সরকারি চাকরির সব পদে কোটা সংস্কারের দাবি করছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। তাঁরা মনে করছেন, এটি সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়।
২০১৮ সালের কোটা সংস্কারের আন্দোলনে দাবি ছিল মূলত ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডে (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরি) কোটা সংস্কার করা। এবার আন্দোলনকারীরা সব গ্রেডে কোটা সংস্কারের দাবি করছেন।
শিক্ষার্থীদের অবরোধে গতকাল বুধবার সারা দেশে কার্যত অচল হয়ে পড়ে সড়ক, মহাসড়ক ও রেলপথ। সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্লকেড চলে। সারা দেশ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ঢাকা।
দাবি আদায়ে আজ বৃহস্পতিবার আবারও সারা দেশে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি পালন করবে শিক্ষার্থীরা। বেলা সাড়ে তিনটা থেকে এই কর্মসূচি শুরু হবে।
দেশে সরকারি চাকরিতে ২০টি গ্রেড আছে। নিয়োগ হয় মূলত ৯ম থেকে ২০তম গ্রেডে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত এসব চাকরিতে মোট ৫৬ শতাংশ কোটা ছিল। ওই বছর ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডের সব কোটা বাতিল করা হয়। তবে ১৪তম থেকে ২০তম গ্রেডে কোটা আগেও ছিল, এখনো আছে। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাভেদে এসব পদের কোটায় কিছু ভিন্নতা আছে।
২০১৮ সালের কোটা সংস্কারের আন্দোলনে দাবি ছিল মূলত ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডে (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরি) কোটা সংস্কার করা। এবার আন্দোলনকারীরা সব গ্রেডে কোটা সংস্কারের দাবি করছেন।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ যে স্থিতাবস্থার আদেশ দিয়েছেন, তা ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডকে নিয়েই। ফলে এসব গ্রেডে কোটা আপাতত থাকছে না, যা হাইকোর্টের এক রায়ে বহাল হয়েছিল।
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম গতকাল বুধবার ঢাকার শাহবাগে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের বিষয়টি তাঁদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সরকারি চাকরিতে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে কোটাবৈষম্য আরও বেশি।
সারজিস আরও বলেন, তাঁদের দাবি সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ কোটা রাখা। সেটিকে সামনে রেখে সরকার একটি পরিপত্র জারি করতে পারে। শুধু প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ন্যূনতম কোটাকে তাঁরা সমর্থন করেন। জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে সুবিধা দিলেও এসব কোটা ৫ শতাংশের বেশি রাখার প্রয়োজন হয় না।
সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের বিষয়টি তাঁদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সরকারি চাকরিতে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে কোটাবৈষম্য আরও বেশি।আন্দোলনকারীদের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম
সরকারি তথ্য বলছে, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরির ২০ শতাংশ পদে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হতো। বাকি ৮০ শতাংশ পদে নিয়োগ হতো কোটায়। ১৯৭৬ সালে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ৪০ শতাংশে বাড়ানো হয়। ১৯৮৫ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে ৪৫ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নিয়ম চালু করা হয়। বাকি ৫৫ শতাংশ অগ্রাধিকার কোটায় নিয়োগ দেওয়া হয়।
পরবর্তী সময়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ যোগ করে মোট কোটা দাঁড়ায় ৫৬ শতাংশ। মানে হলো, প্রতি ১০০ পদে নিয়োগে ৫৬ জনকে নেওয়া হতো কোটা থেকে। যদিও তাঁদের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় পাস করতে হয়। তারপর হতো কোটার বিবেচনা।
৫৬ শতাংশের মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা, ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা। শুরু থেকেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যে কোটা ছিল, তাতে পরে তাঁদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের যুক্ত করা হয়।
