গাইবান্ধা–৫ উপনির্বাচন

ভোটকেন্দ্রের ‘ডাকাতেরা’ ছিলেন বহিরাগত

  • কয়েকজন প্রিসাইডিং কর্মকর্তার সই করা সাদা কাগজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

  • প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা বলছেন, চাপের মুখে বাধ্য হয়ে তাঁরা ওই কাগজে সই করেছেন।

গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে স্থাপন করা হয়েছিল সিসিটিভি ক্যামেরা, যা সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল ঢাকার আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবন থেকে। সেখানে স্থাপিত কন্ট্রোল রুমের পর্দায় বিশৃঙ্খলার চিত্র

গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা–ফুলছড়ি) আসনের উপনির্বাচনে প্রভাব খাটিয়ে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ঢুকে যাঁরা ভোট দিয়েছেন, তাঁরা বহিরাগত। স্থানীয় লোকজন তাঁদের চেনেন না। গতকাল বৃহস্পতিবার ১৪ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও জাতীয় পার্টির (জাপা) ৯ জন এজেন্টের সঙ্গে প্রথম আলোর এই প্রতিনিধির কথা হয়। তাঁরা বলেছেন, ভোটকেন্দ্রের ‘ডাকাতেরা’ ছিলেন বহিরাগত।

এদিকে গতকাল কয়েকজন প্রিসাইডিং কর্মকর্তার সই করা সাদা কাগজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে (ভাইরাল)। এসব কাগজকে নির্বাচনের ফলাফল বলে দাবি করা হচ্ছে। কাগজগুলোতে কেন্দ্রের প্রাপ্ত ভোটসংখ্যা উল্লেখ রয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলেও তাতে বলা হয়েছে। তবে প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা বলছেন, ভোট গ্রহণ বন্ধ ঘোষণার পর কেন্দ্র ছাড়ার আগে স্থানীয় লোকজনের চাপের মুখে বাধ্য হয়ে তাঁরা ওই কাগজে সই করেছেন।

আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কর্মী–সমর্থকেরা শতাধিক কেন্দ্র থেকে লাঙ্গলের এজেন্টদের বের করে দেন বলে গতকাল অভিযোগ করেছেন জাপা প্রার্থী গোলাম শহীদ। তবে এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহমুদ হাসান। আর নির্বাচনে সুষ্ঠুভাবে ভোট হওয়া কেন্দ্রগুলোর ফলাফল ঘোষণার দাবিতে গতকাল সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলায় পৃথক বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা।

ভোট শুরুর পর নানা অনিয়মের অভিযোগে গত বুধবার উপনির্বাচনের ভোট বন্ধ ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। এ সময় সাংবাদিকেরা সিইসির কাছে জানতে চান, গোপন কক্ষে অনুপ্রবেশকারীরাই ভোটকেন্দ্রের ‘ডাকাত’ কি না। জবাবে সিইসি বলেন, ‘এরাই ডাকাত। এরাই দুর্বৃত্ত। যারা আইন মানে না, তাদেরই আমরা ডাকাত বলতে পারি, দুর্বৃত্ত বলতে পারি।’

আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে কেন্দ্রে প্রভাব খাটিয়ে নৌকায় ভোট নেওয়ার অভিযোগ করেছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী।

গতকাল যে ১৪ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও জাপা প্রার্থীর ৯ এজেন্টের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়েছে, তাঁরা প্রায় সবাই ভোটকেন্দ্রে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশের কথা বলেছেন। সাঘাটা উপজেলার বেড়াগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে লাঙ্গলের এজেন্ট ছিলেন মিজানুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভোট গ্রহণের শুরুতে তাঁকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেন নৌকার কর্মীরা। পরে তাঁরা প্রভাব খাটিয়ে নৌকায় ভোট দেন। ওই সব কর্মীকে তিনি চেনেন না। তাঁরা বহিরাগত। একই কেন্দ্রের জাপার এজেন্ট শাহজাহান মিয়া বলেন, এ কেন্দ্রে লাঙ্গলের চারজন এজেন্ট দেওয়া হয়। সবাইকে নৌকার কর্মীরা ভোটকক্ষ থেকে বের করে দেন।

একই উপজেলার গোবিন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে লাঙ্গলের এজেন্ট জাহাঙ্গীর মিয়া বলেন, তিনিসহ আটজন এ কেন্দ্রে লাঙ্গলের এজেন্ট ছিলেন। কিন্তু ভোট শুরুর আধা ঘণ্টা পর নৌকার কর্মীরা ভয়ভীতি দেখিয়ে তাঁদের কক্ষ থেকে বের করে দেন। বিষয়টি প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও পুলিশকে জানিয়েও কোনো কাজ হয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কেন্দ্রের একজন পোলিং কর্মকর্তা বলেন, গোপন কক্ষে ঢুকে নৌকায় ভোট নেওয়া হয়। বাধা দেওয়া হলেও তাঁরা শোনেননি। গোবিন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আলিম উদ্দিন বলেন, অভিযোগ পেয়ে তিনি জাপার এজেন্টদের কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ কক্ষে ফিরিয়ে আনেন। একই ধরনের অভিযোগ করেন একই উপজেলার ঘুড়িদহ দাখিল মাদ্রাসা কেন্দ্রের লাঙ্গলের এজেন্ট ফারুক সরদার, রুবেল মিয়া ও আজাদুল।

