কোটা সংস্কার আন্দোলন ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় গুলি চালিয়ে হত্যার ঘটনায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও চারটি হত্যা মামলা হয়েছে। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে নিহতদের পরিবার ও স্বজনেরা বাদী হয়ে এ মামলা করেন। আদালত মামলাগুলো এজাহার হিসেবে রেকর্ড করার জন্য সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দিয়েছেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়। এর পর থেকে আজ মঙ্গলবার পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে ১৮২টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৬২টিই হত্যা মামলা। এ ছাড়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় ১৩টি ও চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে ৯টিসহ মোট ২২টি অভিযোগ দায়ের হলো।
মামলাগুলোয় অভিযোগ আনা হয়, শেখ হাসিনার নির্দেশে পুলিশ, আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের সদস্যরা আন্দোলনকারীদের গুলি করে হত্যা করেছেন।
মামলাগুলোয় শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ নানা পেশার মানুষকে আসামি করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, উপদেষ্টা ও শীর্ষ পর্যায়ের নেতা মিলিয়ে ৩১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গুলিতে আসাদুল্লাহ হত্যায় মামলায়
আসাদুল্লাহ নামের এক যুবককে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ১৪১ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। আসাদুল্লাহর মা আয়েশা খাতুন বাদী হয়ে ঢাকার সিএমএম আদালতে এ মামলা করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গত ১৯ জুলাই সকালে উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর সড়কের ৩৩ নম্বর সড়কের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র-জনতা অবস্থান নেন। পরে সকাল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ছাত্র-জনতার সঙ্গে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা–কর্মীদের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলে। বিকেলের দিকে ছাত্রলীগ-যুবলীগের ২০০ থেকে ২৫০ জন নেতা–কর্মী ছাত্র-জনতার ওপর গুলি বর্ষণ করেন। পরে আসাদুল্লাহর কোনো খোঁজ পাননি। পরে ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে ছেলের মরদেহ শনাক্ত করেন স্বজনেরা।
মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়া তাঁর বোন শেখ রেহানা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির সাবেক গোয়েন্দাপ্রধান হারুন অর রশীদ, সহকারী কমিশনার খন্দকার রেজাউল হাসান, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, সাবেক সংসদ সদস্য খসরু চৌধুরী ও হাবিব হাসানকে আসামি করা হয়েছে।
মিরপুরে শাহাদাত হত্যায় স্ত্রীর মামলা
রাজধানীর মিরপুরে শাহাদাত হোসেন নামের এক যুবককে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ৮২ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। শাহাদাতের স্ত্রী সোনিয়া আক্তার আজ মঙ্গলবার ঢাকার সিএমএম আদালতে এ মামলা করেন। মামলার আরজিতে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৫ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে রাজধানীর মিরপুর থানার গেটের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা অবস্থান নেন। পরে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের ২০০ থেকে ৩০০ জন সদস্য ও পুলিশ সদস্য আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর হামলা করেন। পুলিশ ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচার গুলি চালায়। তখন গুলিবিদ্ধ হন শাহাদাত। পরে তাঁকে স্থানীয় আজমল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও শেখ রেহানা, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক সংসদ সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ও বাহাউদ্দিন নাছিম, সাবেক আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার, সাবেক সংসদ সদস্য ফেরদৌস আহমেদ ও ইলিয়াস মোল্লাকে আসামি করা হয়েছে।
গুলিতে কলেজছাত্রের মৃত্যু, বাবার মামলা
রাজধানীর মিরপুরে পল্লবীর সরকারি বঙ্গবন্ধু ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী মমিনুল ইসলামকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ৬৭ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। মমিনুলের বাবা বিপ্লব হোসেন আজ মঙ্গলবার ঢাকার সিএমএম আদালতে এ হত্যা মামলা করেন। মামলার আরজিতে উল্লেখ করা হয়, রাজধানীর মিরপুর-১০ গোলচত্বর এলাকায় গত ১৯ জুলাই সন্ধ্যার সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলন করছিলেন। তখন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের ১৫০ থেকে ২০০ জন সদস্য ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালান। এতে মমিনুল ইসলাম গুলিবিদ্ধ হন। তাঁকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যান আবদুল্লাহ সিদ্দিক
রাজধানীর ধানমন্ডিতে হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ সিদ্দিককে হত্যায় শেখ হাসিনাসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। আবদুল্লাহ সিদ্দিকের আত্মীয় ফাইয়াজ আহম্মেদ ঢাকার সিএমএম আদালতে আজ মঙ্গলবার এ মামলা করেন। মামলার আরজিতে উল্লেখ করা হয়, গত ৪ আগস্ট বিকেলে ধানমন্ডির জিগাতলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেন শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ সিদ্দিক। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় থেকে তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে আবদুল্লাহ সিদ্দিক মারা যান।
মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন ও র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক হারুন অর রশীদকে আসামি করা হয়েছে।