কোটার বিপরীতে থাকা অনেক পদ শূন্য থাকত। পরে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে কোটায় উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাতালিকা থেকে পূরণ করা হবে।
বিষয়টি এখন উচ্চ আদালতের বিচারাধীন। তাই এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলা ঠিক হবে না। তবে দেখা যায় নিচের পদগুলোতে পোষ্য কোটাসহ আরও কিছু কোটা আছে। তাই কোটার পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করে ন্যায্যতা ও সংবিধানের নির্দেশনার আলোকে সংস্কার করা দরকার।সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার
সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটায় ভিন্নতা আছে। একটি হলো, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে নিয়োগ। সেখানে নিয়োগ হয় আলাদা নিয়োগবিধি অনুযায়ী।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ হয়। সহকারী শিক্ষকের পদ ১৩তম গ্রেডের। আর প্রধান শিক্ষকের পদ ১১তম গ্রেডের। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা ২০১৯ অনুযায়ী, সরাসরি নিয়োগযোগ্য পদগুলোর ৬০ শতাংশ নারী প্রার্থীদের দিয়ে, ২০ শতাংশ পোষ্য (শিক্ষকদের সন্তান, বিধবা স্ত্রী বা বিপত্নীক স্বামী) প্রার্থীদের দিয়ে এবং ২০ শতাংশ পুরুষ প্রার্থীদের দিয়ে পূরণ করতে হয়। দেশে সরকারি ৬৫ হাজার ৫৬৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক রয়েছেন ৩ লাখ ৮৪ হাজারের বেশি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বাংলাদেশ রেলওয়েসহ সরকারের কিছু কিছু সংস্থায় নিয়োগের ক্ষেত্রে আলাদা কিছু কোটা রয়েছে।
সরকারি কর্মচারীদের পরিসংখ্যান-২০২৩ অনুযায়ী, সরকারি চাকরিতে এখন মোট অনুমোদিত পদ ১৯ লাখ ১৬ হাজারের মতো। এর মধ্যে প্রায় ৪ লাখ ৭৩ হাজার পদ শূন্য।
অনুমোদিত পদের মধ্যে ১ম থেকে ৮ম গ্রেডে পদ রয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ৮৯৯টি। এসব পদ মূলত পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। এসব উচ্চপর্যায়ের পদে নিয়োগ শুরু হয় ৯ম গ্রেড থেকে। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) অধীন বিসিএসসহ বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে এই পদে নিয়োগ হয়। সরকারি হিসাবে নবম গ্রেডের অনুমোদিত পদ আছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৯২৭টি।
১০ম থেকে ১৩তম গ্রেডের পদগুলো একসময় দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত চাকরি ছিল। ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেলে শ্রেণি বাতিল করে সব পদের পরিচয় নির্ধারণ করা হয় গ্রেডভিত্তিক। এসব গ্রেডে পদ রয়েছে ৭ লাখ ৭৭ হাজারের মতো।
১৪তম থেকে ২০তম গ্রেডে বিভিন্ন হারে কোটা বহাল আছে। সেখানে মোট পদ ৮ লাখ ৮২ হাজারের কিছু বেশি।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, তাঁরা নির্বাহী বিভাগের কাছে সব চাকরির কোটার সংস্কার চাইছেন। তাই তাঁদের আন্দোলন চলবে।
২০১৮ সালে কোটা সংস্কারের যে আন্দোলন হয়েছিল, তা করেছিলেন মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাঁরা সাধারণত সরকারি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে নিয়োগ পেতে চেষ্টা করেন। ফলে তাঁদের দাবিতে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডের চাকরিতে কোটা সংস্কারের বিষয়টি এসেছিল। সরকার তখন ওই সব পদে কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে।
এই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে রিট করেন চাকরিপ্রত্যাশী ও বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। হাইকোর্ট ওই পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছিলেন। গতকাল আপিল বিভাগ বিষয়টিতে স্থিতাবস্থার আদেশ দেন। আদালতে এসেছে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডের চাকরির কোটার বিষয়টি। শিক্ষার্থীরা বলছেন, তাঁরা নির্বাহী বিভাগের কাছে সব চাকরির কোটার সংস্কার চাইছেন। তাই তাঁদের আন্দোলন চলবে।
এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি এখন উচ্চ আদালতের বিচারাধীন। তাই এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলা ঠিক হবে না। তবে দেখা যায় নিচের পদগুলোতে পোষ্য কোটাসহ আরও কিছু কোটা আছে। তাই কোটার পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করে ন্যায্যতা ও সংবিধানের নির্দেশনার আলোকে সংস্কার করা দরকার।