‘গোল্ডেন হক’ নামের জাহাজটি বাংলাদেশের কেএসআরএম গ্রুপের বহরে যুক্ত হওয়ার পর এর নাম হয় ‘এমভি আবদুল্লাহ’। জাহাজের ২৩ নাবিক সুস্থ আছেন বলে কেএসআরএম গ্রুপ জানিয়েছে
‘গোল্ডেন হক’ নামের জাহাজটি বাংলাদেশের কেএসআরএম গ্রুপের বহরে যুক্ত হওয়ার পর এর নাম হয় ‘এমভি আবদুল্লাহ’। জাহাজের ২৩ নাবিক সুস্থ আছেন বলে কেএসআরএম গ্রুপ জানিয়েছে

জিম্মি জাহাজের প্রধান কর্মকর্তার বার্তা

‘ফাইনাল কথা, টাকা না দিলে আমাদের একে একে মেরে ফেলতে বলেছে’

ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর প্রধান কর্মকর্তা (চিফ অফিসার) মো. আতিক উল্লাহ খান গতকাল মঙ্গলবার মাগরিবের পর মুঠোফোনে তাঁর স্ত্রীর কাছে একটি অডিও বার্তা পাঠিয়েছেন। অডিও বার্তাটি প্রথম আলোর হাতে এসেছে।

অডিও বার্তায় আতিক বলেছেন, ‘এই বার্তাটা সবাইকে পৌঁছে দিয়ো। আমাদের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে নিচ্ছে। ফাইনাল কথা হচ্ছে, এখানে যদি টাকা না দেয়, আমাদের একজন একজন করে মেরে ফেলতে বলেছে। তাঁদের যত তাড়াতাড়ি টাকা দেবে, তত তাড়াতাড়ি ছাড়বে বলেছে। এই বার্তাটা সবদিকে পৌঁছে দিয়ো।’

গতকাল রাতে আতিক উল্লাহ খানের নন্দনকাননের বাসায় গেলে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো তাঁর বার্তাটি স্বজনেরা এই প্রতিবেদককে দেন।

মো. আতিক উল্লাহ খান

গতকাল বাংলাদেশ সময় বেলা দেড়টার দিকে জলদস্যুরা জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। জাহাজটি মোজাম্বিক থেকে দুবাই যাচ্ছিল। জলদস্যুদের কবলে পড়া চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের এই জাহাজটি পরিচালনা করছে গ্রুপটির সহযোগী সংস্থা এস আর শিপিং লিমিটেড। জাহাজে আতিক উল্লাহসহ ২৩ বাংলাদেশি নাবিক রয়েছেন। তাঁরা জিম্মি হওয়ার খবর পাওয়ার পর থেকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে নাবিকদের স্বজনদের।

আতিকের বাড়ি চন্দনাইশের বরকল এলাকায়। মা, স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে তিনি থাকেন শহরের নন্দনকানন এলাকায়। মা শাহানুর আকতার ছেলের চিন্তায় অস্থির। তিনি কখনো কাঁদছেন, কখনো-বা নামাজে দাঁড়িয়ে ছেলের জন্য দোয়াদরুদ পড়ছেন।

শাহানুর বলেন, মাগরিবের সময় ছেলের সঙ্গে তাঁর শেষ কথা হয়। তখন আতিক তাঁকে বলেছেন, তাঁদের ৫০ জন জলদস্যু ঘিরে রেখেছে। একটা কেবিনে বন্দী সবাই। তাঁদের সোমালিয়া নিয়ে যাচ্ছে। আড়াই দিনের মতো লাগবে ওখানে পৌঁছাতে। সবার জন্য দোয়া চেয়েছেন আতিক।

কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন শাহানুর। গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে ছেলের জাহাজ জলদস্যুদের কবলে পড়ার কথা জানতে পারেন শাহানুর

আতিক উল্লাহ খানের মা ও দুই মেয়ে

গতকাল বেলা একটার দিকে আতিক জলদস্যুদের কবলে পড়তে যাওয়ার বিষয়টি আঁচ করেছিলেন বলে ধারণা করছেন স্বজনেরা। সে সময় ফোনে আতিক তাঁর স্ত্রী মিনা আজমিনকে বলছিলেন, ‘কয়েক দিন আমাকে ফোনে পাবে না। আমি নেটওয়ার্কের বাইরে থাকব।’

নন্দনকাননের বাসায় বসে আতিকের ভগ্নিপতি ওমর ফারুক বলেন, তিনি হয়তো জলদস্যুদের জাহাজে ওঠার সময় ফোন দিয়ে ভাবিকে এ কথা জানিয়েছিলেন। পরিবার চিন্তা করবে বলে তিনি হয়তো জলদস্যুদের কথা বলেননি। পরে জানাজানি হলে পরিবারের সঙ্গে ফোনে দু-একবার পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয়। অডিও বার্তাও পাঠান।

জাহাজের আরেক নাবিক তাঁর স্ত্রীকে ভিডিও পাঠালে সেখান থেকে মিনা আজমিনসহ পরিবারের সদস্যরা ঘটনা জানতে পারেন। সবাই তখন কান্নায় ভেঙে পড়েন। আতিকের স্ত্রী ও মায়ের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। তাঁর দুই মেয়ে বাবার জন্য কাঁদছে।

স্ত্রী ও তিন সন্তানের সঙ্গে আতিক উল্লাহ খান

বড় মেয়ে ইয়াশরা ফাতেমার তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। মেজ মেয়ে উনাইজা পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে। ছোট মেয়ের বয়স দেড় বছর।

গতকাল মাগরিবের পর আতিক যখন শেষবার ফোন করেন, তখন স্ত্রী মিনা নামাজে দাঁড়িয়েছেন। তখন মেজ মেয়ে উনাইজা ফোন ধরে। আতিক মেয়েকে তখন শুধু বলেন, ‘আম্মুকে বোলো দোয়া করতে। আমাদের ফোন নিয়ে নিচ্ছে।’

অতটুকু বলেই ফোন কেটে দেন আতিক। এরপর অডিও ভয়েস হোয়াটসঅ্যাপে পাঠান। আর ফোন খোলা পাওয়া যায়নি আতিকের।

১৪ বছর ধরে জাহাজে চাকরি করলেও কোনো সময় ছেলের এমন বিপদ আসেনি বলে জানান মা শাহানুর। তিনি দুই নাতনিকে জড়িয়ে সোফায় বসেছিলেন। স্বজনেরা একে একে বাসায় ভিড় করছিলেন।

শাহানুর বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার ছেলেকে ফিরিয়ে আনার আকুতি জানাচ্ছি। তিনিও একজন মা। আমার তিনটা ছোট ছোট নাতনি। ছেলেবউ অসুস্থ।’
আতিকের স্ত্রী মিনা এখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্বামীর এমন বিপদের খবর শোনার পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। গতকাল রাতে তাঁকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।

২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর গ্রুপটির জাহাজ ‘এমভি জাহান মনি’ ছিনতাই করেছিল সোমালিয়ার জলদস্যুরা। তিন মাসের মাথায় মুক্তিপণ দিয়ে জাহাজটি ছাড়িয়ে এনেছিল কবির গ্রুপ।