মাত্র সাত বছরে পা দিয়েছে বাসিত খান মুসা। হাসি মুখে দৌড়ে গিয়ে মা নিশামনিকে বলেছিল, ‘মাম্মি, বাইরে গুলির শব্দ।’ বাইরে গিয়ে গোলাগুলি দেখবে কি না তাও জানতে চেয়েছিল। মা ছেলেকে বাইরে যেতে ‘না’ করেছিলেন বলে ‘মাম্মি পচা’ বলে কপট রাগও দেখিয়েছিল। তারপর একসময় বাইরের পরিস্থিতি মোটামুটি শান্ত হয়ে এলে ছয় তলার বাসা থেকে মুসা তার দাদি মায়া ইসলামকে (৬০) নিয়ে নিচে নেমেছিল আইসক্রিম কেনার জন্য। তারপর বাইরে থেকে আসা এক গুলি মুসার মাথায় লেগে তা বের হয়ে পেছনে থাকা দাদির তলপেটে ঢুকে যায়।
এ ঘটনা ১৯ জুলাই বেলা ৩টার দিকে ঘটে রাজধানীর রামপুরা থানার সামনে মেরাদিয়া হাট এলাকায়। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সেদিন ওই এলাকায় চলছিল সংঘর্ষ-গোলাগুলি। ওই সংঘর্ষে চলা গুলিতে প্রাণ গেছে মুসার দাদি মায়া ইসলামের। আর মুসার ঠিকানা এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)।
গুলি লাগার পরপরই মুসাকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে। দুই দিন পর পাঠানো হয় ওয়ার্ডে। তবে আজ শনিবার শারীরিক অবস্থা খারাপ হলে বেলা আড়াইটার দিকে আবার আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। মুসার জ্ঞান এখনো ফেরেনি। তার দুই চোখেও আঘাত লেগেছে। তাই এই মুহূর্তে মুসার বিষয়ে কোনো আশার কথা বলতে পারছেন না চিকিৎসকেরা।
আজ লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার আগে হাসপাতালের ২০৪ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি সন্তানকে নিয়ে সব সময় ব্যতিব্যস্ত ছিলেন মুসার মা-বাবা। মা নিশামনি একটু পরপর ছেলের বুকের কাছে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলেন, নিশ্বাস নিচ্ছে কি না। ব্যান্ডেজ মোড়ানো মাথায় চুমু দিচ্ছিলেন। হঠাৎ কখনো মুসার শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়লে শঙ্কায় কাঁপছিলেন।
মুসা খিলগাঁও তালতলায় শহীদ বাবুল একাডেমি পল্লিমা সংসদে নার্সারিতে (ইংলিশ ভার্সন) পড়ে। তার বাবার নাম মুস্তাফিজুর রহমান। মেরাদিয়া হাট এলাকায় স্ত্রী, একমাত্র ছেলে ও মা-বাবাকে ভাড়া বাসায় থাকেন তিনি। মালিবাগে ইলেকট্রনিক পণ্যের ব্যবসা করেন। আজ দুপুরে মুসাকে আইসিইউতে নেওয়ার পর ছুটছিলেন রক্ত সংগ্রহের জন্য। তখন কিছু সময় কথা হয় তাঁর স্ত্রী নিশামনির সঙ্গে।
নিশামনি বলেন, ‘১৯ জুলাই দুপুরে একটু ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। ছেলে এসে গুলির কথা জানায়। একসময় চারপাশ শান্তও হয়ে যায়। ছেলের বাবা আমার শ্বশুরের জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে যাবে। ছেলেও নাকি আইসক্রিমের বায়না করেছিল। তাই নাতিকে নিয়ে নিচে নেমেছিলেন শাশুড়ি। গুলির শব্দ শুনে ফিরেও আসছিলেন। তবে সব লন্ডভন্ড হয়ে গেল।’
আইসিইউর সামনে বসে নিশামনি জানালেন, তাঁদের বাসায় ঢোকার জন্য একটি প্রধান গেট আছে। তারপর গ্যারেজ। গ্যারেজ থেকে বাসায় ঢুকতে হয় ছোট আরেকটি গেট দিয়ে। ঘটনার দিন দুটি গেটই বন্ধ ছিল। তাঁর ছেলে ও দাদি যখন বাসার নিচে নেমেছিলেন, তখন ছোট গেটের আরও লোকজন ছিলেন। এ সময় একটি গুলি এসে মুসার মাথায় লাগে। তারপর তা তাঁর শাশুড়ির তলপেটে ঢুকে যায়।
নিশামনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘শাশুড়িকে হারিয়ে ফেলেছি। আমার ছেলে বাঁচবে কি না, সে গ্যারান্টি দিতে পারছেন না চিকিৎসকেরা। বাঁচলেও ভবিষ্যতে সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে কি না, তা–ও জানি না। আমার ছেলে কি আন্দোলনে গিয়েছিল? সে কি প্রতিবাদ করেছিল? সে তো বাড়িতে ছিল। বাড়িতেও বাচ্চারা নিরাপদ নয়। মা–বাবার বুকেও সন্তানেরা নিরাপদ নয়।’
নিশামনি প্রথমে তাঁর শাশুড়ি শরীরে গুলি লাগার খবর শোনেন। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে জানতে পারেন তাঁর ছেলের মাথায়ও গুলি লেগেছে। আহত অবস্থায় মায়া ইসলাম দোতলা পর্যন্ত উঠে জ্ঞান হারান। তখন সেখানে থাকা লোকজন তাঁকে স্থানীয় একটি হাসপাতাল নিয়ে যান। আর মুস্তাফিজুর রহমান ছেলেকে নিয়ে স্থানীয় একটি হাসপাতাল হয়ে ঢাকা মেডিকেলে যান।
নিশামনি বলেন, একাধিক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ফোন দেওয়ার পর তাঁর শাশুড়ির খোঁজ পাওয়া যায়। স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার পর তাঁকে ছেড়ে দিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। সঙ্গে ছিলেন শ্বশুর মাহবুব ইসলাম। তবে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়িতে ফিরতে পারেননি তিনি। এক আত্মীয়ের বাড়িতে যান। পরদিন ভোরে শাশুড়ির অবস্থা খারাপ হয়। তখন ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হলে চিকিৎসকেররা জানান, হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
মায়া ইসলামের এক ছেলে ও এক মেয়ে। তাঁর মৃত্যুর সময় ছেলে মুস্তাফিজুর রহমান হাসপাতালে মুসাকে নিয়ে ব্যস্ত। তিনি মৃত মায়ের মুখ দেখেন অ্যাম্বুলেন্সে। টাঙ্গাইলে তাঁর জানাজা বা দাফনে অংশ নিতে পারেননি। শাশুড়িকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে নিশামনি বললেন, মাত্র দুই বছর বয়সে তাঁর বাবা মারা যান। একমাত্র বোন নারায়ণগঞ্জে থাকেন। বিয়ের পর থেকে শাশুড়ি তাঁকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসতেন। বেশির ভাগ সময় মুসাকে তিনিই আগলে রাখতেন।
কথা শেষে আস্তে আস্তে আইসিইউর দিকে এগোচ্ছিলেন নিশামনি। তখন তিনি বললেন, ‘শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে আমার সুখের সংসার ছিল। তেমন কোনো অভিযোগ ছিল না আমাদের। আমার ছেলেটার জন্য আপনারা সবাই দোয়া করবেন।’