখিয়াছি। ১৯৭৫ সনের জুলাই মাসের শেষের দিকে ওয়ান ফিল্ড রেজিমেন্ট হইতে এক কোম্পানী রেজিমেন্ট ফোর্স—ঢাকা গণভবনে এবং তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে ডিউটির জন্য পাঠায়। ঐ কোম্পানীতে আমিও ছিলাম। ইতিমধ্যে আমি হাবিলদার পদে উন্নীত হই। ক্যাপ্টেন আবুল বাশারের নেতৃত্বে জুলাই মাসের শেষের দিকে আমরা ঢাকা আসিয়া গণভবনে পৌঁছি। ক্যাপ্টেন আবুল বাশার সাহেব আমাদের ডিউটি বণ্টন করিয়া দেন। নায়েব সুবেদার আবুল মোতালেব, হাবিলদার আবদুল গনি, নায়েক আবদুল জলিল, সিপাই সোরাব হোসেন ও আমি হাবিলদার মো. কুদ্দুস সিকদার ও কয়েকজন এন সিও সিপাইসহ ২৫ জনের একটি দলকে ধানমন্ডিস্থ ৩২ নং রোডে ৬৭৭ নং বাড়ীতে অর্থাৎ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ীতে ডিউটিতে পাঠায়। তখন ধানমন্ডিস্থ ৩১ নং রোডে গার্ডদের জন্য নির্ধারিত একটি বাড়ীতে আমরা থাকি। সেখান হইতে আমরা পালাক্রমে বঙ্গবন্ধুর বাড়ীতে ডিউটি করিতাম।

১৯৭৫ সনের ১৪ই আগস্ট ভোর ৬টায় আমার ডিউটি শেষ করিয়া আমার পরবর্তী হাবিলদার আবদুল গনিকে ডিউটি বুঝাইয়া দিয়া আমি ৩১ নং রোডের বাড়ীতে চলিয়া যাই। ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট রোজ শুক্রবার আনুমানিক ভোর পৌনে ৫টার সময় ৩১ নং রোডের বাড়ী হইতে আমার সঙ্গীয় গার্ডদের লইয়া ৩১ নং রোডের গেইটের সামনে আসিয়া আমাদের রেজিমেন্টের সুবেদার মেজর আবদুল ওয়াহাব জোয়ারদার সাহেবকে জীপ হইতে নামিতে দেখি। তিনি আমাদের মাসিক বেতন আনিয়াছেন বলিয়া জানাইলেন। ইহার পর আমার সঙ্গীয় গার্ডদের ৮ জনকে লইয়া বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর দিকে রওয়ানা দেয়। যথাসময়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ীতে আমরা পৌঁছাইয়া আমি ও আমার সঙ্গীয় গার্ডরা বিউগলের সুরে সুরে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করিতে থাকি। এই সময় বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর দক্ষিণে লেকের দিক হইতে লাগাতার গুলী আসিতে থাকে। তখন আমি এবং আমার গার্ডসহ দেওয়ালের আড়ালে লাইন পজিশনে যাই। গুলী বন্ধ হওয়ার পর পালটা গুলী করার জন্য আমার পূর্ববর্তী গার্ড কমান্ডারের নিকট গুলী খোঁজাখুঁজি করিতে থাকি। এই সময় কালো ও খাকী পোশাকধারী সৈনিক হ্যান্ডসআপ বলিতে বলিতে গেইটের মধ্য দিয়া বাড়ীতে ঢুকে। তখন ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা, মেজর নূর ও মেজর মুহিউদ্দিনকে (ল্যান্সারের) গেইটে দেখি। তারপর ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও মেজর নূর বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর বারান্দায় আসিয়া সেখানে কামালকে দাঁড়ানো দেখিয়াই ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা হাতের স্টেনগান দ্বারা শেখ কামালকে গুলী করে। শেখ কামাল গুলী খাইয়া রিসিপশন রুমে পড়িয়া যায়। ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা পুনরায় শেখ কামালকে গুলী করিয়া হত্যা করে।

কয়েকজন এন সিও সিপাইসহ ২৫ জনের একটি দলকে ধানমন্ডিস্থ ৩২ নং রোডে ৬৭৭ নং বাড়ীতে অর্থাৎ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ীতে ডিউটিতে পাঠায়।

