সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও সাতটি হত্যা মামলা হয়েছে। এ ছাড়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও একটি হত্যাচেষ্টা মামলা হয়েছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও তিনটি হত্যা মামলা নেওয়ার আবেদন করা হয়েছে। বুধ ও বৃহস্পতিবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে এসব মামলা হয়েছে। এর বাইরে একটি হত্যা মামলা হয়েছে বগুড়ায়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এর পর থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ১৯১টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৭০টি হত্যা মামলা।
এ মামলাগুলোয় শেখ হাসিনা ছাড়া বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। সরকার পতনের পর থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিভিন্ন মামলায় আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, উপদেষ্টা ও শীর্ষ পর্যায়ের নেতা মিলিয়ে ৩৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
রাজধানীর উত্তরায় সেন্টু মিয়া নামের এক শরবত বিক্রেতাকে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ৩৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সেন্টু মিয়ার বাবা দুলাল মিয়া বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে এ মামলা করেন। মামলার আরজিতে বলা হয়, গত ২৭ জুলাই বিকেলে উত্তরার বিএনএস এলাকায় সেন্টু মিয়া বাবা দুলাল মিয়ার সঙ্গে শরবত বিক্রি করছিলেন। সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা অংশ নেন। তখন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের সদস্য এবং পুলিশ সদস্য ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালান। তখন সেন্টু মিয়াকে হামলা চালিয়ে গুরুতর জখম করা হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) সেন্টু মিয়া মারা যান।
মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আসামি করা হয়েছে।
বাবুল হাওলাদার নামের এক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ঢাকার সিএমএম আদালতে বৃহস্পতিবার এ মামলা করেন বাবুলের মামাতো ভাই বিল্লাল হোসেন। মামলার আরজিতে বলা হয়, গত ১৯ জুলাই বেলা তিনটার দিকে রামপুরার টিভি সেন্টার এলাকায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন। তখন পুলিশ, স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। তখন বাবুল গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। মামলায় ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, ডিবির প্রধান হারুন অর রশীদকে আসামি করা হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৪ আগস্ট রাজধানীর মোহাম্মদপুরে গুলিতে আলতাফ হোসেন নামের এক দিনমজুর নিহত হওয়ার ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ ৮২ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বুধবার ঢাকার সিএমএম আদালতে মামলাটি করেন আলতাফের মামাতো ভাই আশরাফ আলী। আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) নির্দেশ দিয়েছেন।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে শাওন তালুকদার নামের এক যুবককে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ৩১ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। নিহত শাওনের আত্মীয় ওয়াসী উদ্দিন বুধবার ঢাকার সিএমএম আদালতে মামলা করেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, ৫ আগস্ট দুপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান শাওন।
১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজধানীর মিরপুরে গুলিতে আবদুল্লাহ কবীর নামের এক যুবক নিহত হওয়ার ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ ৯৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বুধবার ঢাকার সিএমএম আদালতে এ মামলা করেন নিহত আবদুল্লাহ কবীরের আত্মীয় আবু বকর সিদ্দিক।
রাজধানীর বংশালে রিপন নামের এক ভ্যানচালককে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ১৭২ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। রিপনের আত্মীয় আছমা বেগম বুধবার ঢাকার সিএমএম আদালতে এ মামলা করেন। মামলার আরজির তথ্য অনুযায়ী, ৫ আগস্ট রাতে ভ্যানচালক রিপনকে বংশালে গুলি করে হত্যা করা হয়।
ভাটারা থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক আল আমিন হোসেনকে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আল আমিনের মা মনিহার বেগম বুধবার ঢাকার সিএমএম আদালতে এ মামলা করেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, ৫ আগস্ট দুপুরে বাড্ডা থানার সামনে স্থানীয় ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও পুলিশ গুলি করে আল আমিনকে হত্যা করে।
শিমুল আহমেদ নামের এক তরুণকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ১৬৩ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। বুধবার ঢাকার সিএমএম আদালতে এ মামলা করেন শিমুলের বাবা সুলতান আহমেদ। মামলার আরজিতে বল হয়, ১৯ জুলাই বিকেলে মিরপুর গোলচত্বরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার মিছিলে স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতা-কর্মীদের গুলিতে গুরুতর আহত হন শিমুল।
বগুড়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে রিপন ফকির নামের এক ব্যক্তি নিহত হওয়ার ঘটনায় শেখ হাসিনা, তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়সহ ১০৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বুধবার বগুড়া সদর থানায় মামলাটি করেন নিহত রিপন ফকিরের স্ত্রী মাবিয়া বেগম। মামলার এজাহার অনুযায়ী, ৪ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে বগুড়া শহরের ঝাউতলা এলাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান রিপন ফকির।
রুমন (২৫) নামের এক তরুণকে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ৫৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা নেওয়ার আবেদন করা হয়েছে। ঢাকার সিএমএম আদালতে বৃহস্পতিবার এ আবেদন করেন রুমনের বোন রুমিয়া আক্তার। এ–সংক্রান্ত মামলা হয়েছে কি না, সে বিষয়ে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য শেরেবাংলা নগর থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। মামলার আরজিতে বলা হয়, রুমন গত ১৯ জুলাই জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে অবস্থান করছিলেন। তখন হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হয়। গুলি গিয়ে লাগে রুমনের বুকে। তখন ঘটনাস্থলে রুমন মারা যান। মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়া সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ, সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদারকে আসামি করা হয়েছে।
রাজধানীর রায়েরবাগে শাহাদাত হোসেন (১৩) নামের এক কিশোরকে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ৪৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা নেওয়ার আবেদন করা হয়েছে। ঢাকার সিএমএম আদালতে বৃহস্পতিবার এ আবেদন করেন শাহাদাতের বাবা বাছির আলম। কিশোর শাহাদাতের মৃত্যুর ঘটনায় কোনো মামলা হয়েছে কি না, সেটি জানিয়ে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য কদমতলী থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
মামলার আরজিতে বলা হয়, গত ৫ আগস্ট বেলা আড়াইটার দিকে রায়েরবাগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেয় শাহাদাত হোসেন। তখন হঠাৎ কানে গুলি লাগে কিশোরের। পরে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। শেখ হাসিনা ছাড়া সাবেক মন্ত্রী দীপু মনি, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিবির প্রধান হারুন অর রশীদ, ওয়ারী বিভাগের ডিসি ইকবাল হোসেন, ওয়ারী জোনের এডিসি শাকিল মোহাম্মদ শামীম, যাত্রাবাড়ী থানার ওসি আবুল হাসান ও পুলিশ পরিদর্শক জাকির হোসেনকে মামলায় আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার আবেদন করা হয়েছে।
রাজধানীর রায়েরবাগে মোবারক হোসেন নামের এক বিক্রয়কর্মীকে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা নেওয়ার আবেদন করা হয়েছে। ঢাকার সিএমএম আদালতে এ আবেদন করেন মোবারকের মা জমিনা খাতুন। এ–সংক্রান্ত মামলা হয়েছে কি না, আদালত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য কদমতলী থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছেন। মামলার আরজিতে বলা হয়, গত ১৯ জুলাই সকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেন মোবারক। তখন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের সদস্যরা গুলি চালান। তখন মোবারক গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কতর্ব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, কদমতলী থানার সাবেক ওসি আবুল কালাম আজাদ, সাবেক সংসদ সদস্য মশিউর রহমান মোল্লা, স্বেচ্ছাসেবক লীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি কামরুল হাসান রিপনকে আসামি করা হয়েছে।