গাইবান্ধার পুলিশ সুপার মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, তিনি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেখেছেন। কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা কিংবা প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ তাঁদের কাছে কেউ করেননি।

স্থগিত হওয়া সাঘাটার ভরতখালী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বেলাল উদ্দিন বলেন, তাঁর কেন্দ্রে নৌকার একজন এজেন্ট প্রভাব খাটিয়ে দুটি বুথে ভোট নিচ্ছিলেন। এমন দৃশ্য সিসিটিভি ক্যামেরায় দেখে নির্বাচন কমিশন ভোট গ্রহণ স্থগিতের নির্দেশ দেয়।

জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থী বলেন, ১৪৫টি কেন্দ্র থেকে তাঁর শতাধিক এজেন্টকে বের করে দেওয়া হয়। তিনি নিজের ভোটটিও দিতে পারেননি। তাঁর কেন্দ্র সাঘাটার কাজী আজাহার আলী উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখেন, সব কক্ষে লোকজনে ভর্তি। পরিস্থিতি দেখে তিনি ফিরে যান।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মাহমুদ হাসান বলেন, তাঁর কোনো কর্মী–সমর্থক জাপা ও অন্যান্য প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেননি এবং বাধাও দেননি। তাঁর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন। তিনি স্থগিত করা কেন্দ্র বাদে বাকি কেন্দ্রগুলোর ফলাফল ঘোষণার দাবি জানান।

একই দাবিতে গতকাল দুই উপজেলায় পৃথক বিক্ষোভ কর্মসূচি করেছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে সাঘাটা উপজেলা পরিষদ চত্বরের সামনে থেকে মিছিল বের করে উপজেলা আওয়ামী লীগ। এর আগে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ফুলছড়ি উপজেলায় মিছিল ও সড়কের ওপর আগুন জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করেন বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা।

নির্বাচনে পাঁচজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তাঁরা হলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহমুদ হাসান, জাতীয় পার্টির (জাপা) এ এইচ এম গোলাম শহীদ, বিকল্পধারার জাহাঙ্গীর আলম, স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদুজ্জামান এবং সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য চার প্রার্থী ভোট বর্জন করেন।

সাদা কাগজ ভাইরাল

প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের সই করা সাদা কাগজে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়। নিচে মুঠোফোন নম্বরসহ প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের সই ও সিল রয়েছে। এ প্রসঙ্গে সাঘাটা উপজেলার বেড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, উপনির্বাচন বন্ধ ঘোষণার পর তাঁরা কেন্দ্র ত্যাগ করার প্রস্তুতি নেন। এ সময় স্থানীয় জনগণ তাঁদের ঘিরে ধরেন এবং লিখিত ভোটের ফলাফল চান। তাঁদের চাপের মুখে সাদা কাগজে লিখিত ফলাফল দিয়ে মালামালসহ কেন্দ্র ত্যাগ করেন।

একই উপজেলার জাদুরতাইর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. আবদুল লতিফও সাদা কাগজে চিঠি দিতে বাধ্য হন বলে জানান। তিনি বলেন, স্থানীয় মানুষ তাঁদের ঘেরাও করে রাখেন। লিখিতভাবে ভোটের ফলাফল দিয়ে কেন্দ্র ত্যাগ করতে বলেন তাঁরা।

প্রায় একই রকম পরিস্থিতির মুখে পড়ে সাঘাটার মথরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. মশিউর রহমানও সই করতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানালেন। মোট নয়জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে একই ধরনের মন্তব্য পাওয়া গেছে।

জানতে চাইলে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম গতকাল রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, সাদা কাগজে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের এ ধরনের কোনো লিখিত ফলাফল তাঁরা পাননি। এটা কীভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে, তা–ও তাঁর জানা নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যদি তা-ই হয়, তাহলে এটা ফৌজদারি অপরাধ। কোনো কমিশনারের তত্ত্বাবধানে বিষয়টি তদন্ত করে দেখা উচিত। তাঁদের ভূমিকা কী ছিল, তা সিসিটিভির মাধ্যমে বেরিয়ে আসবে। একই সঙ্গে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রের সিসিটিভি ভেঙে ফেলা ও রাউটার বন্ধ করার ঘটনাগুলো নির্বাচনে দায়িত্বরত কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছিল কি না, তা–ও খতিয়ে দেখতে হবে।