ইহার পর ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও মেজর নূর বাড়ীর পুলিশের ও কাজের লোকদেরকে গেইটের সামনে লাইনে দাঁড় করায়। ইহার পর মেজর মুহিউদ্দিন তাহার ল্যান্সারের ফোর্স লইয়া গুলী করিতে করিতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর দোতলার দিকে যায়। তারপর ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও মেজর নূর কয়েকজন ফোর্স লইয়া বাড়ীর বারেন্দা দিয়া দোতলার দিকে যায়। এই সময় আমাদেরকেও তাহাদের সাথে যাইতে হুকুম দিলে আমি তাহাদের পিছনে পিছনে যাই। ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও মেজর নূর সিঁড়ি দিয়া চৌকির উপরে গেলে মেজর মুহিউদ্দিন ও তাহার সঙ্গীয় ফোর্স বঙ্গবন্ধুকে নীচের দিকে নামাইয়া আনিতে দেখি। আমি ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও মেজর নূরের পিছনে দাঁড়ানো ছিলাম। এই সময় মেজর নূর ইংরেজীতে কি যেন বলিলেন। তখন মুহিউদ্দিন ও তাহার ফোর্স এক পাশে চলিয়া যায়। এই সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘তোরা কি চাস?’ এরপরই ক্যাপ্টেন হুদা ও মেজর নূর হাতের স্টেনগান দ্বারা বঙ্গবন্ধুকে গুলী করে। সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু সিঁড়ির মধ্যে পড়িয়া মৃত্যুবরণ করেন। তখন বঙ্গবন্ধুর পরনে একটা লুঙ্গি, গায়ে পাঞ্জাবী, এক হাতে সিগারেটের পাইপ, অন্য হাতে দিয়াশলাই ছিল। অতঃপর মেজর মুহিউদ্দিন, মেজর নূর, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদাসহ সবাই নীচে নামিয়া আসিয়া দক্ষিণ দিকে গেইটের বাহিরে রাস্তায় চলিয়া যায়। কিছুক্ষণ পর মেজর আজিজ পাশা, রিসালদার মোসলেউদ্দিন ও ল্যান্সারের ফোর্স এবং টু-ফিল্ড আর্টিলারীর ফোর্স গেইটের সামনে আসে। তারপর মেজর আজিজ পাশা তাহার ফোর্স লইয়া গেইটের মধ্যে দিয়া বাড়ীর দোতলার দিকে যাইতে থাকে। আমিও তাহাদের পিছনে পিছনে যাই।

সিঁড়ি দিয়া দোতলায় যাবার পর দোতলায় সুবেদার মেজর আবদুল ওয়াহাব জোয়ারদারকে দেখি। তারপর মেজর আজিজ পাশা তার ফোর্সসহ দোতলায় বঙ্গবন্ধুর রুমের দরজা খোলার জন্য বলে। দরজা না খুলিলে দরজায় গুলী করে। তখন বেগম মুজিব দরজা খুলিয়া দেয়। দরজা খুলিয়া বেগম মুজিব রুমের ভিতরে থাকা লোকদের না মারার জন্য কাকুতি মিনতি করেন। কিন্তু তাহার কথা না রাখিয়া একদল ফোর্স রুম হইতে বেগম মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও একজন বাড়ীর চাকরকে রুম হইতে বাহির করিয়া নিয়া আসে। বেগম মুজিব সিঁড়ির নিকট আসিয়া শেখ মুজিবের লাশ দেখিয়া কান্নায় ভাঙ্গিয়া পড়েন।

এরপর বেগম মুজিবকে পুনরায় বঙ্গবন্ধুর বেডরুমে নিয়া যায়। অপর শেখ নাসের, শেখ রাসেল ও চাকরকে নীচে নামাইয়া নিয়া যায়। মেজর আজিজ পাশা রিসালদার মুসলেমুদ্দিন হাতের স্টেনগান দ্বারা বঙ্গবন্ধুর বেডরুমে থাকা সবাইকে গুলী করে। সেখানে বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ জামালের ও শেখ কামালের স্ত্রী ছিল। তাহারা গুলী খাইয়া মৃত্যুবরণ করে। তাহার পর তাহারা নীচে চলিয়া আসে। আমিও তাহাদের পিছনে চলিয়া আসিয়া রিসিপশনের বাথরুমের মধ্যে গুলীবিদ্ধ অবস্থায় শেখ নাসেরের লাশ দেখি। এরপর গেইটের সামনে লাইনে সাদা পোশাক পরিহিত একজন পুলিশের লাশ দেখি। তারপর মেজর আজিজ পাশা গেইটের বাহিরে গিয়া ওয়ারলেসে কথাবার্তা বলে। কথা বলিয়া গেইটের সামনে আসে। তখন শেখ রাসেল তাহার মায়ের কাছে যাইবে বলিয়া কান্নাকাটি করিতেছিল।

মেজর আজিজ পাশা ল্যান্সারের একজন হাবিলদারকে হুকুম দিলেন, ‘শেখ রাসেলকে তাহার মায়ের কাছে নিয়া যাও।’ ঐ হাবিলদার শেখ রাসেলের হাত ধরিয়া দোতলায় নিয়া যায়। কিছুক্ষণ পর দোতলায় গুলীর আওয়াজ ও কান্নাকাটির চিৎকার শুনিতে পাই। তারপর ঐ হাবিলদার নীচে গেইটের কাছে আসিয়া মেজর আজিজ পাশাকে স্যার সব শেষ। ‘এরপর গেইটের সামনে একটা ট্যাংক আসে। মেজর ফারুক সাহেব ঐ ট্যাংক হইতে নামিলে মেজর আজিজ পাশা, মেজর নূর, মেজর মুহিউদ্দিন, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা তাহার সহিত কথাবার্তা বলেন। তারপর মেজর ফারুক ট্যাংক নিয়া চলিয়া যান। কিছুক্ষণ পর একটা লাল কারে করিয়া কর্নেল জামিলের লাশ বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর ভেতর নিয়া যায়। একই সময় দোতলায় কিছু ভাঙাচুরার শব্দ শুনিতে পাই। তখন বাড়ীর উত্তর পাশের সিঁড়ি দিয়া দোতলায় উঠিয়া বঙ্গবন্ধুর বেডরুমে যাই। সেখানে বেগম মুজিব, শেখ কামাল, শেখ জামালের স্ত্রী এবং শেখ কামালের স্ত্রীর লাশ রক্তাক্ত অবস্থায় দেখি।